আসমাউল হুসনা (পর্ব-৭২)
সব সুন্দর নাম কেবলই মহান আল্লাহর। মহান আল্লাহর এমনই এক নাম হল রা-য়ুউফ। এর অর্থ অত্যধিক দয়া, অনুগ্রহ ও করুণা।
পবিত্র কুরআনে এই নাম এসেছে মোট ১১ বার এবং নয় বার এসেছে মহান আল্লাহর রাহিম নামের সঙ্গে। মহান আল্লাহর এই নামের উৎস তাঁরই অন্যতম প্রধান নাম রাহমান। এই নাম দিয়ে এটা বোঝানো হয় যে মহান আল্লাহর রহমত বা অনুগ্রহ এতই ব্যাপক যে তা সব সৃষ্টিকে এবং মুমিন ও কাফির নির্বিশেষে সব মানুষকে এর আওতায় এনেছে। সব সৃষ্টিই মহান আল্লাহর দয়া, অনুগ্রহ ও কল্যাণের মধ্যে ডুবে আছে।
মহান আল্লাহর বিশেষ দয়ার প্রকাশ তাঁর রাহিম নাম। মা যেমন সন্তানের কল্যাণের জন্য তার ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেন কখনও কখনও মহান আল্লাহও তাঁর রাহিম নামের কৌশলপূর্ণ প্রয়োগের প্রকাশ হিসেবে বান্দাহকে নানা কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে বিশেষ রহমত বা অনুগ্রহের অধিকারী করেন। কিন্তু মহান আল্লাহর রা-য়ুউফ তাঁর এমনই দয়া ও অনুগ্রহের প্রকাশ যে তিনি মানুষকে সুপথ দেখাতে ও সৌভাগ্যের অধিকারী করতেও তাকে কষ্ট দিতে প্রস্তুত নন।
অনেকে মনে করেন মহান আল্লাহর রা-য়ুউফ নামের পরে রাহিম নামের ব্যবহার থেকে বোঝা যায় এ দুটি নাম কাছাকাছি পর্যায়ের এবং এর মাধ্যমে মহান আল্লাহর অশেষ রহমতের কথা তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু অন্য একদল মুফাস্সির মনে করেন মহান আল্লাহর রা-য়ুউফ ও রাহিম নামের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তাদের মতে রা-য়ুউফ নানা ক্ষতি প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে যে অনুগ্রহ তা তুলে ধরে। আর রাহিম নানা কল্যাণকে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে যে অনুগ্রহ সেটাই তুলে ধরে। আর এ কারণেই রাহিম নামের আগে রা-য়ুউফ নাম এসেছে। প্রখ্যাত সুন্নি মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিক ইজ্জাদ্দিন ইবনে আসিরের লেখা একটি বিশেষ অভিধানের বইয়ে রা-য়ুউফ নামকে রহমতের চেয়ে উচ্চ পর্যায়ের ও অনুগ্রহের ক্ষেত্রে আরও তীব্রতর বলে উল্লেখ করেছেন। রা-য়ুউফ নাম কখনও অপ্রীতিকর বিষয়ে প্রয়োগ করা হয় না। অথচ রাহিম বা রহমত অপ্রীতিকর বিষয়েও প্রয়োগ করা হয়।
পবিত্র কুরআনের ২২ তম সুরা সুরা হজ-এর ৬৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তার রা-য়ুউফ ও রাহিম নাম প্রয়োগ করে বলেছেন: তুমি কি দেখ না যে, ভূপৃষ্ঠে যা আছে এবং সমুদ্রে চলমান নৌকা তৎসমুদয়কে আল্লাহ নিজ আদেশে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন এবং তিনি আকাশ স্থির রাখেন, যাতে তাঁর আদেশ ছাড়া ভূপৃষ্ঠে পড়ে না যায়। নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি রা-য়ুউফ বা করুণাশীল, দয়াবান। - এ আয়াত থেকে বোঝা যায় মহান আল্লাহ মানুষকে যত নেয়ামত দিয়েছেন তা মহান আল্লাহর অশেষ করুণা বা রা-য়ুফ ও দয়া তথা রাহিম নামের প্রকাশ।
অবশ্য মহানবীর (সা) বক্তব্য অনুযায়ী মহান আল্লাহর রহমতের প্রকাশ বেশি মাত্রায় ঘটবে পরকালে। তিনি বলেছেন, মহান আল্লাহ তার রহমতের ১০০ ভাগের মাত্র এক ভাগ বিলিয়ে দিয়েছে মানুষ, জিন, চতুষ্পদ জন্তু, পাখি ও বন্য প্রাণীদের মধ্যে এবং এ কারণেই সৃষ্টিকুল পরস্পরের প্রতি দয়াশীল। আর রহমতের বাকি ৯৯ ভাগ মহান আল্লাহ নিজের কাছে রেখেছেন যাতে কিয়ামতের দিন তিনি নিজ বান্দাদের প্রতি দয়া করতে পারেন।
