রমজান: আত্মশুদ্ধির মহোৎসব (পর্ব-৮)
রমজানের রোজা ভালো কাজে সকাল সাঁঝে/আমল করে পূর্ণ হৃদের কানন মায়ার বাঁধন/অহং হল চূর্ণ। (আবদুল হাকিম)
পবিত্র রমজানে পাপ ও ভুল পথ আর ভুল চিন্তা থেকে দূরে থাকার জন্য জ্ঞান চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবেই বর্তমান যুগেও ইসলামের শত্রুদের কারসাজিতে গড়ে উঠেছে সেই অতীতের খারিজি এবং ইয়াজিদি গোষ্ঠীর মতই চরম বিভ্রান্ত, ধর্মান্ধ ও চরম হিংস্র বা মনুষ্যত্বহীন নানা গোষ্ঠী। একদল সরলমনা মুসলমান এইসব জঙ্গি গোষ্ঠীকে সমর্থন করে ভাবছেন যে তারা ইসলামেরই সেবা করছেন! ইসলামের এ জাতীয় বোকা বন্ধুরা ইসলাম ও মুসলমানদের যত ক্ষতি করেছে, ইসলামের প্রকাশ্য শত্রুরাও ততটা ক্ষতি করতে পারেনি। আমরা অনেকেই হয়তো জানিনা লন্ডনের গোপন মাদ্রাসায় অমুসলিম ছাত্রদেরকে বড় বড় মাওলানা হওয়ার মত যোগ্যতা-সম্পন্ন হওয়ার প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে মুসলিম বিশ্বে পাঠানো হয় ইসলামের নামে নানা বিকৃত মতবাদ প্রচারের লক্ষ্যে।
যুগে যুগে মহান নবী-রাসূল এবং তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরির মিশনই ছিল মানুষকে প্রকৃত মানুষে পরিণত করা ও মহান আল্লাহর যোগ্য প্রতিনিধি হিসেবে তাদেরকে গড়ে তোলা। বিবেক আর জ্ঞানের বাতি জ্বালিয়ে তারা মানুষকে দেখাতে চেয়েছেন সুপথ। মানুষ যখন পুরোপুরি বিবেকের দাস হতে পারে কেবল তখনই হতে পারে সে প্রকৃত মানুষ এবং পাশবিক নানা আমিত্বের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে সে কেবল তখনই হতে পারে মহান আল্লাহর খলিফা যে জন্য আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন। রোজা মানুষকে আল্লাহর পরিপূর্ণ দাস ও খলিফা বা প্রতিনিধি হওয়ার শিক্ষা দেয়।
একজন পরিপূর্ণ দাস মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং আল্লাহর বিধানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিজের সব কিছুকে কুরবানি করতে পারেন। আর রোজা হচ্ছে সেই কুরবানির প্রশিক্ষণ নেয়ার অন্যতম মাধ্যম। প্রকৃত নামাজ ও প্রকৃত রোজার প্রভাব প্রমাণিত হয় আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের সময়।
ইব্রাহিম (আ.) হাসিমুখে নমরুদের জ্বালানো বিশাল অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করতে দ্বিধা বোধ করেননি নামাজ ও রোজার প্রভাবের কারণেই। সর্বোত্তম রোজাদার ও সর্বোত্তম নামাজি ছিলেন বলেই বিশ্বনবী (সা.) বলেছিলেন, আমার এক হাতে যদি সূর্য আর অন্য হাতে যদি চাঁদ এনে দাও তবুও আমি সত্য প্রচার করা থেকে বিরত হব না। তাঁরা মহান আল্লাহকেই প্রকৃত অর্থেই সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশক্তিমান মনে করতেন এবং আল্লাহর নির্দেশকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন। তাই তাঁদের কোনো ভয় ও দুঃখ ছিল না। একই কারণে আমিরুল মু'মিনিন আলী (আ.) বলেছিলেন, শিশুর কাছে মাতৃস্তন যতটা প্রিয় শাহাদত আমার কাছে তার চেয়েও বেশি প্রিয়।
যারা কারবালায় ইসলামের জন্য হাসিমুখে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন তারা ছিলেন মানব-ইতিহাসের শীর্ষস্থানীয় রোজাদার ও নামাজি। কারবালায় শহীদ হওয়ার জন্য তাঁরা প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন এবং এ জন্য ইমামের একদল অনুসারী এতটাই ব্যাকুল ও আত্মহারা হয়েছিলেন যে তারা ইমামের দেখানো পথে হাজার বার নিহত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন! অন্যদিকে আলী (আ.)' বিরোধী খারিজিরাও রাত জেগে নফল নামাজ পড়তো, কুরআন পাঠ করতো এবং রোজাও রাখত! ইয়াজিদ বাহিনীর বেশিরভাগ সেনাও ছিল নামাজি ও রোজাদার! অথচ তাদের কুরআন-পাঠ এবং নামাজ-রোজায় প্রকৃত ইসলামের প্রাণ-সত্তার সামান্য ছোঁয়াও ছিল না! কারণ, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোভাবে চিনতে পারেনি। ফলে তারা প্রকৃত শিক্ষকদেরকে শিক্ষক হিসেবে মেনে নেয়নি। পরিণতিতে আল্লাহ ও বিশ্বনবী (সা.) এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইত তাদের কাছে গুরুত্ব পায়নি। তারা নামাজ ও রোজার মাধ্যমে হয় কেবলই অভিনয় করেছে অথবা মুর্খতার কারণে কাঁচকে হিরা মনে করেছে, আর আসল হিরাকে ভেবেছে কাঁচ। মোট কথা আল্লাহু আকবার বা আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ- এ কথা কেবল মুখে মুখে বললেই হবে না, প্রতিটি মুহূর্তে নানা পরীক্ষায় তা প্রমাণ করতে হবে। -বাজনা
দরিদ্র মানুষদের ক্ষুধার কষ্ট অনুভব করা ও তাদের কথা মনে রেখে সমানুভূতি সৃষ্টি করা পবিত্র রমজানের অন্যতম লক্ষ্য। একজন ফিলিস্তিনি বৃদ্ধা নারী রোজা রাখছে দেখে একজন পশ্চিমা নারী তাকে প্রশ্ন করেন যে আপনি কেন রোজা রাখছেন? তিনি উত্তরে জানান যে দরিদ্রদের ক্ষুধার জ্বালা মনে রাখার জন্য আমি রোজা রাখি। এ কথা শুনে পশ্চিমা ওই নারী বিস্মিত হন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন।
রোজার উদ্দেশ্য হচ্ছে খোদা-ভীতি অর্জন ও সংযম চর্চা করা। বিশ্বনবী (সা.)'র একটি হাদিস অনুযায়ী মানুষের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের রোজা রয়েছে। যেমন, চোখের রোজা, হাতের রোজা, পায়ের রোজা, মুখের বা জিহ্বার রোজা ইত্যাদি। নিষিদ্ধ দৃশ্য দেখা থেকে দৃষ্টিকে বিরত রাখা চোখের রোজা, নিষিদ্ধ পথে চলা থেকে পাকে বিরত রাখা হচ্ছে পায়ের রোজা, হাত দিয়ে কোনো অবৈধ কাজ না করা হচ্ছে হাতের রোজা, নিষিদ্ধ কথা না বলা হচ্ছে মুখের রোজা।

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/আশরাফুর রহমান/১১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।