স্বাস্থ্যকথা
'ক্যান্সার শব্দটি রোগীর কাছে মৃত্যু পরোয়ানার মতো মনে হয়'
সুপ্রিয় শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! স্বাগত জানাচ্ছি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যকথার আসরে আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশাকরি সবাই ভালো ও সুস্থ আছেন। প্যালিয়েটিভ কেয়ার নিয়ে কয়েক পর্বের নতুন স্বাস্থ্যসেবা বা চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছি। এরইমধ্যে প্রথম পর্ব আপনারা শুনেছেন। সেখানে প্যালিয়েটিভ কেয়ার আসলে কি ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি সে ব্যাপারে-কথা বলেছেন আমাদের অতিথি বিশিষ্ট প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ ডা. মোবাশ্বার হাসান মাসুম।
তিনি আফ্রিকার দেশ লেসোথো ক্যান্সার ক্লিনিকে প্যালিয়েটিভ কেয়ার মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রথম পর্বের আলোচনায় বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেছিলেন, 'নিরাময় অযোগ্য রোগী এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা লাঘব করার জন্য একটি সমন্বিত স্বাস্থ্যব্যবস্থার নাম প্যালিয়েটিভ কেয়ার। দূরারোগ্যব্যাধি যেমন ক্যান্সার, ডিমেনশিয়া, কিডনি ফেইলিওর, হার্টফেইলিওর- এরধরনের কঠিন ব্যাধীতে আক্রান্ত রোগীর মনো-দৈহিক অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে রোগ নির্ণয়ের প্রথম দিন থেকে শুরু করে যতদিন রোগীটি বেঁচে থাকবেন ততদিন সেই রোগী এবং রোগীর আত্মীয়স্বজনকে সমন্বিতভাবে চিকিৎসা দেয়ার বিষয়টি হচ্ছে- প্যালিয়েটিভ কেয়ার।
আমরা গুরুত্বপূর্ণ সেই আলোচনা থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছিলাম। তো চলুন আজ আমরা এ বিষয়ক সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্বে যাই।
জনাব, ডক্টর মোবাশশার হাসান মাসুম রেডিও তেহরানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
রেডিও তেহরান: ডক্টর মোবাশশার হাসান মাসুম, প্যালিয়েটিভ চিকিৎসাপদ্ধতি স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়- বিশেষ করে নিরাময় অযোগ্য রোগী এবং তার পরিবারের জন্য। তো আজকের আলোচনার শুরুতে আমরা আরেকটু জানার জন্য শুরুতেই যে প্রশ্নটি করব সেটি হচ্ছে- চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে এই প্যালিয়েটিভ চিকিৎসা পদ্ধতি কবে থেকে এসেছে কিভাবে এসেছে যদি বিষয়টি একটু বলেন?
ড.মোবাশশার হাসান মাসুম: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। প্যালিয়েটিভ কেয়ারের যে ধারনাটি গত শতক অর্থাৎ উনবিংশ শতক থেকে চলে এসেছে কিন্তু এই প্যালিয়েটিভ কেয়ার কখন কাজে লাগাতে হবে তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থেকে যায়। যেমন ধরুন- একসময় বলা হতো ক্যান্সার হলে শুধুমাত্র রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি অথবা শৈল্য চিকিৎসা করে শেষ পর্যায়ে গিয়ে যখন আর এসব চিকিৎসা আর কাজ করে না তখন প্যালিয়েটিভ চিকিৎসা দিতে হবে। কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা জরিপ চালিয়ে দেখেছে যে এ ব্যাপারে আসলে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় নি। তারা বলছেন, প্যালিয়েটিভ কেয়ার সেবা দিতে হবে সেই দিন থেকে যেদিন একজন রোগী প্রথম রোগ ধরা পড়ল। অর্থাৎ ক্যান্সার, অর্গান ফেইলিওর অথবা স্নায়ুজনিত রোগে আক্রান্ত হলেন সেদিন থেকেই। অর্থাৎ প্যালিয়েটিভ কেয়ার চিকিৎসা দেয়ার সাথে সাথে যে বিশেষায়িত চিকিৎসা-যেমন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে-রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি অথবা সার্জারি-এগুলো একযোগে রোগীর ওপর প্রয়োগ করতে হবে।
রেডিও তেহরান: ডা. মাসুম আপনি বলছিলেন, প্যালিয়েটিভ কেয়ার এবং বিশেষায়িত চিকিৎসা একযোগে দিতে হবে- একযোগে কেন দিতে হবে?
