এপ্রিল ০৫, ২০২২ ১৯:২৯ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা অন্যদের সঙ্গে নিজের ছেলে-মেয়েদের তুলনা করার নানা ক্ষতিকর দিক নিয়ে খানিকটা আলোচনা করেছি। আজকের আসরে আমরা নিজেকে চেনা ও জানার গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করব।

বাবা-মায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে সন্তানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা এবং স্বাধীনচেতা মনোভাব শানিত করা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কোনো কোনো বাবা-মা নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা সন্তানদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চালান। এর ফলে শিশুরা বাড়তি চাপ অনুভব করে। মনে রাখা দরকার- সন্তানেরা জড় কোনো বস্তু নয়। তারা অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো উপাদানও নয়। সন্তান হচ্ছে ঐশী উপহার, বাবা-মায়ের ভালোবাসার ফসল। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার জন্য বাবা-মা কখনোই অভিযোগ করার অধিকার রাখে না। মনে রাখবেন, আপনার প্রত্যেক সন্তান আলাদা সত্তা। আপনার সন্তানদের সবাই একই রকম হবে অথবা অন্যদের সন্তানের মতো হবে এমন কোনো কথা নেই। একইসঙ্গে এমন নিশ্চয়তাও নেই যে, আপনার সন্তান চিরদিন আপনার সঙ্গে থাকবে এবং আপনার নীতি অনুসরণ করে জীবনযাপন করবে। বাবা-মা আরেকটি দায়িত্ব হলো, তার সন্তানদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখা। কিন্তু বাবা-মা যখন অন্যের সঙ্গে সন্তানের তুলনা করেন তখন তাদের মধ্যে নানা মানসিক ও শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।

বাবা-মায়ের উচিত অন্যের সঙ্গে সন্তানের তুলনা না করে বাস্তবতাকে মেনে নেয়া। এটা মনে রাখা জরুরি, দুই জন মানুষকে তুলনা করা এবং একজনের কোনো দুর্বলতা বা ঘাটতির কারণে তাকে অপমান করা উচিৎ নয়। প্রত্যেক মানুষকে তার বেড়ে ওঠার পরিবেশ-পরিস্থিতি, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সংস্কৃতি, সুযোগ-সুবিধা, মেধা, সামর্থ্য এবং তার অতীতের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে। সন্তানদেরকেও এই শিক্ষা দিতে হবে যে, তারা যেন অন্যের সঙ্গে নিজের তুলনা এবং প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হয়ে নিজেকে চিনতে ও জানতে শেখে। তারা যেন নিজেদের মেধা ও সামর্থ্য অনুযায়ী লক্ষ্য স্থির করে ভালো ও সফল মানুষ হওয়ার চেষ্টা চালায়। অন্যদের চেয়ে ভালো ও সফল হতে হবে অথবা অন্যদের পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে-এমন চিন্তা যেন সন্তানের মনে জায়গা করতে না পারে সেই চেষ্টা করতে হবে।

নিজের সার্বিক উন্নয়ন ঘটানো প্রতিটি মানুষেরই দায়িত্ব। তবে এর অর্থ এই নয় যে, অন্যের তুলনায় বেশি উন্নতি করতে হবে। এর মানে হচ্ছে, নিজের শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী উন্নতি ঘটাতে হবে। গতকালের চেয়ে আজ আরও একটু অগ্রগামী হতে হবে। আরও সহজ করে বলা যায়, তুলনাটা হতে পারে গতকালের সঙ্গে আজকের। কেবল তুলনাটা চলতে পারে নিজের সঙ্গেই। নিজের অগ্রগতির তুলনা নিজের সঙ্গে করলে সক্ষমতা ও দুর্বলতা সম্পর্কে জানা যায়। এরই ধারাবাহিকতায় মানুষ অতুলনীয় হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু কেউ যখন অন্যের সঙ্গে তুলনা করতে থাকে তখন সে ক্রমেই হিংসুক হয়ে ওঠে।  শুধু সন্তান নয়, পৃথিবীতে কারো সঙ্গেই কারোর তুলনা করা ঠিক নয়। কারণ প্রত্যেক মানুষই সম্পূর্ণ আলাদা ও অনন্য। সবাই সবদিকে সমান হবে না এটাই স্বাভাবিক। একেকজন একেকদিক দিয়ে পারদর্শী হবে। সব সময় মনে রাখতে হবে, সন্তানকে কারো সঙ্গে তুলনা করলে তার আত্মবিশ্বাস কমে যায়। নিজেকে অযোগ্য ও দুর্বল ভাবতে শুরু করে। নিজের জীবনের প্রতি খেয়াল না রেখে অন্যের জীবনে পড়ে থাকে। অপরের চিন্তাভাবনা, কাজকর্মকে অনুসরণ করে। এতে নিজের স্বকীয়তাকে হারিয়ে ফেলে। সবাইকে তার প্রতিযোগী মনে করে। সরল দুনিয়াটাকে জটিল বানিয়ে ফেলে।

