সূরা ফাতহ : আয়াত ১০-১৩ (পর্ব-৩)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা ফাতহ 'র ৩য় পর্ব নিয়ে আলোচনা। আজ আমরা এই সূরার ১০ থেকে ১৩ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। এই সূরার ১০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
إِنَّ ٱلَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ ٱللَّهَ يَدُ ٱللَّهِ فَوۡقَ أَيۡدِيهِمۡۚ فَمَن نَّكَثَ فَإِنَّمَا يَنكُثُ عَلَىٰ نَفۡسِهِۦۖ وَمَنۡ أَوۡفَىٰ بِمَا عَٰهَدَ عَلَيۡهُ ٱللَّهَ فَسَيُؤۡتِيهِ أَجۡرًا عَظِيمٗا (10)
“[হে রাসূল!] যারা আপনার সঙ্গে বাইয়াত করে তারা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সঙ্গে বাইয়াত করে। তাদের হাতের উপর রয়েছে আল্লাহর হাত। সুতরাং যে চুক্তি ভঙ্গ করে সে তো ক্ষতি করে কেবল নিজেরই এবং যে আল্লাহর সঙ্গে কৃত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে আল্লাহ তাকে শীঘ্রই প্রদান করবেন মহাপুরস্কার। ” (৪৮:১০)
গত দুই আসরে আমরা মক্কার মুশরিকদের সঙ্গে রাসূলে খোদা (সা.)-এর স্বাক্ষরিত হুদায়বিয়া সন্ধি নিয়ে আলোচনা করেছি। ওই চুক্তি স্বাক্ষরের আগে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজের একজন সাহাবীকে এই বার্তা নিয়ে মক্কায় পাঠান যে, মুসলমানরা আল্লাহর ঘর জিয়ারতের জন্য মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন এবং তারা কোনো সংঘাতে জড়াতে চান না। মুশরিকরা ওই সাহাবীকে বন্দি করে। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, দূত হিসেবে পাঠানো সাহাবীকে মুশরিকরা হত্যা করেছে। এ সময় আল্লাহর রাসূল সাহাবীদের নিয়ে বৈঠকে বসেন এবং তাদের কাছ থেকে এই বাইয়াত বা প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেন যে, এই খবর সত্যি হলে মদিনায় ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে।
এই বাইয়াতের খবর মক্কায় পৌঁছালে তারা রাসূলের প্রতিনিধিকে মুক্ত করে দেয় এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিবর্তে তাদের সঙ্গে সন্ধি করতে সম্মত হয়। এ কারণে ইসলামের ইতিহাসে এই বাইয়াত একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। পবিত্র কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা এই বাইয়াত করার জন্য মুসলমানদের প্রতি নিজের সন্তুষ্টির কথা ঘোষণা করেন। এই আয়াতেও আল্লাহ পাক বলছেন: রাসূলের সঙ্গে বায়াত আল্লাহর সঙ্গে বাইয়াতেরই নামান্তর। এই বাইয়াতের সময় বাইয়াতকারীরা তাদের হাত রাসূলের হাতে রেখে শপথ গ্রহণ করেন। আল্লাহ বলছেন, তারা প্রকৃতপক্ষে তাদের হাত আল্লাহর হাতে রেখে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। আর এটা স্পষ্ট যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য করার জন্য আল্লাহরই সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় তার কাছ থেকে সে চুক্তি ভঙ্গের আশা করা যায় না। যদি ভঙ্গ করে তাহলে সে তার ঈমানের মস্তবড় ক্ষতি করল।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- আল্লাহর প্রতি ঈমানদার ব্যক্তিকে তাঁর দ্বীন রক্ষা ও আলেমদের প্রতি আনুগত্য করতে হবে। শত্রুর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আল্লাহর দ্বীন ও এর ধারক-বাহকদের রক্ষা করা ঈমানদারদের কর্তব্য।
২- যারা দ্বীন রক্ষা করার চেষ্টা করে এবং এ পথে অটল থাকে তারা আল্লাহ তায়ালার রহমতপ্রাপ্ত হয়।
৩- প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা ধর্মীয় দায়িত্ব পালনেরই নামান্তর। পক্ষান্তরে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা নিজের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।
সূরা ফাতহ ১১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
سَيَقُولُ لَكَ ٱلۡمُخَلَّفُونَ مِنَ ٱلۡأَعۡرَابِ شَغَلَتۡنَآ أَمۡوَٰلُنَا وَأَهۡلُونَا فَٱسۡتَغۡفِرۡ لَنَاۚ يَقُولُونَ بِأَلۡسِنَتِهِم مَّا لَيۡسَ فِي قُلُوبِهِمۡۚ قُلۡ فَمَن يَمۡلِكُ لَكُم مِّنَ ٱللَّهِ شَيًۡٔا إِنۡ أَرَادَ بِكُمۡ ضَرًّا أَوۡ أَرَادَ بِكُمۡ نَفۡعَۢاۚ بَلۡ كَانَ ٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ خَبِيرَۢا (11)
“শিগগিরই [যুদ্ধ থেকে] পিছিয়ে পড়া বেদুঈনরা আপনাকে বলবে- আমাদের ধন-সম্পদ আর পরিবার-পরিজন আমাদেরকে ব্যস্ত রেখেছিল, কাজেই [হে নবী] আপনি আমাদের জন্য [আল্লাহর কাছে] ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তারা মুখে এমন কথা বলে যা তাদের অন্তরে নেই। [তাদেরকে] বলে দিন, আল্লাহ তোমাদের কোন ক্ষতি বা কোন কল্যাণ করার ইচ্ছে করলে তাঁর বিপক্ষে তোমাদের জন্য কিছু করার ক্ষমতা কার আছে? [বরং] তোমরা যা করো সে বিষয়ে আল্লাহ সব সময় অবহিত থাকেন।” (৪৮:১১)
মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে রাসূলুল্লাহ (সা) মদিনার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাসরতদেরকে তাঁর সঙ্গে যাওয়ার আদেশ দেন। কিন্তু মক্কার মুশরিকদের সঙ্গে সংঘাতের আশংকায় তাদের অনেকে এই নির্দেশ পালন করেনি। পরবর্তীতে মুসলমানরা মদিনায় ফিরে আসলে যারা তাদের সঙ্গে যায়নি তারা রাসূলের কাছে এসে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং দাবি করে যে, দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততার কারণে তারা মক্কায় যেতে পারেনি। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা সঙ্গে সঙ্গে আয়াত নাজিল করে বিষয়টি তাঁর প্রিয় হাবিবকে জানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ বলছেন, এসব মানুষ মুখে যেসব অজুহাত তুলে ধরছে তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই।
এরপরে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলছেন, কৌশল করে জিহাদে যাওয়া থেকে বিরত থাকলেই যে তুমি প্রাণে বেঁচে থাকেবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এমন বহু মানুষ আছে যারা জিহাদ করে সুস্থ শরীরে ফিরে আসে আবার অনেক মানুষ এমন আছে যারা জিহাদে না গিয়ে ঘরে বসে থেকেও মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- পার্থিব জীবনের প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসার কারণে মানুষ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ থেকে বিরত থাকে।
২- গোনাহগার ব্যক্তিদের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দোয়া ও শাফায়াত আল্লাহর দরবারে কবুল হয়।
৩- আল্লাহর দ্বীন রক্ষা ও ধর্মীয় নেতৃত্বকে পৃষ্ঠপোষকতা করা অবশ্যপালনীয় কর্তব্য; তা করতে গিয়ে ক্ষতি ও বিপদের মুখে পড়তে হলেও তা মাথা পেতে নিতে হবে।
সূরা ফাতহ ১২ ও ১৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
بَلۡ ظَنَنتُمۡ أَن لَّن يَنقَلِبَ ٱلرَّسُولُ وَٱلۡمُؤۡمِنُونَ إِلَىٰٓ أَهۡلِيهِمۡ أَبَدٗا وَزُيِّنَ ذَٰلِكَ فِي قُلُوبِكُمۡ وَظَنَنتُمۡ ظَنَّ ٱلسَّوۡءِ وَكُنتُمۡ قَوۡمَۢا بُورٗا (12) وَمَن لَّمۡ يُؤۡمِنۢ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ فَإِنَّآ أَعۡتَدۡنَا لِلۡكَٰفِرِينَ سَعِيرٗا (13)
“বরং [তোমাদের এ অন্যায়ের কারণ ছিল এই যে] তোমরা ধারণা করেছিলে, রাসূল ও মু’মিনগণ কক্ষনো তাদের পরিবার পরিজনের [কাছে] ফিরে আসতে পারবে না, আর এই [ধারণাটা] তোমাদের মনে খুবই চমৎকার ক’রে দেয়া হয়েছিল। তোমরা বড়ই কু-ধারণা করেছিলে, [এবং এভাবে] তোমরা দুর্ভাগা সম্প্রদায়ে পরিণত হলে।” (৪৮:১২)
“আর যে কেউ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে না তবে [যে যেন জেনে রাখে] নিশ্চয় আমি কাফিরদের জন্য জ্বলন্ত আগুন প্রস্তুত রেখেছি।” (৪৮:১৩)
আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই দুই আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও মুসলমানদের সঙ্গী হওয়া থেকে কিছু মানুষের বিরত থাকার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, যারা রাসূলের আদেশ অমান্য করে মদিনায় থেকে গেছে তাদের এই সীমালঙ্ঘন তাদের পরিবার বা সম্পদপ্রীতি কিংবা দুনিয়াবি কাজের জন্য ছিল না; তাতে মুখে তারা যে দাবিই করুক না কেন। বরং আসল কারণ ছিল আল্লাহ মুসলমানদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সে ব্যাপারে তাদের ভুল ধারনা ও সংশয়। তারা ধারনা করেছিল, মুসলমানরা এবারের সফরে আর প্রাণ নিয়ে মদিনায় ফিরতে পারবে না। তারা ভেবেছিল, আল্লাহ তায়ালা তার নবীকে এই সফরে শত্রুদের হাতে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছেন। কাজেই এরকম বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে নবীর সঙ্গী হয়ে প্রাণটা না হারানোই ভালো। এ কারণেই তারা আল্লাহর দৃষ্টিতে দুর্ভাগা সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছিল। এ ধরনের কাজ শুধু দুর্বল ঈমানেরই পরিচায়ক নয় বরং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে কুফরিরও শামিল। আর কুফরির পরিণাম জ্বলন্ত আগুন ছাড়া আর কিছু নয়।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- আল্লাহ তায়ালা ও ধর্মীয় নেতাদের নির্দেশের বিপরীতে শুধুমাত্র দুনিয়াবি হিসাব-নিকাশ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না, বরং আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে তাঁর নির্দেশ পালনে নির্ভয়ে অগ্রসর হতে হবে।
২- আল্লাহর বান্দাদের প্রতি ভুল ধারনা পোষণ করা কবিরা গোনাহ। আর সে ভুল ধারণা যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি হয় তখন সে গোনাহের মাত্রা অনেক বেশি বেড়ে যায়।
৩- কখনো কখনো ভুল ধারণা ও সংশয় মানুষের মধ্যে এত বেশি প্রভাব ফেলে যে, সে আল্লাহর অবাধ্য হয়ে যায়।
৪- পরিবারের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ যেন আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে। কারণ সেক্ষেত্রে মানুষের ধ্বংস অনিবার্য।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ০৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।