ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (পর্ব-৯৮) : কৌশলগত ফাও উপত্যকার পতন
গত আসরে আমরা ইরাকের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি এবং দেশটির রক্ষণাত্মক অবস্থান থেকে আক্রমণাত্মক অবস্থানে চলে যাওয়া সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজ আমরা ইরাকি বাহিনীর হাতে কৌশলগত ফাও উপত্যকার পতন নিয়ে কথা বলব।
ইরাক একটানা ছয় বছর ইরানের হাত মার খাওয়ার পর এ বিষয়টি উপলব্ধি করে যে, যুদ্ধের ভারসাম্যে পরিবর্তন আনতে হলে নিজের সামরিক শক্তি বাড়াতে হবে। এ কারণে ১৯৮৭ সালে ইরাক নিজের সমর শক্তি বৃদ্ধি করার পাশাপাশি আত্মরক্ষামূলক অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে ইরানের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ওয়ালফাজর-১০ অভিযানে ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় হালাবজা শহর দখল করেন ইরানি যোদ্ধারা। কিন্তু ইরাকি বাহিনী তার কৌশল পরিবর্তন করে এই এলাকায় ইরানের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধে যায়নি। ইরাক বরং দক্ষিণ ফ্রন্টে- যেখানে ইরানের পক্ষ থেকে তেমন কোনো বাহিনী মোতায়েন রাখা হয়নি সেদিকে মনযোগ দেয়।
ইরানের পক্ষ থেকে যে ফ্রন্টে সংঘাতের আহ্বান জানানো হয়েছে সে ফ্রন্টে না গিয়ে ইরাকি বাহিনী ইরানের বিরুদ্ধে নতুন নতুন ফ্রন্ট খোলে। তারা ইরানের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূখণ্ডগুলোর ওপর হামলা চালায়। ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলীয় যে ফাও উপত্যকা কয়েক বছর ইরানের দখলে ছিল বাগদাদ এবার সেটি পুনরুদ্ধারে মনযোগী হয়। কিন্তু ইরাকি শাসক সাদ্দাম জানতেন যে, শুধুমাত্র সামরিক শক্তি দিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব নয় বরং আন্তর্জাতিক আইন লংঘন ও যুদ্ধাপরাধ করার মাধ্যমেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা যাবে। এ কারণে ফাও উপত্যকা পুনরুদ্ধারের প্রস্তুতির পাশাপাশি ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসে ইরাকি বাহিনী ইরানের বেসামরিক এলাকাগুলো লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা জোরদার করে এবং ব্যাপকভাবে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করতে থাকে।
সাদ্দাম বাহিনী ১৯৮৮ সালের ১ মার্চ থেকে একই বছরের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ইরানের শহরগুলোর উপর বিরতিহীনভাবে হামলা চালিয়ে যায়। এ সময় ইরাকি বাহিনী রাজধানী তেহরানে প্রায় ১০০ ক্ষেপণাস্ত্র এবং এদেশের অন্যান্য শহরে আরো প্রায় ১০০ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এসব হামলায় ইরানের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
এদিকে ফাও দ্বীপ পুনরুদ্ধারের অভিযানে ইরাকি শাসক সাদ্দামের একটি জায়গায় ভয় ছিল। আর তা হলো- ইরাকি বাহিনীর তুলনায় ইরানি যোদ্ধাদের অদম্য স্পৃহা ও সাহস। ইরানের ওপর ইরাক আগ্রাসন চালানোর এক বছরের মাথায় ইরান যে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিল তা সম্ভব হয়েছিল ইসলামি বিপ্লব ও মাতৃভূমি রক্ষা করার ক্ষেত্রে ইরাকি তরুণ সমাজের অদম্য বাসনা থেকে।