 সুস্থ সমাজের জন্য সুস্থ মানুষ দরকার। সমাজের সুস্থতার বিষয়টি ঐ সমাজের মানুষের সুস্থতার ওপরই নির্ভর করে। বাবা অথবা মা হওয়া কোনো প্রতিযোগিতার বিষয় নয় এবং অন্যদের সামনে এটা তুলে ধরার কোনো প্রয়োজন নেই যে, আপনার সন্তানেরা অন্যদের চেয়ে অনেক ভালো। বাবা-মাকেও ভাবতে হবে তুলনা না করে কীভাবে সন্তানের উন্নতি নিশ্চিত করা যায়। এমন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে যার কোনো নেতিবাচক প্রভাব নেই বরং এর মাধ্যমে সন্তানের উন্নতি ও অগ্রগতি নিশ্চিত হয়। যেমন সন্তানের বিকাশ ও উন্নতি নিশ্চিত করার একটি উপায় হলো, সন্তানের ভালো কাজের প্রশংসা করা। তার অর্জিত সাফল্যটা খুব সামান্য হলেও তাদের প্রশংসা করুন। এর ফলে সন্তানের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। সন্তানদেরকে তাদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সহযোগিতা করুন, তাদেরকে সব সময় ভালো কাজে উৎসাহ যোগান। তাদের সহযোগিতার প্রয়োজন হলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। মনে রাখবেন, সন্তানদের কাছে এমন কিছু প্রত্যাশা করবেন না যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। বিনাশর্তে সন্তানদের ভালোবাসতে শিখুন। এই পদ্ধতিটি তাদের উন্নতি-অগ্রগতিতে অনেক প্রভাব ফেলবে।

বাবা-মা অথবা অভিভাবকদের সব সময় আরেকটি বিষয় মনে রাখা দরকার আর তাহলো, মানব বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো শিশুকাল। এই সময় সন্তানকে যা শেখানো হয় তাই শেখে। ভবিষ্যতে একটি সুস্থ ও সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে শিশুদেরকে সুস্থ ও সুন্দর মনের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শিশুর মানসিক বিকাশের এই পর্যায়ে সবসময় ইতিবাচক কথা বলতে হবে। শিশু কোনো ভুল করলে অনেক বাবা-মা জিজ্ঞেস করেন, তুমি এটি কার কাছ থেকে শিখেছ? এমন প্রশ্ন করা যাবে না। তাহলে শিশু অন্যের ওপরে দোষ চাপিয়ে দিতে পারে, মিথ্যা কথা বলা শিখতে পারে। আর এই বদঅভ্যাস সারা জীবন থেকে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিশুর কাছে প্রশ্ন করা যেতে পারে, তুমি এটা কেন করেছ? এর ফলে সন্তানেরা ভুল স্বীকার করে নেবে এবং সত্য কথা বলা শিখবে। তখন তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে, যে কাজটি করেছ তা ভালো কাজ নয়। এটা আর করো না। এই বাস্তবতাও মেনে নিতে হবে যে, শিশু-সন্তানদের চিন্তা ও বোধশক্তি পরিপক্ব নয়। এ কারণে তাদের ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে। বাবা-মা তথা অভিভাবকদেরকে অবশ্যই ধৈর্যশীল হতে হবে।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/আবুসাঈদ/০৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