মার্চ ০৪, ২০২২ ২১:২৭ Asia/Dhaka

বর্তমান বিশ্বের দৃষ্টি রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের দিকে। চলছে যুদ্ধ ইউক্রেনে। এ সম্পর্কে রেডিও তেহরানকে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও জনপ্রিয় সাময়িকী 'সাপ্তাহিক'র সম্পাদক জনাব গোলাম মোর্তজা।

বিশিষ্ট এই সাংবাদিক বলেছেন, ছোট দেশের ওপর বড় দেশের আগ্রাসন, হামলা মেনে নেয়া যায় না। রাশিয়াকে এর দায় নিতে হবে যদিও রাশিয়ার দিক থেকে এই আগ্রাসনের যুক্তি আছে।

তিনি বলেন, বিশ্বের ছোট ছোট দেশগুলোকে সাধারণত সুপার পাওয়ারগুলো ব্যবহার করে থাকে। ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে আমেরিকাও ইউক্রেনকে ব্যবহার করেছে। রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর হামলা চালালে আমেরিকা এবং ইউরোপ এসে তার পক্ষে যুদ্ধ করবে না এটা ইউক্রেনের জানা উচিত ছিল। কিন্তু তারা দূরদৃষ্টি দিয়ে বিষয়টি দেখে নি এটি তাদের ভুল। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কখনও কোথায় কোনো সংকটের সমাধান করে নি। সমাধান করা তার কৌশল নয়।

রেডিও তেহরান: জনাব গোলাম মোর্তজা, দীর্ঘদিন রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনার পর শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে ইউক্রেন এবং রাশিয়া। এই যুদ্ধের জন্য কেউ রাশিয়াকে দোষারোপ করছেন আবার কেউ আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্রদেরকে দায়ী করছেন। আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

গোলাম মোর্তজা: দেখুন, একটি যুদ্ধ যখন হয় এবং সেই যুদ্ধে একটি বড় ও সামরিকভাবে শক্তিশালী দেশ  যখন একটি ছোট দেশকে আক্রমণ চালায় তখন সেই বড় দেশটিকে প্রাথমিকভাবে দায় দায়িত্ব নিতে হবে। আগ্রাসন চালানোর জন্য সেই বড় দেশটির হয়তো অনেকে যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে কিন্তু সেই যৌক্তিক কারণগুলোও হালকা হয়ে যায় যখন একটি দেশকে ধ্বংস করে দেয়া হয় কিংবা যুদ্ধে সেই দেশের সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করে দেয়া হয়। ফলে যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প পথে যাওয়া উচিত সেই বড় দেশটির বলে আমি মনে করি। আগ্রাসন চালানো, যুদ্ধ করা কিংবা দখল করা বড় শক্তির কাজ হতে পারে না। সেটাকে কোনো অবস্থাতেই মেনে নেয়া যায় না। প্রাথমিকভাবে রাশিয়ার মতো একটি সুপার পাওয়ার ইউক্রেনের মতো একটা ছোট দেশকে দখল করে নিচ্ছে, দেশটির উপর আগ্রাসন চালাচ্ছে সে হিসেবে খুব সাধারণভাবে এই দায় রাশিয়াকে নিতে হবে এবং রাশিয়ার ওপর দায় বর্তায়।

রেডিও তেহরান:  ইউক্রেনের ন্যাটো জোটে যোগ দেয়ার প্রশ্নে মূলত রাশিয়া এবং পাশ্চাত্যের মধ্যকার দ্বন্দ্বের জের হচ্ছে এই যুদ্ধ। কিন্তু ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য পদ পায় নি। আবার, রাশিয়ার মোকাবেলায় আমেরিকাসহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো সরাসরি এগিয়ে আসে নি। এ নিয়ে খোদ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে মাঝেমধ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে। আপনার কি মনে হয় এক্ষেত্রে আমেরিকা ও তার মিত্ররা ইউক্রেনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে?

গোলাম মোর্তজা: দেখুন, সব সময়ই আপনি খেয়াল করবেন ইউক্রেন কিংবা কোনো ছোটো দেশকে সব সময় সুপার পাওয়াররা ব্যবহার করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা যদি বলেন, তারা মূলত ব্যবহার করে। এই  জায়গাটিতে ইউক্রেনকে ন্যাটো জোটে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে অথবা ইউক্রেন নিজ থেকে  ন্যাটো জোটে যোগ দিতে চেয়েছে। এর দুটোই সত্যি। এখন ন্যাট জোটে ইউক্রেন যদি যোগ দিতে যায় তাহলে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া কি হবে  সেটা ইউক্রেনের জানা ছিল কারণ রাশিয়া কখনওই তা গোপন করে নি। অন্যদিকে ন্যাটো জোটে ইউক্রেনকে নিতে গেলে রাশিয়া কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো জোটের সবাই জানত। এও জানত রাশিয়া যদি আগ্রাসন চালায় বা রাশিয়া যদি ইউক্রেন আক্রমণ করে দেশটিকে দখল করে নেয় তখনও রাশিয়াকে ন্যাটো জোট আক্রমণ করবে না বা করতে পারত না, রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ করতে যাবে না। তার প্রধান কারণ হচ্ছে রাশিয়া যে সুপার পাওয়ার অর্থাৎ ন্যাটো জোটের সবগুলো দেশ মিলিয়ে যত পারমাণবিক অস্ত্র আছে শুধুমাত্র রাশিয়ার কাছে তারচেয়ে বেশি পরমাণু অস্ত্র আছে। সুতরাং রাশিয়া যখন আগ্রাসন চালাবে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপের কোনো দেশ রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ করতে যাবে না কারণ সেক্ষেত্রে পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে চলে যাবে, তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের দিকে যাবে।

