মার্চ ২৩, ২০২২ ২১:১৮ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা সেমনান প্রদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত একটি শহর শাহরুদে গিয়েছিলাম। শাহরুদ শহরের কেন্দ্রিয় শহরের নামও শাহরুদ। শাহরুদ ইরানের পাথুরে কয়লার জন্য বিখ্যাত।

কয়লার পাশাপাশি চক, সিসা, দস্তা এবং ডেকোরেশনের উপযোগী পাথরও প্রচুর পরিমাণে মেলে। সর্বোপরি শাহরুদকে বিরল প্রজাতির বুনো পশুর অভয়ারণ্য বলা চলে। যাদুঘর ভবনটিকে মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের জন্য দোতলা বিশিষ্ট একটি ভবন হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল। সে সময় এর ফাউন্ডেশন ছিল চার শ আটষট্টি বর্গমিটার জায়গার ওপর। কাজার শাসনামলের শেষ দিককার স্থাপত্যশৈলীর আদলে তৈরি করা হয়েছিল ভবনটি।

উনিশ শ আটাশি খ্রিষ্টাব্দে ওই ভবনটি মেরামত করা হয় এবং সেমনান প্রদেশের প্রথম যাদুঘর হিসেবে কার্যক্রমের সূচনা করা হয়। প্রধানত দুটি বিভাগ রয়েছে এই যাদুঘরে। একটি পুরাতত্ত্ব বিভাগ অপরটি নৃতত্ত্ব বিভাগ। পুরাতত্ত্ব বিভাগটি রয়েছে প্রথম তলায়। এই বিভাগে  শাহরুদের ঐতিহাসিক টিলাগুলোর হাজার হাজার বছর আগেকার নিদর্শনাবলি স্থান পেয়েছে। সেইসাথে ইসলামি যুগের নিদর্শনগুলোও রাখা হয়েছে এই বিভাগে। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে নৃতত্ত্ব বিভাগ। এই বিভাগে শাহরুদের জনগণের জীবনযাপন সংশ্লিষ্ট বিচিত্র জিনিসপত্র যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে কৃষিকাজ ও পশুপালন বিষয়ক বিচিত্র নিদর্শন। মুহররমের তাজিয়া এবং পার্দে খনি বিষয়ক নিদর্শনাবলিও এই বিভাগে স্থান পেয়েছে। পার্দে খনি হলো বিশাল ক্যানভাসে কোনো ঐতিহাসিক ঘটনার চিত্র এঁকে ঝুলানো হয় এবং এবং বর্ণনাকারী ওইসব চিত্র ধরে ধরে ব্যাখ্যা দেন। এইসব নিদর্শন থেকে শাহরুদ অঞ্চলের জনগণের আকিদা-বিশ্বাসের বিষয়টি ফুটে ওঠে।

কাজার শাসনামলে শাহরুদ শহরটি ছিল প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। বারো শ আটত্রিশ হিজরিতে ব্রিটিশ পর্যটক ও বণিক জেমস বেলি ফ্রিজার শাহরুদকে সুবিন্যস্ত একটি শহর বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন: শাহরুদ বাজার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সকল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিশ্চিত করে। তার মানে এখানে সর্বপ্রকার পণ্য সামগ্রীই পাওয়া যায়। শাহরুদে ফলের বাগ-বাগিচা প্রচুর দেখতে পাওয়া যায়। কৃষিজ পণ্যের দিক থেকেও বেশ সমৃদ্ধ এই শহর। শাহরুদের আশেপাশের গ্রামগুলো বেশ জনবহুল।শাহরুদের অপর একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে এই শহরের জামে মসজিদের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এই মসজিদটি এইলখনি শাসনামলের। একটিমাত্র ঝুলবারান্দা সম্পন্ন মসজিদগুলোর একটি হলো শাহরুদ জামে মসজিদ। মসজিদে একটি আঙিনা এবং একটি বড় শাবেস্তান ছাড়াও দুটি শাখা শাবেস্তান রয়েছে। আরও আছে পানির হাউজ। মসজিদের গম্বুজ ইরানি ডিজাইনেই করা হয়েছে। একটা সময় এই মসজিদে চারটি মেহরার ছিল। মূল মসজিদের কাঠামো কালের পরিক্রমায় নতুন নতুন শাসকদের সময় ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।

