সূরা মুহাম্মাদ : আয়াত ২১-২৪ (পর্ব-৫)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা মুহাম্মাদের ৫ম পর্ব নিয়ে আলোচনা। আজ আমরা এই সূরার ২১ থেকে ২৪ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। এই সূরার ২১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
طَاعَةٌ وَقَوْلٌ مَعْرُوفٌ فَإِذَا عَزَمَ الأمْرُ فَلَوْ صَدَقُوا اللَّهَ لَکَانَ خَیْرًا لَهُمْ ﴿٢١﴾
“আনুগত্য করা ও ন্যায়সঙ্গত কথা বলা [তাদের জন্য ভালো]। সুতরাং যখন জিহাদের নির্দেশ চূড়ান্ত হয়েছে তখন যদি তারা আল্লাহকে দেওয়া অঙ্গীকার পূরণ করে [এবং একনিষ্ঠ চিত্তে জিহাদ করে] তাহলে নিঃসন্দেহে সেটা তাদের জন্য মঙ্গলজনক। ”(৪৭:২১)
গত আসরে দুর্বল ঈমানের অধিকারী একদল মুনাফিক চরিত্রের মানুষের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছিল, তারা মুখে জিহাদ করার দাবি জানাত কিন্তু যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে জিহাদের আয়াত অবতীর্ণ হলো তখন তারা নানা অজুহাত তুলে জিহাদে যেতে অস্বীকৃতি জানাল। এরপর এই আয়াতের ওই সব মানুষকে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: ঈমানের দাবি হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা এবং অসংলগ্ন কথা ও অহেতুক অজুহাত উত্থাপন থেকে বিরত থাকা। কারণ, তোমাদের এ ধরনের বক্তব্যে ঈমানদার ব্যক্তিদের মনোবল ভেঙে যায় এবং তাদেরকে কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদে যাওয়া থেকে বিরত রাখে। এরপর বলা হচ্ছে, এসব দুর্বল ঈমানদার যদি তাদের প্রতিশ্রুতিতে সত্যনিষ্ঠ হতে চায় তাহলে তাদেরকে শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদে অংশ নিতে হবে। জিহাদ করলে পার্থিব জীবনে তাদের সম্মান বৃদ্ধি পাবে এবং পরকালে তাদের জন্য থাকবে মহা পুরস্কার।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- ঈমানের দাবি হচ্ছে সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠ কথা বলা এবং সে অনুযায়ী আচরণ করা। যা খুশি তাই বলা এবং মনের ইচ্ছা অনুযায়ী জীবনযাপন করার নাম ঈমানদারী নয়।
২- ইসলামের শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদ করা আল্লাহ তায়ালার অন্যতম কঠোর নির্দেশ। জিহাদের ডাক এলে তাতে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং কোনো অজুহাত দাঁড় করানো যাবে না।
সূরা মুহাম্মাদের ২২ ও ২৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
فَهَلْ عَسَیْتُمْ إِنْ تَوَلَّیْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِی الأرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَکُمْ ﴿٢٢﴾ أُولَئِکَ الَّذِینَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ ﴿٢٣﴾
“সুতরাং [হে রোগাক্রান্ত আত্মা ও দুর্বল ঈমানের অধিকারী!] তোমরা যদি অবাধ্য হয়ে মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে পরিণতিতে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে।” (৪৭:২২)
“এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ তার রহমত থেকে বঞ্চিত করেছেন, ফলে তিনি তাদের [কর্ণসমূহকে] বধির করেছেন এবং তাদের দৃষ্টিসমূহকে অন্ধ করে দিয়েছেন।” (৪৭:২৩)
আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে দুর্বল ঈমানদারদের উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: জিহাদের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করলে মুশরিকরা তোমাদের ওপর কর্তৃত্ব করবে। তোমরা পুনরায় সেই মূর্খতার যুগে ফিরে যাবে এবং পরস্পর খুনোখুনিতে লিপ্ত হবে ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে। এমনকি আবার কন্যা সন্তানকে জীবিত কবর দেয়ার রীতিও চালু হবে।
এরপর আল্লাহ তায়ালা বলছেন: জিহাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া ও এজন্য অজুহাত তৈরি করার কারণে এসব দুর্বল ঈমানদার ও মুনাফিক চরিত্রের মানুষ সত্যবাণী ও দ্বীনি বক্তব্য শোনা ও তা উপলব্ধি করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। কাজেই যারা সত্য উপলব্ধি করে না তারা সত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায় এবং মহান আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়।
এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো:
১- পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে জিহাদ ত্যাগ করা হলে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অন্যায়ভাবে রক্তপাত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়।
২- আল্লাহর নির্দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে পারিবারিক বন্ধন ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়।
৩- যারা সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে, পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করে তারা শুধু আল্লাহর রহমত থেকেই বঞ্চিত হয় না সেই সঙ্গে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অভিশপ্তও হয়ে যায়।
৪- শুধুমাত্র চোখ ও কান থাকলেই যে মানুষ সবকিছু শুনতে ও দেখতে পাবে তা ঠিক নয়। আল্লাহর আদেশ না মানাকে অভ্যাসে পরিণত করলে তিনি তার নির্দেশ শোনা ও সে অনুযায়ী আমল করার শক্তি মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেন।
সূরা মুহাম্মাদের ২৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
أَفَلا یَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا ﴿٢٤﴾
“তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহ তালাবদ্ধ হয়ে গেছে?” (৪৭:২৪)
এই আয়াতে বলা হচ্ছে: দুর্বল ঈমানের অধিকারী এসব মানুষের প্রধান সমস্যা হলো তারা হয় কুরআনের আয়াত নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করে না অথবা প্রবৃত্তির অনুসরণ করার কারণে যা কিছু শোনে তা পালন করে না বরং তার বিরুদ্ধাচরণ করে। এই আয়াত দুর্বল ঈমানদারদের সম্পর্কে নাজিল হলেও সূরা সোয়াদের ২৯ নম্বর আয়াতে পবিত্র কুরআনের আয়াত নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে প্রতিটি মুমিন নরনারীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, “এটা মুবারক কিতাব, এটা আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহে গভীরভাবে চিন্তা করে।”
এ কারণে কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহর রাসূল (সা.) কুরআন পরিত্যাগ করার ব্যাপারে অভিযোগ তুলবেন যার দায়ে গোটা মুসলিম উম্মাহ দোষী সাব্যস্ত হবে। এই মহাগ্রন্থের প্রতি ভ্রুক্ষেপহীনতার জন্য মুসলমানরা দায়ী হবে। এই ভ্রুক্ষেপহীনতার কয়েকটি ধরণ রয়েছে। একদল মানুষ আছে যারা কুরআন তেলাওয়াতই করে না, আরেকদল তেলাওয়াত করে ঠিকই কিন্তু তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না আর সর্বশেষ দল তেলাওয়াত ও উপলব্ধি করলেও কুরআনের শিক্ষা বাস্তবায়ন করে না।
এই আয়াতের শিক্ষা অনুযায়ী, মুসলিম সমাজের সকল কথা ও কাজ হতে হবে পবিত্র কুরআনের নির্দেশে। আর তা হলেই সমাজে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হবে এবং মানুষর সব প্রয়োজন মিটবে। কুরআনের নির্দেশ অমান্য করা হলে প্রথমে মানুষের অন্তর তালাবদ্ধ হয়ে যাবে, সমাজ অসংখ্য সমস্যার সম্মুখীন হবে এবং মানুষের মুক্তি ও কল্যাণের সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:
১- পবিত্র কুরআন শুধু তেলাওয়াতের গ্রন্থ নয় বরং এর আয়াত নিয়ে চিন্তাভাবনা ও গবেষণা করতে হবে। তেলাওয়াত করতে হবে গবেষণার উদ্দেশ্যে। এই আয়াত অনুযায়ী, যারা কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না তারা আল্লাহর ক্রোধের শিকার হয়।
২- কুরআন নিয়ে চিন্তাগবেষণা করা প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব। এটিকে কিছু মানুষের দায়িত্ব হিসেবে চালিয়ে দেয়ার সুযোগ নেই।
৩- কুরআনের আয়াত নিয়ে চিন্তাভাবনা না করলে মানুষের অন্তর তালাবদ্ধ হয়ে যায়। অন্য কথায় তালাবদ্ধ অন্তর কুরআনের শিক্ষা উপলব্ধি করতে বা তা থেকে উপকৃত হতে পারে না।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।