ডিসেম্বর ১০, ২০২১ ১৮:৩৪ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, আমাদের অনেক অনেক প্রীতি আর শুভেচ্ছা নাও। আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। আজকের আসরে তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি নাসির মাহমুদ  এবং আমি আকতার জাহান।

আকতার জাহান: বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল হযরত মূসা (আ.)-এর নাম শুনেছো! প্রাচীন মিশরের গোশন প্রদেশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। হযরত মূসা ছিলেন সবচেয়ে বড় পাঁচ রাসূলের অন্যতম। অন্য চারজন রাসূল হলেন- হযরত নূহ (আ.), ইব্রাহিম (আ.), ঈসা (আ.) এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সা.)।

নাসির মাহমুদ: বনী ইসরাঈলের নবী হযরত মুসা (আ.)-এর নাম পবিত্র কুরআনে সর্বাধিকবার আলোচিত হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর নাম উদ্ধৃত হয়েছে ১৩৬ বার।

তো বন্ধুরা, আজকের আসরে আমরা হযরত মূসা (আ.) ও এক মেষ পালকের গল্প শোনাব। আর গল্পের পর থাকবে একটি গান ও একটি কবিতা। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে প্রথমেই গল্পটি শোনা যাক। (বাজনা)

আকতার জাহান: একদিন হযরত মূসা (আ.) এক পাহাড়ী পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় রাস্তার পাশ থেকে একটি করুণ আওয়াজ তার কানে এলো। ব্যাপার কি দেখার জন্য যেদিক থেকে আওয়াজ আসছে সেদিকে তিনি এগিয়ে গেলেন এবং একটি টিলার পাশে দেখতে পেলেন যে, সরল সাদাসিদে মেষ পালক আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে মুনাজাত ও কান্নাকাটি করছে।

নাসির মাহমুদ: মেষ পালক আল্লাহর উদ্দেশ্যে বলছে, “হে আমার প্রভু! যদি জানতাম তুমি কোথায় থাকো তাহলে আমি নিজেই তোমার কাছে ছুটে গিয়ে তোমার গোলামী করতাম, তোমার মাথার চুলে তেল দিয়ে ভাঁজ করে দিতাম, তোমার জুতা সেলাই করতাম, তোমার কাপড়-চোপড় ধুয়ে দিতাম। হে খোদা, আমি তোমাকে খুব ভালবাসি। যদি তোমাকে কখনো দেখতে পাই তাহলে তোমার পদতলে আমার জান কোরবান করে দেবো। আমার সকল ভেড়া, ছাগল ও দুম্বা তোমাকে দিয়ে দেবো। হে খোদা, আমি তোমার ঠিকানা জানতে চাই, পনির, তেলে ভাজা রুটি ও দুধ নিয়ে যাবো। প্রতিদিন তোমার কাছে যাবো, তোমার যত কাজ আছে সব করে দেবো, তোমার ঘর-দুয়ার ঝাড়ু দেবো, তুমি অসুস্থ হলে তোমার সেবা করবো।”

আকতার জাহান: মেষ পালক এভাবে তার মনের কথা গুনগুনিয়ে বলে যাচ্ছিলো। হযরত মূসা (আ.) মেষ পালকের এসব কথায় চটে গেলেন। তার সামনে গিয়ে তাকে ডেকে বললেন: হে আল্লাহর বান্দা, এসব কি যা’তা কথা বলছো? এসব কথা কুফরি কালাম; এসব কথা বলা গুনাহ। এসব খারাপ কথা। তোমাকে তওবা করতে হবে। আর কক্ষণো এসব কথা মুখে আনবে না। শিগগির কথা থামাও, মুখ বন্ধ করো।

নাসির মাহমুদ: মেষ পালক বলল, তুমি কে? এখানে এসে নাক গলাচ্ছো কেন? আমি তো কোনো খারাপ কথা বলছি না। আমি মুনাজাতে মশগুল, নিজের প্রভুর ইবাদত করছি। আমি খোদা-পরাস্ত, খোদা পূজারী। তবে তুমি কি খোদা পরাস্ত নও?