বলা বাহুল্য, নতুন কাঠামোয় বলতে গেলে প্রাচীন মসজিদের চোখে পড়ার মতো কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। শাহরুদ জামে মসজিদ উনিশ শ সাতানব্বুই খ্রিষ্টাব্দে ইরানের একটি ঐতিহ্যবাহী ও মূল্যবান নিদর্শন হিসেবে জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে।

প্রাকৃতিক নিদর্শনের জন্য শাহরুদের একটা বিশেষ অবস্থান ও মর্যাদা রয়েছে। আপনারা জানেন যে আসরের সময় সীমিত সুতরাং এখানকার বেশিরভাগ প্রাকৃতিক নিদর্শনের সঙ্গেই পরিচিত হবার সুযোগ নেই। তবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নিদর্শন অবশ্যই ঘুরে ফিরে দেখবো আমরা। প্রথমেই প্রাকৃতিক বনাঞ্চল 'আব্র জঙ্গল'-এ যাওয়া যাক। আব্র ফার্সি শব্দ। এর অর্থ হলো মেঘ। আব্র জঙ্গল মানে মেঘ-বন।

শাহরুদ শহর থেকে সেমনান প্রদেশের ভেতরই পঞ্চাশ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বদিকে গেলে সর্পিল আঁকাবাঁকা একটা রাস্তা পড়বে। ওই রাস্তাটি পার হলেই পড়বে আব্র জঙ্গল। আবর নামে একটি গ্রাম আছে এখানে। এখানে বলতে শাহরুদ মহাসড়ক ধরে গোলেস্তান প্রদেশের অজদ শহরের দিকে যেতে আবর নামক সেই গ্রামে পড়েছে সবুজ শ্যামল এই বনটি। বনটি বেশিরভাগ সময়ই মেঘে ঢাকা থাকে বলে এরকম নামকরণ করা হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই বনের উচ্চতা, একইসঙ্গে গরমের সময়ও তাপমাত্রা কম থাকা এবং অসংখ্য ফোয়ারা আর বিচিত্র জঙ্গলে আকীর্ণ হওয়া এই আব্র জঙ্গলের বৈশিষ্ট্য।

পঁয়ত্রিশ হাজার কিলোমিটার এই বনের আয়তন। বিশ্বের হিরকানিয়ান বনের ধ্বংসাবশেষ বলে আব্র জঙ্গলের কথা বলা হয়। মনে রাখা দরকার যে হিরকানি জঙ্গলগুলো জুরাসিক যুগের নিদর্শন। বরফ যুগেও এই বনগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় নি। এ কারণে আব্র জঙ্গলের গুরুত্ব আগের তুলনায় অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনটি কারণে এই জঙ্গলটির বৈশ্বিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। প্রথমত, এই জঙ্গলের একটা বিভাগ প্রাচীন হিরকানি জঙ্গলের অংশ। তাছাড়া এই জঙ্গলে পাওয়া যায় নজিরবিহীন ও দুর্লভ কিছু ওষুধি উদ্ভিদ। দ্বিতীয়ত, জঙ্গলের ভৌগোলিক অবস্থান। আব্‌র জঙ্গল দুই ধরনের ইকোসিস্টেম অঞ্চলের মাঝখানে পড়েছে। একটা অংশ অর্ধমরু অঞ্চল অপরটি বনাঞ্চল। আর তৃতীয়ত, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে দুটি নিচু ও উঁচু এলাকা একে অপরের পাশে থাকায়  এ অঞ্চলে প্রচণ্ড মেঘ জমতে দেখা যায়। এটা বিশ্বে অনন্য একটি ঘটনা।

এটা বিশ্বে অনন্য একটি ঘটনা। বিশাল আকারের সবুজ বন এবং এই সবুজ বনের সাথে সাদা মেঘের সম্মিলনে এতো চমৎকার ও মনোরম দৃশ্য তৈরি হয় যে ওই দৃশ্য দেখে প্রত্যেক পর্যটকই হতবাক হয়ে যান। বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রাণীকুলের অস্তিত্বের কারণে আব্‌র জঙ্গল এক শ চৌদ্দতম প্রাকৃতিক নিদর্শনের মর্যাদা লাভ করেছে। ফেব্রুয়ারি দুই হাজার উনিশ খ্রিষ্টাব্দে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পর্যটন সংস্থা এই বনকে ইরানের প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত করেছে#  

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।