ড.মোবাশশার হাসান মাসুম: দেখুন, এখানে যৌথ চিকিৎসার কথা বলা হচ্ছে। কেন যৌথ চিকিৎসা দিতে হবে। এর উত্তরে বলব- যখন একজন রোগীকে কেমোথেরাপি দেয়া হবে বলে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ঠিক করলেন। কেমোথরাপি চলাকালে অর্থাৎ প্রথম ডোজ থেকে যদি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো ঠিকভাবে নিরুপণ করে রোগীকে চিকিৎসা দেয়া না হয় তাহলে সেই কেমোথেরাপি ঐ রোগীর ওপর সঠিকভাবে কাজ করবে না। যদি ঐ একই রোগীকে প্রথমে প্যালিয়েটিভ কেয়ার চিকিৎসা শুরু করা হয় একইসাথে কেমোথেরাপি দেয়া হয় তাহলে দেখা যায় যে কেমোথেরাপিটি অনেক ভালো ফলাফল দেয় ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীটর জন্য। আবার কোনো কোনো রোগীর একইসাথে কেমোথেরাপি এবং রেডিয়েশন চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। কিন্তু তাকে প্যালিয়েটিভি কেয়ার চিকিৎসা দেয়া হয় নি। ফলে এই রোগীটির ফলাফল তেমন ভালো হবে না। আবার একইধরনের রোগীর কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন ও প্যালিয়েটিভ কেয়ার চিকিৎসা দেয়া হলো সেক্ষেত্রে দেখা যায় প্রথম রোগীটি অপেক্ষা ভালো ফলাফল লাভ করেছে এবং তার জীবন যাপনের মান উন্নত হয়েছে।
শ্রোতাবন্ধুরা! আপনারা স্বাস্থ্যকথার আসরে লেসোথো প্রবাসী প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ ডা. মোবাশশার হাসান মাসুমের আলোচনা শুনছেন। ফিরছি শিগগিরি আমাদের সাথেই থাকুন।
রেডিও তেহরান: মিউজিক বিরতির পর আবারও ফিরে এলাম প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিষয়ক আলোচনায়। ডা. মাসুম আপনি বলছিলেন- দূরারোগ্য ব্যাধীতে আক্রান্ত রোগীর বিশেষায়িত চিকিৎসার পাশাপাশি প্যালিয়েটিভ কেয়ার চিকিৎসা দেয়ার ফলে ঐ রোগীর জীবনযাপনের মান উন্নত হয়েছে। বিষয়টি কি আরেকটু বুঝিয়ে বলবেন?
ডা. মোবাশশার হাসান মাসুম: প্যালিয়েটিভ কেয়ারের এই দিকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী বা অন্য কোনো জটিল রোগে বা যেটাকে আপনি বললেন দূরারোগ্যব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষ জনকে তার জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করতে হবে। আমরা যদি একটু ভেবে দেখি এতে কি হয়? বিষয়টি হচ্ছে- যদি কেউ একজন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন-অর্থাৎ রোগের সিমটম নিয়ে চিকিৎসকের কাছে কেউ গেছেন। ডাক্তার দেখে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বললেন –আপনার ক্যান্সার হয়েছে। আপনার শরীরে একটা টিউমার আছে যেটি ক্যান্সার আক্রান্ত। এই ক্যান্সার কথাটি যখন একজন রোগী শুনলেন-ডাক্তারের কাছ থেকে তখন সেই কথাটি রোগীটির কাছে মৃত্যু পরোয়ানার মতো মনে হয়। এটি কেবল আমাদের বাংলাদেশে নয় সারা বিশ্বের যেকোনো দেশেই আপনি যদি পরিসংখ্যান নেন তাহলে দেখবেন রোগীর বায়োপসি রিপোর্টের যে ঘোষণাটি দেয়া হয় যে আপনার ক্যান্সার হয়েছে তখন রোগীর মনে প্রচণ্ড জোরে একটা বুলেটের মতো আঘাত করে। তাতে রোগীর মনটা ভেঙে যায় এবং রোগী ভয় পেতে আরম্ভ করে। আর যখনই কোনো রোগী ভয় পাবেন তার রোগের জন্য তখন আপনি যদি ওষুধের পর ওষুধ লিখতে থাকেন আর সেইসব ওষুধ কতটুকু কাজ করবে কি করবে না তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে কাজ করে না। আর সেজন্য প্যালিয়েটিভ কেয়ারের গুরুত্ব অপরিসীম।
রেডিও তেহরান: ডা. মাসুম দ্বিতীয় পর্বের শেষ যে প্রশ্নটি করব সেটি হচ্ছে- ধরুন কেউ দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত- এই রোগীর প্যালিয়েটিভ কেয়ার চিকিৎসা সেবা আপনারা কিভাবে শুরু করবেন?
