সুঅভ্যাস গড়ার উপায় নিয়ে ধারাবাহিক
সুন্দর জীবন (পর্ব-২)
বাবা-মা যদি শিশুকালেই সন্তানের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ ও নিয়মানুবর্তিতার বীজ বপন করেন তাহলে কাজটি সহজ হয়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে শৈশবে সুশৃঙ্খল ও নিয়মানুবর্তী না হলে পরবর্তীতে এই অভ্যাসে পরিবর্তন আনা কঠিন হয়ে পড়ে।
এ সম্পর্কে পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য ইমাম হাসান আসকারি (আ.) বলেছেন, মানুষের অভ্যাসে পরিবর্তন আসা অনেকটা অলৌকিক ঘটনা ঘটার মতোই একটা বিষয়। সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য আপনাকে প্রথমেই যে কাজটি করতে হবে তাহলো রাগ বা ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পবিত্র ইসলাম ধর্মেও ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ধর্মীয় দৃষ্টিতে ক্রোধ নিন্দনীয়। শুধু তাই নয়, ক্রোধকে সব মন্দ কাজের উৎস হিসেবেও গণ্য করা হয়। আপনি নিজে সুশৃঙ্খল হতে চাইলেও ক্রোধের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করুন। তাহলে দেখবেন জীবনটা সহজেই সুশৃঙ্খল হয়ে উঠেছে। আপনি যদি আপনার সন্তানকে সুশৃঙ্খল ও নিয়মানুবর্তী করতে চান তাহলেও সন্তানকে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দিতে হবে।
সন্তানের মধ্যে সুঅভ্যাস গড়তে প্রয়োজনে দৃঢ় হতে হবে। কিছু বিষয় আছে যেগুলো পরিবর্তনের জন্য সন্তানকে বোঝাতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুটানা ভাব গ্রহণযোগ্য নয়। শৃঙ্খলাবোধ তৈরিতে অপর যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তাহলো, এ ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করা যাবে না। মনে রাখতে হবে একলাফে তা অর্জন সম্ভব নয়, সুঅভ্যাস গড়ে তুলতে পর্যাপ্ত সময় প্রয়োজন। মানব সমাজের সর্বোত্তম ও সবচেয়ে দক্ষ প্রশিক্ষক ছিলেন নবী-রাসূলেরা। তাঁরাও আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত সব নির্দেশ একসঙ্গে মানুষকে অবহিত করতেন না বরং ধাপে ধাপে কৌশল অবলম্বন করে তা মানুষের সামনে তুলে ধরতেন। সন্তানদের আচরণ ও অভ্যাসে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতি বেশি কার্যকর। শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার অস্তিত্ব মানুষের ভেতরেই রয়েছে। এই গুণকে প্রস্ফুটিত করতে এটার অনুশীলন জরুরি, ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। আমিরুল মুমিনিন হজরত আলী (আ.) এ সম্পর্কে বলেছেন- 'প্রথমে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, এরপর কাজ সমাপ্তির দিকে মনোযোগ দিতে হবে, দৃঢ়তা প্রদর্শন করতে হবে এবং ধৈর্য্য ধারণ করতে হবে।'
আমরা যদি শিশুর ভেতরে সুঅভ্যাস গড়ে তুলতে চাই তাহলে সব কিছুর আগে তার সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে বাবা-মায়ের সঙ্গে শিশুর ইতিবাচক ও স্থিতিশীল সম্পর্ক জরুরি। এ লক্ষ্যে প্রতিদিন শিশুকে সঙ্গে নিয়ে ভালো কিছু কাজ করতে হবে। আপনাকে শিশুর পছন্দের খেলা ও কাজগুলো চিহ্নিত করে এ ক্ষেত্রে তাদেরকে সময় দিতে হবে। তার সঙ্গে একজন খেলার সাথীর মতো আচরণ করতে হবে। এর মাধ্যমে ঘনিষ্ঠতা বাড়বে। স্বল্প সময়ের জন্য হলেও শিশুদের সঙ্গে সময় কাটানো জরুরি, তাদের সঙ্গে অভিন্ন আনন্দদায়ক মুহূর্ত অতিবাহিত করতে হবে। এর মাধ্যমে আন্তরিক সম্পর্ক জোরদার হবে। মনের মিল গড়ে তুলে শিশুর অনুভূতিতে প্রভাব ফেলতে হবে। তাকে শর্তহীনভাবে ভালোবাসতে হবে। এ লক্ষ্যে কথার মাধ্যমে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে হবে। সুন্দর, সুন্দর কথা বলতে হবে। যেমন আপনি আপনার সন্তানকে বলতে পারেন, দেখো, আমি বুঝতে পারছি তুমি রেগে আছো। কিন্তু আমি যা বলছি তার পুরোটা তোমার ভালোর জন্য। সন্তানকেও তার অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ দিন। তার মধ্যে যেন এই অনুভূতি জাগে যে, আপনি তাকে উপলব্ধি করতে পারছেন।