মহান আল্লাহর রহমত সৃষ্টির পরতে পরতে ও প্রতিটি অণু-পরমাণুতে ছড়িয়ে আছে। তাই এটাই স্বাভাবিক যে এমন মহান প্রভু মানুষকে কল্যাণ ও মন্দ পথ এবং সুন্দর ও অশালীন পথের পার্থক্য দেখিয়ে দেবেন। আর এ জন্যই তিনি যুগে যুগে মানুষকে সুপথ দেখানোর জন্য অনেক নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। এ বিষয়টি মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহর বিশেষ রহমতের প্রকাশ। মহান আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসুলদের মোট সংখ্যা এক লাখেরও বেশি বা মতান্তরে দুই লাখেরও বেশি। আর এই বিপুল সংখ্যক নবী-রাসুলের মধ্যে কেবল হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা)-কে মহান আল্লাহ রা-য়ুউফ নামে উল্লেখ করেছেন। সুরা তওবার ১২৮ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেছেন,
তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তাঁর পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি রা-য়ুউফ বা স্নেহশীল, দয়াময়। -এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে মহান আল্লাহ ও তাঁর নবী যখন রা-য়ুউফ বা মহাঅনুগ্রহশীল তখন মুসলমানদেরও উচিত মানুষের দুঃখ ও বেদনায় সমমাত্রায় ব্যথিত হয়ে তাঁদের প্রতি এমন নামেরই প্রকাশ হওয়া।
প্রত্যেক মুমিন মুসলমান অন্য মানুষদের প্রতি অত্যন্ত দয়ার্দ্র ও স্নেহশীল। তাঁরা চান অন্যরাও সুপথ পাক এবং তাঁরা মানুষের সুখ ও সৌভাগ্যের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকেন। মহানবীর (সা) পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য হযরত ইমাম রেজা-আ.-কেও রা-য়ুউফ বলা হয়। এই নাম তাঁর অন্যতম বিখ্যাত উপাধি, যদিও আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্যও এই নামের সঙ্গে সম্পর্কিত গুণ আর ঔজ্জ্বল্যের অধিকারী। পার্থক্য হল এ বিষয়ে ইমাম রেজার বিশেষ সুনাম রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত মনীষী মরহুম আল্লামা তাবাতাবায়ি বলেছেন, মানুষ যখন ইমাম রেজার (আ) পবিত্র মাজারে প্রবেশ করে তখন দেখে যে এই মাজারের দরজা ও দেয়াল থেকেও যেন কল্যাণ আর অনুগ্রহ ঝরে পড়ছে।
ইমাম রেজা (আ) যখন মদিনা থেকে খোরাসানে আসছিলেন সে সময় তাঁর সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য লাভের অধিকারী এক ব্যক্তি বলেন: একদিন পথে খাবার সময় দস্তরখান বিছানো হল। সেই দস্তরখানে ইমাম ও কৃষ্ণকায় ও শ্বেতাঙ্গ নির্বিশেষে তাঁর সব সেবকরা একসঙ্গে খেতে বসায় আমি বললাম, সেবকদের জন্য পৃথক দস্তরখান বিছানো হলে ভালো হত না? ইমাম বললেন: আমাদের আল্লাহ একজন এবং আদি পিতা ও মাতাও অভিন্ন। মানুষ প্রতিদান পাবে তাদের কাজের আলোকে, গায়ের চামড়া সাদা-কালো হওয়ার কারণে অথবা পদ বা পদবির আলোকে নয়। এভাবে একজন ইমাম হওয়া সত্ত্বেও হযরত ইমাম রেজা –আ কখনও নিজেকে অহংকারের শিকার করেননি এবং তিনি অন্য সবার প্রতি ছিলেন মহাঅনুগ্রহশীল।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০৭
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।