মে ০২, ২০২২ ১৮:২৩ Asia/Dhaka

রোজা যায়, রোজা আসে/বদলে না’তো মানুষ ! যেমন ছিল, তেমন থাকে/ফিরে না’কো হুঁশ । কাদের তরে ঝরে পরে/এত নেয়ামত ? রাশি রাশি ভোগ করেও/পাইনা হেদায়াত ! (আবদুস সামাদ)

আজ অফুরন্ত রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস রমজানের শেষ দিন। মহান আল্লাহ যেন এবারের রমজানকেই জীবনের শেষ রমজান না করেন। আমরা রমজানে অর্জিত খোদাভীতি ও খোদাপ্রেমকে যেন সারা জীবনের জন্য ধরে রাখতে পারি এবং দিনকে দিন আল্লাহর আরো প্রিয়পাত্র হতে পারি সে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বলা হয় যে দিনটিতে মুসলমান কোনো পাপ করে না সে দিনটিই হল তার প্রকৃত ঈদের দিন।

ঈদের প্রাক্কালে বা ঈদের দিনের এক বড় পরিহাস হল বড় বড় জালিম বা তাগুতি সরকারগুলোর প্রধানরাও মুসলিম জনগণকে ও অন্যান্য নেতাকে ঈদের শুভেচ্ছা জানায়। ঈদের বার্তায় তারা শান্তি ও সুখ কামনা করে! অথচ তারাই পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছে অশান্তি এবং তাদের ক্ষমতা ও সম্পদের সীমাহীন লোভের কারণে দেশে দেশে মানুষকে দিতে হচ্ছে প্রাণ, হারাতে হচ্ছে সম্পদ, স্বাধীনতা ও সম্ভ্রম! নারী-পুরুষ ও শিশুদের জীবন ছাড়াও তারা কেড়ে নিচ্ছে বহু দেশের বিপুল প্রাকৃতিক ও জ্বালানী সম্পদসহ অনেক সম্পদ এবং দেশে দেশে তারা ধ্বংস হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অবকাঠামো।

বিশ্বের মোড়ল সেজে-বসা জালিম নেতাদের লোভ-লালসা ও অনাচারের কারণে বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশও বিপন্ন হয়ে মানুষসহ সব জীবের অস্তিত্বই অদূর ভবিষ্যতে বিলুপ্তির হুমকির মুখে রয়েছে। ইয়েমেন, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, মিয়ানমার, কাশ্মির এবং আরও অনেক অঞ্চলে মানুষের ওপর দানবীয় যুদ্ধ, সন্ত্রাস ও দমন-পীড়ন চাপিয়ে দিয়ে এইসব জালিম সরকার বা শাসকগোষ্ঠী বিশ্ববাসীর ওপর প্রভুত্ব জাহির করতে চায়। অথচ মহান আল্লাহ প্রত্যেক মানুষকে কেবল আল্লাহর দাসত্ব করতে বলেছেন ও ন্যায়বিচার কায়েম করতে বলেছেন। আমরা রোজদার হওয়ার দাবি করছি অথচ আমরা কি অবরুদ্ধ ও আগ্রাসন-পীড়িত ইয়েমেনের মজলুম ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষুধার জ্বালা অনুভব করে তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিআমরা কি অবরুদ্ধ গাজার ও পশ্চিম তীরের মজলুম ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ইসরাইলি হানাদারদের বহুমুখি সন্ত্রাস ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে এবং তাদের সহযোগী শক্তিগুলোর বিশ্বাসঘাতকতা ও কপটতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না জানিয়েই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আশা করতে পারি? আমরা দরিদ্র ও বিতাড়িত রোহিঙ্গা মুসলমানদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিয়েই কি প্রকৃত মুসলমান হওয়ার ও প্রকৃত মানুষ হওয়ার দাবি করতে পারি?

নিরন্ন ও ইয়াতিমদের ক্ষুধার জ্বালা অনুভবের যে শিক্ষা রমজান আমাদের দেয় তার বাস্তব প্রতিফলন কি ঘটেছে আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক নীতির পরিসরে? আফগানিস্তানে প্রায়ই গণহত্যার যেসব তাণ্ডব চালানো হচ্ছে সে বিষয়েও আমাদের মুসলিম বিশ্বের আলেম সমাজের একটা বড় অংশের নীরবতা ইসলাম ও মনুষ্যত্বের দাবির সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ?  মুসলমানদের ইবাদতের চেতনা, সামাজিকতা ও আন্তর্জাতিকতা, ঐক্য ও সংহতি বা বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের চেতনা পরস্পর বিচ্ছিন্ন কোনো ব্যাপার নয়। তাই ইসলামের সার্বিক দিকের প্রতি লক্ষ্য না রেখে আমরা ভালো মুসলমান ও ভালো রোজাদার হওয়ার দাবি করতে পারি না।