ডা. মোবাশশার হাসান মাসুম: দেখুন, প্যালিয়েটিভ কেয়ারে চিকিৎসা সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা রয়েছে। এটাকে বলা হয় 'কমিউনিকেশন উইথ দ্য প্যাটেন্ট অ্যান্ড দ্য ফ্যামিলি'। কমিউনিকেশনের সুনির্দিষ্ট গাইড লাইন রয়েছে। কতগুলো স্টেপ রয়েছে। সেগুলো মেনে- রোগীর জন্য সবচেয়ে কষ্টদায়ক যে সংবাদ সেটি জানাতে হবে। অর্থাৎ কষ্টদায়ক খবরগুলো দেয়ার ক্ষেত্রে প্যালিয়েটিভ কেয়ারে উল্লেখিত সুনির্দিষ্ট স্টেপগুলো মেনে তবে তা রোগীর কাছে বলতে হবে, তার আত্মীয় স্বজনকে জানাতে হবে যে রোগীর ক্যান্সার হয়েছে। ক্যান্সারটি কোথায় হয়েছে, কেন হয়েছে, চিকিৎসা কেমন হবে, সামনের দিকে চিকিৎসাটা আরও ভালো হবে ইত্যাদি বিষয়। ধীরে ধীরে রোগীকে বোঝানো হয় ক্যান্সারটি কোন পর্যায়ের। প্যালিয়েটিভ কেয়ারের এই চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে রোগীর মনে সাহস সঞ্চার হয়। রোগী ভাবতে শুরু করে- এখন তাকে রেডিয়েশন বা কেমোথেরাপি দিলে অসুখটি ভালো পর্যায়ে যাবে। প্রসঙ্গত বলে রাখি ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে কখনও প্যালিয়েটিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞরা মিথ্যে আশা দেন না। যা সত্য তা রোগীকে জানানো হয়। রোগের প্রকোপটা জানানো হয়। চিকিৎসার পর ফলাফল কতটুকু হবে তাও জানানো হয়। যারফলে রোগী মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যান যে কি চিকিৎসা নিতে হবে, কেন নিতে হবে,কখন নিতে হবে এবং কি ফলাফল আশা করা যেতে পারে।
ড.মোবাশশার হাসান মাসুম, প্যালিয়েটিভি কেয়ার নিয়ে আলোচনার দ্বিতীয় পর্বে আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! প্যালিয়েটিভি কেয়ার বিশেষজ্ঞ ড. মাসুমের চমৎকার আলোচনা শুনলেন। আমার কাছে মনে হয়েছে- ভয়ানক ব্যাধীতে আক্রান্ত রোগীরা মারাত্মক সংকটে ভোগেন। কোথায় যাবেন, কিভাবে চিকিৎসা শুরু করবেন, কি ধরনের চিকিৎসা হবে এসব নিয়ে একটা ধন্দে থাকেন। সেখানে প্যালিয়েটিভ কেয়ার চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি রোগীকে তার রোগের ধরণ, কি চিকিৎসা নেবেন, কিভাবে চিকিৎসা নেবেন- গোটা বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে জানান একইসাথে রোগীর পরিবারকেও। এতে কি হয় রোগী মানসিকভাবে প্রস্তত হয়ে যান। তো এই সুত্র ধরেই আমরা তৃতীয় পর্বের আলোচনায় যাব আগামী আসরে। আজ আর আমাদের হাতে সময় নেই। স্বাস্থ্যকথার আসর থেকে আজ এখানেই বিদায় চাইছি। আপনারা সবাই ভালো, সুস্থ ও নিরাপদ থাকুন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৭