মার্চ ১০, ২০২২ ২১:২৭ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করার নানা ক্ষতিকর দিক এবং এই অভ্যাস থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা অন্যের সঙ্গে নিজের স্বামী বা স্ত্রীর তুলনার নেতিবাচক নানা দিক এবং এ থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে আলোচনা করব।

পবিত্র কুরআনের সূরা রুমের ২১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে আর এক নিদর্শন (হচ্ছে): তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা ওদের নিকট শান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করেছেন; নিশ্চয় চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে নিদর্শন আছে।"

স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহানুভূতির গুরুত্ব উপলব্ধি না করে অনেকেই অন্যদের সঙ্গে নিজেদের স্বামী বা স্ত্রীর তুলনা করে থাকেন। অনেকেই মনে করেন, এই উপায়ে তারা নিজেদের স্বামী বা স্ত্রীকে সংশোধন করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই পন্থাটি কোনোভাবেই ইতিবাচক নয় বরং ব্যাপক ক্ষতিকর। এই পন্থাটি দাম্পত্য সম্পর্কের ভয়ানক ক্ষতি করে। শুধু স্বামী-স্ত্রী নয় বরং পুরো পরিবারই তা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আজ আমরা এর কারণ এবং এ ধরণের অভ্যাস থেকে মুক্তির উপায় তুলে ধরার চেষ্টা করব। অন্যের সঙ্গে তুলনার মাধ্যমে আপনি আপনার স্বামী বা স্ত্রীর ব্যক্তিত্ব ও অনুভূতিতে আঘাত করছেন। এর ফলে আপনার জীবনসঙ্গীর আত্মবিশ্বাস কমতে শুরু করে।

অনেক গবেষক মনে করেন, স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে অন্যের সঙ্গে তুলনার প্রবণতা গড়ে ওঠে মূলত শিশুকাল থেকে। এটা তাদের মধ্যেই বেশি দেখা যায় যারা শিশুকালে সব সময় অন্যের সঙ্গে তুলনার শিকার হতেন। আর শিশুকালের এই ঘটনাগুলোর মধ্যদিয়েই তার মন-মগজে এই প্রবণতা খুঁটি গেড়ে বসে। এরপর বড় হয়ে সে নিজেই তুলনা করতে শুরু করে। এ ধরণের শিশুরা বড় হয়ে নিজের সব কিছুর সঙ্গে অন্যের তুলনা করতে শুরু করে। পেশা, বাসস্থান, এমনকি বাবা-মা ও স্ত্রী নিয়েও অন্যের সঙ্গে তুলনা চলে। এ ধরণের ব্যক্তি কখনোই নিজের জীবন-সংসার এমনকি পেশা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারে না। তারা সব সময় সর্বোত্তম ও শ্রেষ্ঠ হতে চায়। কিন্তু সবার পক্ষেই যে শ্রেষ্ঠ হওয়া সম্ভব নয় তা বুঝতে পারে না। নিজেদের স্বামী বা স্ত্রীর কারণেও এ ধরণের তুলনা করার প্রবণতা গড়ে উঠতে পারে। এটা হয় যখন স্বামী বা স্ত্রী সব সময় ভালোবাসা, মায়া-মমতা, যৌন সম্পর্ক  অথবা আর্থিক ক্ষেত্রে অপূর্ণতা অনুভব করতে থাকে। অনেকে আবার বাহ্যিক রূপ নিয়েও তুলনা করেন।

অন্যের সঙ্গে স্বামী বা স্ত্রীর বাহ্যিক রূপ নিয়ে তুলনা করার চেয়ে বড় ভুল দাম্পত্য জীবনে আর হতে পারে না। এই ভুল দাম্পত্য জীবনে অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে নিয়ে আসে। এর ফলে আপনার স্বামী বা স্ত্রীর আত্মবিশ্বাস ক্রমেই কমতে থাকে এবং পারস্পরিক আকর্ষণ মলিন হতে শুরু করে। মনে রাখবেন দাম্পত্য জীবনে বাহ্যিক রূপটাই শেষ কথা নয়। দাম্পত্য জীবনে যেটা বেশি প্রভাব ফেলে তাহলো পারস্পরিক সমঝোতা, বোঝাপড়া এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এছাড়া তুলনা করার কারণে আপনি নিজের অজান্তেই আপনার স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হারাতে থাকবেন। সম্পর্কের সব ক্ষেত্রে একটা শীতল ভাব চলে আসবে। এটা এমন পর্যায়ে যেতে পারে যে, আপনার সন্তান লালনপালনের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। এর ফলে স্বামী বা স্ত্রীর মনে এই ধারণার জন্ম নিতে পারে যে, তার স্বামী বা স্ত্রী তাকে পছন্দ করে না। এমন ধারণাও হতে পারে যে, বিয়ের পর থেকেই তার জীবনসঙ্গী তাকে মন থেকে মেনে নেয়নি এবং তার কাছে তিনি গুরুত্বহীন। এর ফলে সে হতাশায় ভুগতে পারে।