তারা যে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ করতে যাবে না এটা তারা যেমন জানত ইউক্রেনেরও বিষয়টি বোঝা উচিত ছিল। কিন্তু ইউক্রেন অত দূরদৃষ্টি দিয়ে বুঝে উঠতে পারে নি অথবা তারা বুঝতে চায় নি। তারা মনে করেছিল যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপ আমার সঙ্গে আছে সে কারণে রাশিয়া আমাকে আক্রমণ করবে না বা করতে ভয় পাবে। কিন্তু পুতিনের মতো আগ্রাসী একনায়ক যে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের যে সাম্রাজ্য সেই সাম্রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করছে সেহেতু তার শক্তিমত্তা টিকিয়ে রাখার জন্য যেকোনো কিছু করা সম্ভব ছিল সেটা ইউক্রেন বুঝতে পারে নি। আর সেই জায়গা থেকে ইউক্রেনের একটি ভুল হয়েছে।

রেডিও তেহরান: আপনি বললেন, ইউক্রেন বুঝতে পারে নি। সেই জায়গা থেকে তার ভুল হয়েছে। তো রাশিয়ার দিক থেকে আপনি যদি দেখেন অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি রাশিয়ার অবস্থানকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

গোলাম মোর্তজা: রাশিয়া যে কাজটি করেছে সেই কাজটিকে কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করা যায় না। কিন্তু রাশিয়া এমন একটি কাজ করুক তেমনটি চেয়েছে আমেরিকা। রাশিয়াকে একধরনের দখলবাজ, যুদ্ধবাজ এমন পরিচিতি দিতে চেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সবকিছু মিলিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটকৌশলের শিকার হয়েছে ইউক্রেন। তাদের এবং ন্যাটো জোটের শিকার হয়েও রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালিয়েছে কিংবা আগ্রাসন চালাতে বাধ্য হয়েছে। তো রাশিয়া যাই করুক না রাশিয়ার এই অবস্থানকে মেনে নেয়া যায় না। পাশাপাশি এটাও মেনে নেওয়া যায় না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো জোটের সৈন্য, অস্ত্র-মিসাইল রাশিয়ার সীমান্ত ঘেষে থাকবে। সেখানে রাশিয়ার অবস্থানকে দুর্বল করার জন্য এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কৌশল করেছিল সেটা যে রাশিয়া মেনে নেবে না সেটি রাশিয়ার অবস্থান থেকে ঠিক আছে। কিন্তু আক্রমণ চালানো, অভিযান কিংবা আগ্রাসনটাকে আবার সমর্থন করা যায় না।

রেডিও তেহরান:  জনাব গোলাম মোর্তজা, সবশেষে আপনার কাছে জানতে চাইব, ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যকার যুদ্ধের ঘটনায় আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলো রাশিয়ার ওপর দফায় দফায় বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। আপনি কি মনে করেন এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে?

গোলাম মোর্তজা: দেখুন, প্রথমে দেখতে হবে সমস্যার সমাধান চাওয়া হচ্ছে কি না!  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ ইউক্রেন সমস্যার সমাধান চাচ্ছে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। তারা সমস্যাটা তৈরি করেছে। সারা পৃথিবীতে দেখুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোথাও সমস্যার সমাধান করে নি বরং সমস্যা তৈরি করে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এরকম একটা বেল্টে একটা সমস্যা তৈরি করল। এতে যেটা হবে এ অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি একটা সমস্যা থেকে যাবে। ইউরোপে আমেরিকার মিত্র জার্মানি এবং ফ্রান্স তারা যেভাবে রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা কৌশল হচ্ছে এই দেশগুলো যেন রাশিয়ার ওপর থেকে তাদের নির্ভরশীলতা কমাক কিংবা নির্ভরশীল না থাকুক। সেক্ষেত্রে এরকম একটা অস্থিতিশীলতা রাখতে পারলে রাশিয়ার ওপর ইউরোপের ঐসব দেশের নির্ভরশীলতাটা কমে যাবে। আমেরিকার এটা একটা কৌশল হতে পারে-সমস্যার সমধান করা তাদের কৌশল নয়। আমেরিকার আরেকটি কৌশল আছে এবং পৃথিবীর বহু দেশে তারা সেটি প্রয়োগ করেছে। যেমন ইউক্রেনেই দেখুন- সেখানে রাশিয়া আগ্রাসন চালিয়েছে সেখানে। যুদ্ধের প্রথম দুই দিনের মধ্যেই ইউক্রেনের শাসকরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে যে সাধারণ মানুষের হাতে অস্ত্র দিতে হবে। তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। তারমানে হচ্ছে সাধারণ জনমানুষের মধ্যে অস্ত্র পৌঁছে দেওয়া হলো। আরেকটি বিষয় আপনারা জানেন যে ইউক্রেনে যেমন দেশটির পক্ষে ইউক্রেনিয়রা যেমন আছেন তেমন রাশিয়ার পক্ষেও ইউক্রেনিয়রা আছেন। দুপক্ষ দুপক্ষকে অস্ত্র দেবে। এরমানে হচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে সেখানে অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে।  হয় রাশিয়া এখানে জয়ী হবে অথবা পরাজিত হবে, রাশিয়া হয় দীর্ঘমেয়াদে এখানে থাকবে অথবা  অল্প সময়ের মধ্যে তার অবস্থান পরিবর্তন করে এখান থেকে চলে যাবে। কিছু না কিছু একটা করবে। #

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৪

 

ট্যাগ