আসমাউল হুসনা (পর্ব-৬৬)
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) বলেছেন, মহান আল্লাহ'র রয়েছে ৯৯ নাম। যে ব্যক্তি এইসব নাম স্মরণ করবে সে বেহেশতে প্রবেশ করবে। মহান আল্লাহর আসমাউল হুসনার তালিকাভুক্ত দুই নাম হল আউয়াল ও আখির।
আউয়াল অর্থ প্রথম। মহান আল্লাহর আগে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না। মহান আল্লাহ সময়েরও স্রস্টা এবং তিনি অনাদি ও অনন্তকাল ধরে থাকবেন। তাই মহান আল্লাহর সত্ত্বার সূচনা বা উন্মেষ কিংবা প্রাথমিক অবস্থা বলে কিছুই নেই। মহান আল্লাহর প্রথম হওয়া মানে সংখ্যাগতভাবে প্রথমও নয় তথা দ্বিতীয় বা তৃতীয়ের মোকাবেলায় তিনি প্রথম এমন নয়। কার্যকরণগত বিধান অনুযায়ী কারণ জন্ম দেয় কোনো কিছুর। কিন্তু মহান আল্লাহ সেরকম কোনো অস্তিত্ব তথা কোনো কারণের ফলও নন।
মহান আল্লাহর প্রথম হওয়া মনে স্থান বা সময়ের দিক থেকেও প্রথম নয়। স্থান ও কাল বস্তুগত বিষয় বা পার্থিব বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। অপার্থিব জগতে সময় ও স্থান বলতে কিছু নেই। মহান আল্লাহর আউয়াল বা প্রথম নাম তার চিরন্তনতা ও শাশ্বত হওয়ার প্রতীক। মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে প্রাথমিক অবস্থা কিংবা শৈশব, কৈশোর, যৌবন-এসব অসম্ভব বিষয়।
অন্যদিক আখির বলতে সমাপনী বা শেষ পর্যায়কে বোঝায়। কিন্তু মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে আখির বলতে অন্তহীনতা ও অসীমতা এবং সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও তাঁর টিকে থাকাকে বোঝায়। পবিত্র কুরআনের ১১ নম্বর সুরা তথা সুরা হুদ-এর ৭৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: মহান আল্লাহই সর্বোত্তম ও সবচেয়ে বেশি স্থায়ী তথা চিরস্থায়ী। - মহান আল্লাহর আখির হওয়া বলতে এটাও বোঝায় যে সব সৃষ্টির চূড়ান্ত লক্ষ্য হলেন মহান আল্লাহ এবং সব কিছুই মহান আল্লাহর দিকে ফিরে যাবে। পবিত্র কুরআনের ৯৬ নম্বর সুরা তথা সুরা আলাক্ব-এর ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: বস্তুত সব কিছুর প্রত্যাবর্তন তোমার প্রতিপালকের দিকেই। -মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কোনো কিছুর ক্ষেত্রে আউয়াল ও আখির বললে সূচনা ও সমাপনীর ধারণা মনে আসে। কিন্তু মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে এসব ধারণা অর্থহীন। মহান আল্লাহ আউয়াল মানে তাঁর আগেও এমন কোনো সময় ছিল না যে সময় তিনি ছিলেন না এবং আখির মানে সুদূর ভবিষ্যতেও এমন কোনো পর্যায় আসবে না যে পর্যায়ে মহান আল্লাহ থাকবেন না! অন্য কথায় মহান আল্লাহ সূচনাহীন প্রথম ও অন্তহীন শেষ। দুই দিক থেকেই তিনি সীমানাহীন।
আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ) বলেছেন, সব প্রশংসা মহান আল্লাহর যার সত্ত্বাকে বোঝা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়, মহান আল্লাহর সত্ত্বার স্বরূপ কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনার যোগ্য নয় এবং কল্পনা ও চিন্তা তাঁকে উপলব্ধি করতে অক্ষম।