এর ফলে কখনো কখনো তার মধ্যে প্রতিশোধ প্রবণতার জন্ম হতে পারে। সুযোগ পেলেই ভুল ধরতে শুরু করে। এসবই পরিবারের ভেতরে ভাঙন ও অশান্তির কারণ। এটা এমনভাবে আঁকড়ে ধরতে থাকে যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রতিদিনই একটু একটু করে দূরত্ব বাড়তে থাকে। এছাড়া আর্থিক দিক থেকে তুলনা করলে স্বামী বা স্ত্রী ব্যাপক চাপ অনুভব করতে পারেন এবং এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে বড় ধরণের ঝুঁকি নিয়ে নিতে পারেন যা গোটা পরিবারের জন্যই ক্ষতিকর। এই অভ্যাস থেকে মুক্তি পেতে আপনাকে আগে আশা-প্রত্যাশার গণ্ডিটা ছোট করতে হবে। নিজের শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী আপনার আশা ও চাহিদাকে মূল্যায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে এ ক্ষেত্রে কাটছাট করে এগোতে হবে। আপনি যদি নিজের চাহিদা ও প্রত্যাশাকে সামর্থ্যের সঙ্গে সমন্বয় করে নেন তাহলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও মানসিক অশান্তি কমবে। অনেকের জীবনে সঠিক কোনো লক্ষ্য নেই। এ কারণে তারা তুলনা করতে থাকেন। মনে রাখতে হবে, প্রত্যেকের জীবন তার নিজের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ কারণে কখনোই অন্যের জীবনের সঙ্গে নিজের জীবনকে তুলনা করে দাম্পত্য সম্পর্ক নষ্ট করা উচিত নয়।

যখনই আপনার কাছে অন্যের স্ত্রী বা স্বামীকে তুলনামূলকভাবে ভালো মনে হবে অথবা আপনার মধ্যে তুলনা করার প্রবণতা দেখা দেবে তখনি যে বিষয়টি সামনে আনবেন তাহলো আপনি জেনেশুনেই বিয়ে করেছেন এবং প্রতিটি মানুষেরই ভালো-মন্দ উভয় দিকই রয়েছে। শুধু খারাপ দিকগুলোর ওপর ফোকাস করলে এবং সেগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে কষ্টের মাত্রা আরও বেড়ে যেতে পারে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার আরেকটি উপায় হলো, নিজের স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। সম্পর্কটা আরও জটিল হওয়ার আগেই আপনি নিজের ভালোবাসা ও সহানুভূতি প্রকাশ করুন। আপনি বলুন যে, তার পরিশ্রমের মর্যাদা সম্পর্কে আপনি অবহিত। আপনি যে তাকে ভালোবাসেন, পছন্দ করেন এবং আপনার কাছে যে তিনি যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা কথায় ও কাজে বোঝানোর চেষ্টা করুন। আপনার এসব কথা ও কাজ জীবনসঙ্গীকে আরও ভালো কাজে উৎসাহ যোগাবে, তার কর্মতৎপরতা আরও গতিশীল হবে।

কিন্তু আপনি যদি কেবল তুলনা করতে থাকেন তাহলে এর উল্টো ফল হতে পারে। দাম্পত্য সম্পর্কটা বিষিয়ে উঠতে পারে। বাস্তবতা হলো, মানুষের মন তার অজান্তেই অন্যের জীবনযাত্রার ইতিবাচক দিকগুলোর সঙ্গে নিজের জীবনের তুলনা করতে থাকে। যখনই অনুভব করবেন আপনার মধ্যে এমনটি হচ্ছে তখনি এটা থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। স্বামী বা স্ত্রীর ভালো দিকগুলো নিয়ে বেশি ভাবুন। অন্যকে নিয়ে ভাবার আগে নিজের জীবন নিয়ে ইতিবাচক চিন্তা করুন। কীভাবে আপনারা একসঙ্গে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবেন, কীভাবে কঠিন সময়গুলো মোকাবেলা করে সামনের দিকে এগোতে পারবেন- সেগুলো নিয়ে বেশি বেশি ভাবুন। দুজনের সুন্দর মুহূর্তগুলো স্মরণ করুন, সেগুলো নিয়ে ভাবুন। সুখস্মৃতিগুলো সামনে আনার চেষ্টা করুন।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/আবুসাঈদ/১০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