সন্তান যখন কাঙ্ক্ষিত আচরণ বা ভালো কাজ করবে, সেটা যত সামান্যই হোক, সেটাতে সঙ্গে সঙ্গে মনোযোগ দিতে হবে। ভালো কাজ ও কাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য পুরস্কৃত করার প্রবণতা শিশুদের সদাচারণ গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। যেমন আপনি আপনার সন্তানের প্রশংসা করতে পারেন, আদর বাড়িয়ে দিতে পারেন। একটু আদুরে দৃষ্টি, একটু হাসি, বুকে জড়িয়ে ধরা ও চুমু দেওয়ার মতো ছোটো ছোটো পদক্ষেপও সন্তানের জন্য বড় পুরষ্কার হিসেবে গণ্য হতে পারে। এছাড়া, মুখের ভাষা দিয়েও শিশুর আচরণে পরিবর্তন আনা সম্ভব। শিশুর সদাচরণের পুরস্কার হিসেবে তার প্রিয় খাবারগুলো তাকে দিতে পারেন, যেসব স্থানে ঘুরতে যেতে পছন্দ করে সেখানে নিয়ে যেতে পারেন। অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে পরিবর্তন আনার মাধ্যমেই গড়ে উঠবে সুঅভ্যাস। তবে এমনটি যেন না হয় যে, শিশুকে আগেভাগেই তার পছন্দের এমন কিছু দিয়ে দেওয়া যাতে সে তা পেয়ে নিজের আচরণে পরিবর্তন আনে এবং অসদাচারণ পরিহার করে। এর ফলে ফলাফল ভালো নাও হতে পারে। কোনো কাজ সম্পাদনের পর উৎসাহিত করতে পুরস্কার দেওয়া যেতে পারে।
শিশুর অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ পরিবর্তনে আরও অনেক পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। এর মধ্যে একটি হলো শিশুর বিশৃঙ্লখাপূর্ণ আচরণকে গুরুত্ব না দেওয়া। গুরুত্ব না দেওয়াটার পদ্ধতিটিও অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর। এই পদ্ধতি ঐসব শিশুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যারা কেবল অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নানা অপছন্দীয় ও অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ করে থাকে। শিশু অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের মাধ্যমে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণের যখনি চেষ্টা করবে তখনি সেটাকে এড়িয়ে যেতে হবে। এমন ভাব দেখাতে হবে যেন আপনি তা টেরই পাননি। এ ক্ষেত্রে যদি আপনি একটু আড় চোখে তাকান অথবা একটু বকা দেন তাহলে আপনার লক্ষ্য হাসিল হবে না। শিশুর অনাকাঙ্ক্ষিত অভ্যাসে পরিবর্তন আনার জন্য আরেকটি পদ্ধতি হলো, যখনি খুব বেশি অস্থির হয়ে উঠবে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করবে তখনি তাকে নীরব কোনো স্থানে নিয়ে কিছু সময় চেয়ারে বসিয়ে রাখতে হবে। এভাবে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বয়সের ভিত্তিতে সময় হিসেব করা যেতে পারে। দুই বছরের শিশুর জন্য দুই মিনিট, তিন বছরের শিশুর জন্য তিন মিনিট-এভাবে সময় নির্ধারণ করা যেতে পারে। শিশুকে হৈ-হুল্লোড়পূর্ণ পরিবেশের বাইরে নিয়ে গিয়ে তাকে শান্তভাবে বসিয়ে রাখতে হবে। তবে শিশুর চিল্লাচিল্লি বা প্রতিরোধের কারণে শান্ত রাখার সময়টা সংক্ষিপ্ত করা চলবে না।
এর আগেই যেমনটি বলেছি সুঅভ্যাস গড়তে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, আবেগের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করা যাবে না। শিশুর মধ্যে সুঅভ্যাসের শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রেও ক্রোধ ও আবেগ পরিহার জরুরি। শিশুকে যখন কোনো কিছু থেকে বঞ্চিত করা হয় তখন সে যেন এটা উপলব্ধি না করে যে, ক্ষোভ ও ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তার বাবা-মা তাকে এই অবস্থার মধ্যে ফেলেছে। কখনোই শিশুর সঙ্গে এমন আচরণ করা যাবে না যাতে সে ভাবে তাকে আপনি পছন্দ করেন না বা ভালোবাসেন না। এটাও যাতে না ভাবে যে, তার ব্যক্তিত্ব ও আচরণ একেবারেই অপছন্দীয়। তাকে এটা বোঝাতে হবে যে, আপনি কেবল তার ভুল আচরণ পছন্দ করেন না, কিন্তু তার অস্তিত্ব আপনার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাকে আপনি ভালোবাসেন, সে আপনার কাছে অনেক মূল্যবান। সব সময় মনে রাখবেন কোনো অবস্থাতেই শিশুকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা যাবে না।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/আবুসাঈদ/০৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।