আকতার জাহান: মূসা নবী বললেন, নিশ্চয়ই আমি খোদা পরাস্ত। কি করে সম্ভব যে, আমি খোদা পরাস্ত নই। আমি নিজেই মানুষকে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী শিক্ষা দেই। আমি বলছি না যে, তুমি আল্লাহর ইবাদত করো না। কিন্তু আমরা যে খোদার উপাসনা করি তার ঘর নেই, জায়গা নেই, শরীর নেই, কাপড়-চোপড় নেই, হাত-পা নেই, মাথা নেই, পেট নেই, খাদ্যের প্রয়োজন নেই, অক্ষম ও অভাবী নন। তুমি এ সমস্ত কথা যা বলছো, যে কেউ তা বলবে সে কাপের হয়ে যাবে। সে ধর্ম থেকে খারেজ হয়ে যাবে। আল্লাহর তো কোন কিছুরই অভাব ও চাহিদা নেই।

নাসির মাহমুদ: মেষ পালক রাখাল এ কথা শুনে খুব পেয়ে গেল এবং লজ্জিত হয়ে বলল, তবে এই খোদা, যার তরে জীবন বিলিয়ে দিতে চাই সে কেমন মানুষ যে, তার কিছুই নেই, আবার কোনো কিছুর প্রয়োজনও নেই?

আকতার জাহান: মূসা (আ.) বললেন, আল্লাহ মানুষের মতো নন। এক অদ্বিতীয় খোদা সব কিছুর ঊর্ধ্বে ও সবার সেরা। কোনো কিছুই তার মতো নয়। খোদাকে চোখে দেখা যায় না। সবখানেই তিনি আছেন, তবে কোন কিছুর সাথেই মিশ্রিত নন, আবার কোনো কিছু থেকেই পৃথক নন। সব ক্ষমতা তার হাতেই। এই হচ্ছেন সেই খোদা আমরা যার ইবাদত বন্দেগী করি।

নাসির মাহমুদ: মেষ পালক বলল, যাও বাবা! আমি এসব কিছু বুঝি না। আমি আল্লাহকে ভালোবাসি, তার জন্য জান বিলিয়ে দেবো, তার খেদমত করতে চাই, তার পায়ের ধূলি আমার চোখে মাখবো। যাও যাও, তুমি আবার কোন ছার যে, আমাকে খোদা সম্পর্কে ভয় দেখাতে এসেছো?

আকতার জাহান: মূসা নবী বললেন, আরে বাবা আমি মূসা, আল্লাহর পয়গম্বর। আল্লাহ আমাদের কাছ থেকে ভালো কাজ চান। যদি খোদার খেদমত করতে চাও তাহলে মানুষের উপকার করো, কারো ক্ষতি করো না। খোদা এটাই চান। নিজের জন্য কিছুই চান না। কেউ আল্লাহকে দেখতেও পায় না। তুমি যে সব কথা বলেছো তা থেকে তওবা করো, আর এসব কথা বলো না, এসব কথায় গুনাহ হয়। আমার ভয় হচ্ছে, তুমি যেসব কথা বলছো তাতে আল্লাহর রাগ হবে এবং আল্লাহ আসমানী বালামুসিবত নাজিল করবেন, অগ্নি বৃষ্টি হবে হবে ও সৃষ্টিকে পুড়িয়ে মারবেন। যদি আরেকবার এ ধরনের কথা বলো ধর্ম থেকেই বিচ্যুৎ হয়ে যাবে এবং আল্লাহ তোমাকে অপছন্দ করবেন।

নাসির মাহমুদ: এসব কথা শুনে মেষ পালক ভয়ে ও অনুতাপে মাথা চাপড়াতে লাগল। নিজের জামা নিজেই ছিঁড়ে ফেলল। দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল এবং মুসার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কান্নারত অবস্থায় মরুভূমির দিকে ছুটে চলল এবং দেখতে দেখতে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আকতার জাহান: লোকটি চলে যাওয়ার পর হযরত মূসাও এ দুঃখজনক পরিস্থিতির কারণে কষ্ট পেলেন আর ভাবতে লাগলেন- কী করে এ ধরনের সহজ সরলমনা সাদাসিধে মানুষকে আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান দান করা যায়। তিনি খুবই বিচলিত হয়ে পড়লেন।

নাসির মাহমুদ: এমন সময় আল্লাহর তরফ থেকে মূসা নবীর কাছে ওহী নাজিল হলো। আল্লাহ তায়ালা বললেন: হে মূসা! তুমি তোমার এই আচরণ দিয়ে আমার বান্দাকে আমার কাছ থেকে দূর করে দিলে। তুমি এজন্যে নবী হয়েছো যে, লোকজনকে আমার নিকটবর্তী করবে, তাদের নিরাশ করার জন্য নয়। হে মূসা, আমি চাই মানুষ খোদার স্মরণ করুক ও তার উপর আশা-ভরসা রাখুক। শিক্ষিতরা ভালোভাবে কথাবার্তা বলতে পারে। কিন্তু সাদাসিধে অন্তরের মানুষেরও খোদার ইবাদত করা ফরজ। মানুষের আমল-আখলাক ভালো হওয়া চাই। উত্তম কথাবার্তা সবাই জানে না। অন্তর ও দীল আল্লাহর সাথে থাকলে বাকি কাজও ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোমাকে পাঠিয়েছি, তুমি মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানাবে এবং তাদের অন্তরকে ঈমানের নূরে আলোকিত করবে। এই মেষ পালক যাই করুক না কেনো আমার দোস্ত ছিলো এবং খোদার দিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলো। কিন্তু তুমি তার মন ভেঙ্গে দিয়েছো, হে মূসা।