আমেরিকা সরাসরি ইরাকের পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ইরানি যোদ্ধাদের অভিযানের সামনে ইরাকি বাহিনী ঠিকমতো দাঁড়াতেই পারেনি। ফাও দ্বীপ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ইরাকি সেনারা যে যুদ্ধ শুরু করে তাতে আমেরিকা সামরিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতা না করলে কোনোভাবেই বিজয়ী হতে পারত না বাগদাদ। যুদ্ধ শেষ হওয়ার বেশ কয়েক বছর পর ইরাকের রিপাবলিকান গার্ড বাহিনীর পদস্থ ছয় কমান্ডার জানান, ফাও উপত্যকা পুনরুদ্ধারের অভিযানে মার্কিন সেনারা সরাসরি অংশগ্রহণ করে। সাদ্দাম বাহিনীর অন্যতম পদস্থ সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল লতিফ এ সম্পর্কে বলেন, ফাও পুনরুদ্ধারের অভিযান শুরুর কয়েক মাস আগে থেকে মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে বাগদাদের ঘনিষ্ঠতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, ফাও উপত্যকায় মূল যুদ্ধ শুরু হওয়ার ২৪ দিন আগে সেখানকার ইরানি সৈন্যদের অবস্থান ও গতিবিধি সংক্রান্ত সমস্ত গোয়েন্দা তথ্য ও স্যাটেলাইট ইমেজ আমাদের হাতে পৌঁছে যায়। এসব ছবি দেখে আমরা বুঝতে পারি ফাও উপত্যকায় ইরান সেনা সংখ্যা কমিয়েছে এবং সেখান থেকে বেশ কিছু সৈন্যকে সরিয়ে উত্তরাঞ্চলীয় হালাবজা দখলের অভিযানে কাজে লাগানো হয়েছে। এসব ছবি দেখে ইরাকি কমান্ডাররা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ইরানের হাত থেকে এই উপত্যকা সহজেই পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে। এই অভিযানে মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করার দায়িত্বে থাকা ইরাকি সেনা কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাকের বলেন, আমি এই অভিযানের ব্যাপারে শলাপরামর্শ করতে কুয়েত সফরে যাই। সেখানে আমেরিকা ও কুয়েতের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের এই চুক্তি হয় যে, কুয়েত তার একটি দ্বীপ এই অভিযানে আমাদেরকে ব্যবহার করতে দেবে। চুক্তি অনুযায়ী ওই দ্বীপে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইরাকি ও মার্কিন সেনাদের মোতায়েন করা হয়।
ফাও দ্বীপ পুনরুদ্ধারের অভিযানে ইরাকি বাহিনীর সাফল্য লাভের আরেকটি বড় কারণ ছিল তাদের পক্ষ থেকে নিরীহ ইরানি জনগণের ওপর ব্যাপক মাত্রায় রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ করা। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাকের এ সম্পর্কে বলেন, ১৯৮৮ সালের বসন্তে ইরানের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য কুয়েতের দু’টি বিমানবন্দর মার্কিন বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৯৮৮ সালের ১৮ এপ্রিল মার্কিন জঙ্গিবিমানগুলো ইরানি অবস্থানে বড় ধরনের বোমা হামলা চালায়। ইরানি যোদ্ধারা ফাও উপত্যকায় যাওয়ার জন্য আরভান্দ নদীর ওপর যে সেতু নির্মাণ করেছিল মার্কিন জঙ্গিবিমান থেকে প্রথমেই ওই সেতুতে বোমাবর্ষণ করা হয়। এ সময় প্রচণ্ড বোমা হামলার মধ্যেও ইরানি সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের যোদ্ধারা সেতুটি মেরামতের চেষ্টা চালিয়ে যান।
ইরাকি সেনাবাহিনীর আজিজ হাসান নামের আরেক সেনা কমান্ডার বলেন, ফাও দ্বীপ পুনরুদ্ধার না করা পর্যন্ত রাসায়নিক বোমা হামলা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার জনারেল হামুদ বলেন, বাস্তবতা হচ্ছে, আমেরিকা যদি সরাসরি আমাদের পক্ষে যুদ্ধ না করত তাহলে ইরানের কাছ থেকে ফাও দ্বীপ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হতো না। ১৯৮৮ সালের ১৮ এপ্রিল ইরাকি বাহিনী ইরানের কাছ থেকে ফাও উপত্যকা পুনরুদ্ধার করে।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ /২০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।