মহান আল্লাহর কোনো কোনো নামের অর্থ পরস্পরের বিপরীতধর্মী ও কোনো কোনো নাম একই ধরনের অর্থবোধক কেবল মাত্রায় ভিন্নতা রয়েছে। আউয়াল ও আখিরও বিপরীতধর্মী। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে এ দুই নাম একই বাস্তবতা ও ঐকতান তুলে ধরে। পবিত্র কুরআনের ৫৭ তম সুরা অর্থাৎ সুরা আল-হাদিদ-এর তৃতীয় আয়াতে মহান আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে বলা হয়েছে হুয়াল আউয়ালু ওয়ালআখিরু তথা তিনিই প্রথম ও তিনিই শেষ!-এখানে আখির বলতে যা বোঝায় সে বিষয়ে ইমাম জাফর আস সাদিক্ব -আ. বলেছেন, সব কিছুই পরিবর্তনশীল, ক্ষয়িষ্ণু ও ধ্বংসশীল একমাত্র আল্লাহ ছাড়া। মহান আল্লাহ সব সময় ছিলেন, আছেন ও থাকবেন একইভাবে তথা কোনো পরিবর্তন ছাড়াই। অন্য সব কিছুরই নানা দিক যেমন, রঙ, বৈশিষ্ট্য বা প্রকৃতি বদলে যায় কেবল আল্লাহ ছাড়া। তিনি সব কিছুর আগে ছিলেন বলে আউয়াল এবং অপরিবর্তিত থাকেন বলে আখির।
একই প্রসঙ্গে মহানবীর-সা. পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য ইমাম জাফর সাদিক্ব-আ. বলেন, মহান আল্লাহর গুণ ও বৈশিষ্ট্য কখনও বদলায় না। কিন্তু অন্যান্য সৃষ্টির গুণ ও বৈশিষ্ট্য বদলায়। যেমন, মানুষ এক সময় ছিল মাটি, এক সময় হয় রক্ত-মাংসপূর্ণ ও এক সময় তার শরীর টুকরো টুকরো হয়ে যায় ও হাড় পচে যায়! এভাবে নামও বদলে যায় অবস্থার প্রেক্ষাপটে। কিন্তু মহান আল্লাহর মধ্যে এমন পরিবর্তনশীলতা, ক্ষয় ও ধ্বংসশীলতা নেই। মহান আল্লাহ সব সময়ই পরিপূর্ণ, অভিন্ন বা একই রকম এবং সময়ের ব্যবধানে তাঁর কোনো পরিবর্তন ঘটে না।
এক ইহুদি আলেম আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলীর কাছে এসে প্রশ্ন করেন: আপনার প্রতিপালক কখন অস্তিত্ব লাভ করেছেন? উত্তরে হযরত আলী-আ. বলেন, আপনি আগে বলুন আল্লাহ কোন্ সময় ছিলেন না? যিনি সব সময়ই ছিলেন তাঁর তো অস্তিত্ব লাভের কোনো প্রশ্নই উঠে না। মহান আল্লাহ সময় ও স্থানের গণ্ডীতে আবদ্ধ হওয়ার মত ক্ষুদ্র কোনো সত্ত্বা নন। তিনি গোটা অস্তিত্ব জগতকে ঘিরে আছেন এবং সেসব নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি আউয়াল ও আখির এবং সব অস্তিত্বের গতিশীলতার উৎস। মহান আল্লাহর দাসত্ব করতেই আল্লাহ সব কিছুকে গতিশীল করেন।
অবশেষে সব কিছুই মহান আল্লাহর দিকে ফিরে যাবে। সব কাজের লক্ষ্য হলেন মহান আল্লাহ এবং সব কিছুই মহান আল্লাহর নির্দেশে ঘটে। সব কিছুই ধ্বংসশীল। কেবল মহান আল্লাহই চিরস্থায়ী ও অক্ষয়।
মহান আল্লাহর আউয়াল ও আখির হওয়ার বিষয় থেকে শিক্ষা নিয়ে মুমিন এটা মনে রাখেন যে আল্লাহ মৃত্যু ও ক্ষয়ের ঊর্ধ্বে এবং চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী। অন্যদিকে পার্থিব সব কিছুই ধ্বংসশীল। কেবল মহান আল্লাহই তাঁর অশেষ শান ও শওকত তথা মহাগৌরব ও মহা-আভিজাত্যসহ টিকে থাকবেন। মুমিন বা বিশ্বাসীরাও অবশেষে পরকালে মহান আল্লাহর অশেষ করুণায় চিরস্থায়ী জীবন লাভ করবে এবং ধ্বংস হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাবে। তাঁদের এই বিশ্বাস আল্লাহর দাসত্ব করার ক্ষেত্রে তাঁদেরকে আরও অবিচল ও একনিষ্ঠ করে তোলে। আর তাই তাঁরা আল্লাহর নির্দেশ মান্য করাকেই অন্য সব কিছুর চেয়ে গুরুত্ব দেন যাতে তাঁরা প্রথম শ্রেণীর মুমিন হতে পারেন। তারা সব কাজের আগে আল্লাহর নির্দেশই পালন করেন। অন্য কথায় আল্লাহর নির্দেশ মান্য করার ক্ষেত্রে তারা অগ্রণী বা আউয়াল। আর আল্লাহর দাসত্বের কাজ না করা বা নির্দেশ অমান্য করার বেলায় তাদের অবস্থান সর্বশেষ বা সবার পরে তথা আখির এবং কখনও তা ঘটলেও তাও ঘটে একান্তই অনিচ্ছায়।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।