এপ্রিল ০৯, ২০২২ ১৫:৪৪ Asia/Dhaka

মহান আল্লাহ বিশ্বের প্রায় সব কিছুই জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। প্রায় সব জীবেরই রয়েছে স্ত্রী ও পুরুষ-শ্রেণী। এমনকি শক্তি, সময় ও বস্তু-জগতেও রয়েছে জোড়ার অস্তিত্ব। যেমন, ধনাত্মক ও ঋণাত্মক বিদ্যুত, রাত ও দিন, আকাশ ও জমিন ইত্যাদি।

নারী ও পুরুষের সম্মিলনে গড়ে ওঠা পরিবার মানবীয় পূর্ণতারই অপরিহার্য অংশ। ইরানের বিশ্বখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের লেখায়ও পরিবার-ব্যবস্থার গুণগান দেখা যায়। যেমন, মাওলানা রুমি লিখেছেন:

নর ও নারীতে দিয়েছেন কামনা স্রষ্টা শেষ দিন পর্যন্ত

যাতে টিকে থাকে তাদের মিলনে বিশ্ব-মানব-প্রজন্ম

ইরানের জাতীয় কবি ফেরদৌসিরও এক কবিতার ভাবার্থ হল এই যে কেবল মহান আল্লাহই শরিক বা জোড়াবিহীন। আল্লাহ সব কিছু সৃষ্টি করেছেন জোড়ায় জোড়ায়। তিনি গুপ্ত রহস্য থেকে গড়েন উন্মুক্ততা। এ বিশ্ব-জগতে তুমি যদি জোড়ার মধ্যে না থাক তাহলে তোমার শক্তিমত্তা গোপন থেকে যাবে তথা প্রতিভার স্ফুরণ ঘটবে না।

বর্তমান যুগে ইরানের পরিবার ব্যবস্থার একটি বৈশিষ্ট্য হল পরিবারগুলো এখন পুরুষের একক কর্তৃত্ব-ভিত্তিক নয়। একমাত্র পুরুষই আর পরিবারের প্রধান স্তম্ভ নয়। ইরানের বিপুল সংখ্যক নারী এখন চাকুরিজীবি। জীবন-রীতিতে পরিবর্তন আসার ফলে ইরানি নারীরাও এখন মালিকানায় এক গুরুত্বপূর্ণ অংশের অধিকারী এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও অতীতের তুলনায় অনেক বেশি কর্তৃত্বের অধিকারী।  ইরানি পরিবারে এখন নারী ও পুরুষের জগত পরস্পরের অনেক কাছাকাছি।  নারীর স্বার্থ বিষয়ক আলোচনা এখন পুরুষের স্বার্থের কাছাকাছি পর্যায়ে গুরুত্ব পাচ্ছে। ফলে পরিবারগুলোতেও পড়ছে এসবের প্রভাব।

ইরানের পরিবার ব্যবস্থার পরিবর্তিত রূপ সম্পর্কে দেশটির বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ডক্টর সাজ্জাদ উজাগলুর মতে: সামাজিক মূল্যবোধে পরিবর্তন ও নগরায়ন বা শহরায়নের প্রভাবে ইরানি সমাজে বদলে গেছে অনেক মূল্যবোধ এবং নারী ও পুরুষের সম্পর্কের সীমাবদ্ধতাও কমে গেছে। ফলে ইরানিদের আচার-আচরণের মডেলেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ইরানিদের বিয়ের রীতিতেও পড়েছে এর প্রভাব। বিশ্বজুড়ে বিশ্বায়নের যে প্রভাব তারই ধাক্কা লেগেছে ইরানি পরিবারেও। ফলে পরিবার ও সমাজে ব্যাপক মাত্রায় বদলে গেছে ইরানি নারীদের ঐতিহ্যবাহী ভূমিকা। ইরানি নারীদের মধ্যে দেখা যায় নতুন নানা দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিবার আর সমাজের নানা ক্ষেত্রে প্রতিরোধকামিতা। গত এক বা দুই দশকে ইরানি নারীরা পরিবার ও বিয়ে সংক্রান্ত মূল্যবোধ পরিবর্তনের উৎস হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। ইরানি নারীদের পেশায় এসেছে পরিবর্তন। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বদলে গেছে ইরানি নারী। তারা এখন কেবলই গৃহিনী নন। তারা অর্জন করছেন নতুন পরিচিতি।