আকতার জাহান: মহান আল্লাহর বাণী শুনে হযরত মূসা (আ.) লজ্জিত ও অনুতপ্ত হলেন। লজ্জা ও অনুতাপ তাকে ঘিরে ধরল আর সাথে সাথেই চললেন ঐ মেষ পালকের উদ্দেশ্যে। রাখাল যে পথে অদৃশ্য হয়েছেন সে পথে অনেক ছুটাছুটির পর শেষ পর্যন্ত তার দেখা পেলেন। তাকে বললেন, হে মেষ পালক! তুমি খুবই ভাগ্যবান। আল্লাহ্‌র তরফ থেকে নির্দেশ এসেছে। আমি তোমাকে শক্তভাবে বুঝিয়েছি, যাও এখন আর কোনো বাধা নেই।

হে মেষ পালক, তুমি খোদার সাথে থাকো, যেখানে যে অবস্থায়ই থাকো না কেন- খোদাকে স্মরণ করো। যে ভাষাতে যে কথাতেই খোদাকে ডাকো না কেন- খোদা তা কবুল করবেন। আল্লাহ্‌ সত্যকে চিনেন, নিয়তকে জানেন। তিনি তোমার দিলের পবিত্রতাকে পছন্দ করেছেন।

নাসির মাহমুদ: এসময় মেষ পালক আক্ষেপ করে বললেন: হে মূসা! আমার দফা-রফা হয়ে গেছে। আমি অনুতাপে এতোই ভস্মীভূত হয়েছি যে, যা জানতাম না তা জেনে গেছি। যে আল্লাহ সব কিছু জানেন তিনি আমার দীলের বর্তমান অবস্থাও ভালো করে জানেন। আমি জানি যে, আমার দীল আল্লাহ্‌র সাথে আছে, আমি গুনাহগার নই। আমার মুখ যদি সুন্দর সুন্দর কথা বলতে না জানে তাহলে এমুখ বন্ধই করে দেবো, আমার আর বলার কিছু নেই; ওয়াসসালাম।

আকতার জাহান: বন্ধুরা, এ গল্পটিতে যে বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে তা হলো, সত্যের অন্বেষণে কেউ যদি আন্তরিকতার সাথে, নিষ্ঠার সাথে মনোনিবেশ করে তাহলে বাহ্যিক কোনো নিয়ম-নীতির কাঠামো তার জন্য প্রতিবন্ধকতার আড়াল তৈরি করতে পারে না। একনিষ্ঠ অন্তর নিয়ে আল্লাহর সাথে সাদামাটা বা নিজের ভাষায় নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষা বা চাওয়া-পাওয়ার কথা বলা যায়। সর্বোপরি কথা হলো পবিত্র ও খালেস অন্তরের মধ্য দিয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য বা সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।

নাসির মাহমুদ: বন্ধুরা, আসরের এ পর্যায়ে তোমাদের জন্য রয়েছে একটি ইসলামী গান। 'আমাদের প্রাণে দাও তাকওয়া' শিরোনামের গানটির কথা ও সুর আবদুস সালামের। আর গেয়েছে সন্দীপন শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্যরা। 

আকতার জাহান: প্রার্থনামূলক গানটি শুনলে। এবার রয়েছে এ সম্পর্কেই একটি কবিতা। বেগম সুফিয়া কামালের লেখা প্রার্থনা কবিতাটি আবৃত্তি করেছে ছোট্টবন্ধু শীর্ষ চক্রবর্তী।

নাসির মাহমুদ: শীর্ষ চক্রবর্তীর চমৎকার উচ্চারণে কবিতাটি শুনলে। আশা করি তোমাদের ভালো লেগেছে। তো, বন্ধুরা, আমাদের হাতে আজ আর সময় নেই। তোমরা ভালো ও সুস্থ থেকো এ কামনা করে গুটিয়ে নিচ্ছি রংধনুর আজকের আসর।

আকতার জাহান: কথা হবে আবারো আগামী আসরে।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১২