মহান আল্লাহ কুরআনে আমাদের কাছে কর্জে হাসানা বা উত্তম ঋণ চেয়েছেন। এর অর্থ কী এটা যে আল্লাহ অভাবগ্রস্ত?-নাউজুবিল্লাহ। না, বরং আল্লাহ চান যে তার দেয়া রিজিক বা অর্থ থেকে আমরা যদি দরিদ্রদের সাহায্য দেই, আর তাহলে তা যেন আল্লাহকেই ঋণ দেয়া হল! আর তা আল্লাহর রিজিক বা অর্থ হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ এর বিনিময়ে আমাদের বহুগুণ পুরস্কার দেবেন বলে কুরআনে ওয়াদা দিয়েছেন। অথচ এমন দয়াময় আল্লাহ'র আহ্বান ও তাঁর প্রেমিক হওয়ার নানা সুযোগকে আমরা হেলায়-ফেলায় নষ্ট করছি। অথচ আল্লাহই হচ্ছেন সবচেয়ে ধনী ও সর্বশক্তিমান এবং সর্বোত্তম সহায় ও বন্ধু।

মুসলিম বিশ্বের জনপদগুলো আজও সন্ত্রাসীদের হামলা থেকে মুক্ত নয়। আজও ঘরে ঘরে অভাব, দারিদ্র, ক্ষুধা, পুষ্টিহীনতা ইত্যাদি দূর হয়নি। মুসলমান হিসেবে আমরা কেউই এসবের দায় এড়াতে পারি না। সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও নানা ধরনের অপসংস্কৃতি, অনৈতিকতা ও কুসংস্কার এবং পশ্চিমাদের অনুকরণে আধুনিক জাহিলিয়াতের দৌরাত্ম্য দেখা যাচ্ছে।

আসলে আমাদের অর্থনীতি, সমাজ-নীতি, সাংস্কৃতিক নীতি, শিক্ষানীতি ও রাজনীতিও কলুষিত বলেই আমরা মুসলমানরা সংকটের নানা ঘূর্ণাবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছি।  এইসব ক্ষেত্রেই ইসলামী জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ছাড়া মুসলমানরা প্রকৃত ঈদের আনন্দ কখনও অনুভব করতে সক্ষম হবে না। আল্লামা ইকবাল মুসলমানদের এহেন পরিস্থিতি তুলে ধরে এক কবিতায় বলেছিলেন:

উঠছে আওয়াজ দুনিয়া মাঝে ধ্বংস হল মুসলমান

বলব আমি সত্যিই কোথায় মুসলিম ছিল বিদ্যমান?

তমুদ্দুনে হিন্দু তুমি বেশভূষাতে খ্রিস্টিয়ান!

মুসলিম তুমি!? তোমায় দেখে ইহুদিও করে লজ্জা-জ্ঞান!

হতে পার খান-পাঠান তুমি, মোগল, আরব কিংবা তুর্কি বা আফগানও

সবই তুমি হতে পারো বলো তুমি মুসলমানও?!! 

সব সংকটের মাঝেও আশার কথা হল ইরানে ইসলামী বিপ্লব সফল হবার পর বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের মধ্যে জাগরণ এবং সাম্রাজ্যবাদ ও ইহুদিবাদ-বিরোধী চেতনা ও সংগ্রামের বিস্তার লক্ষণীয়। লেবানন, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাক, বাহরাইন ও আরও অনেক অঞ্চলের মুসলমানরা আজ অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেমে বেশ সাফল্য ও অগ্রগতি অর্জন করছেন। শহীদ সুলাইমানি ও আবু মাহদি মুহান্দিসের মত শহীদদের রক্তের পথ বেয়ে মুসলমানরা আবারও বিশ্ব-ইসলামী সভ্যতার পুনর্নির্মাণে এগিয়ে আসবেন এবং মুসলমানদের প্রথম কিবলাসহ গোটা ফিলিস্তিনকে মুক্ত করবেন এই আশা করা যায়। মুসলমানরা পবিত্র মদিনা ও মক্কাকেও খাঁটি ইসলামী নেতৃত্বের আওতায় এনে (কাবা ঘরকে আধুনিক যুগের লাৎ ও মানাতদের হাত থেকে মুক্ত করে) মুসলমানদের শেষ ত্রাণকর্তা ইমাম মাহদির নেতৃত্বাধীন বিশ্ব-ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগমের কাজে এগিয়ে যাবেন- এটাও পবিত্র ঈদের প্রাক্কালে সব বিপ্লবী মুসলমানের একান্ত বাসনা ও মহান আল্লাহর দরবারে তাদের অন্যতম একান্ত আর্জি।

এখানে এখন রাত্রি এসেছে নেমে,

তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজতোরণ,

এখানে এখন প্রবল ক্ষুধায় মানুষ উঠেছে কেঁপে

এখানে এখন অজস্র ধারা উঠেছে দুচোখ ছেপে

তবু দেখা যায় দূরে বহুদূরে হেরার রাজতোরণ ” (ফররুখ আহমদ)

সবাইকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়ে এবং অর্থসহ রমজানের ত্রিশতম দোয়া শুনিয়ে শেষ করব 'রমজান: আত্মশুদ্ধির মহোৎসব' শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনা। এতদিন যারা সঙ্গ দিলেন তাদের সবাইকে জানাচ্ছি প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবুসাঈদ/৩০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।