সাজ্জাদ উজাগলুর মতে, ইরানি নারীদের মধ্যে অতীতের তুলনায় শিক্ষার হার অনেক বেড়েছে, ফলে বেড়েছে তাদের মধ্যে সচেতনতা। নানা ধরনের নতুন যোগাযোগ মাধ্যম তাদের জীবনযাত্রার রীতিতে এনেছে পরিবর্তন। বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইরানি নারীদের ব্যাপক উপস্থিতি বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের সাংস্কৃতিক পুঁজি। ফলে এখন আর কম বয়সে ইরানি মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে না। তবে ইরানি নারী সমাজের মধ্যে সামাজিক পরিবর্তনের উৎস ও প্রকৃতি পশ্চিমা বিশ্বের মত নয়। বিশ্ব জুড়ে পরিবর্তনের যে জোয়ার তাতে পুরোপুরি গা ভাসিয়ে দেয়নি ইরানি নারী সমাজ। ইরানি নারীরা এখনও পরিবার গঠন, মাতৃত্ব ও স্বামীর দেখাশুনাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন।

ইরানের বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী সাজ্জাদ উজাগলু'র মতে ইরানি পরিবার আর সমাজের বাহ্যিক চেহারায় আধুনিকতার অনেক প্রভাব দেখা যায়। ইরানের স্থাপত্য-রীতি, আধুনিক শহর প্রতিষ্ঠা, নতুন নতুন সামাজিক প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা ও এমনকি খাদ্য ও পোশাকের মত নানা খাতেও আধুনিকতার ছাপ পড়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও উজাগলুর মতে পুরোপুরি পশ্চিমা আধুনিক সমাজের মত হয়ে যায়নি ইরানি সমাজ। ইরানিরা যেমন আধুনিকতার অনেক কিছু নিয়েছে তেমনি ঐতিহ্যবাহী রীতিগুলোরও অনেক কিছু ধরে রেখেছে। তাই সাজ্জাদ উজাগলু'র মতে ইরানি পরিবারগুলোকে আধা-আধুনিক ও আধা ঐতিহ্যবাহী পরিবার বলা যায়। তার মতে ইরানিদের বিয়ের প্রথায় ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মাধ্যমে বিশ্বায়নের যেমন নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায় তেমনি ধার্মিকতার ইতিবাচক নানা প্রভাবও দেখা যায়। তবে সামগ্রিকভাবে ইরানি পরিবারে বিয়ের গুরুত্ব অতীতের তুলনায় কমে গেছে। বিশ্বের অনেক দেশের মত ইরানেও পরিবার প্রথায় বিয়ের গুরুত্ব কমে গেছে এবং তালাকের প্রথা সহজ হয়ে গেছে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ভূমিকা বদলে গেছে, তবে ইসলামী শিক্ষার প্রভাবে ইরানের ধার্মিক মহলে বিয়ের গুরুত্ব বেড়েছে এবং যারা যত বেশি ধার্মিক তাদের মধ্যে এর গুরুত্বও তত বেশি।

ইরানের ঐতিহ্যবাহী পরিবারে বড় হওয়া অনেক নারী উচ্চ শিক্ষিত হয়েও ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রবাদী হয়ে ওঠেননি। বর্তমান বিশ্বে জীবনের অনেক বাহ্যিক দিকে পরিবর্তন আসা সত্ত্বেও তারা মনে করেন নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরে রাখতে হবে। তাই তারা বিয়ে করাকে গুরুত্ব দেন যাতে জীবনে পূর্ণতা আসে ও একইসঙ্গে পরিবারকে মানবীয় অনুভূতির গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এভাবে পাশ্চাত্যের বিশ্বায়ন সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি ইরানি নারীদের পুরোপুরি হজম করে ফেলেনি।

এবারে সংসারকে সুখময় করার কয়েকটি সংক্ষিপ্ত টিপস তুলে ধরছি: যেসব বই বা চলচ্চিত্রে নারীকে বা পুরুষকে হেয় করা হয় ও স্বার্থপরতাকে গুরুত্ব দেয়া হয় সেসব বর্জন করুন বা সেসব থেকে দূরে থাকুন।

- নানা অজুহাতে স্ত্রী বা স্বামীর প্রতি আপনার ভালবাসা বা অনুরাগের কথা বার বার প্রকাশ করুন। অনুরাগ প্রকাশের পাশাপাশি পরস্পরকে শ্রদ্ধা করুন।  

-বিয়ের সময়ে তোলা ছবি ও ফিল্মগুলো মাঝে মধ্যে স্ত্রীকে নিয়ে একসঙ্গে দেখুন।

সবশেষে মহানবীর দুটি হাদিস শুনিয়ে শেষ করব আজকের আলোচনা। তিনি বলেছেন, আমার উম্মতের মধ্যে তারাই সবচেয়ে ভালো পুরুষ যারা পরিবারের সদস্যদের প্রতি কর্কশ ও অহংকারী নন বরং তাদের প্রতি স্নেহশীল, দয়ার্দ্র এবং তাদের পীড়া দেন না। তিনি আরও বলেছেন, যারা মুসলমানকে সম্মান করে বা সমাদর করে তারা যেন আল্লাহকেই সম্মান বা সমাদর করল।#

পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/ ০৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