ইমাম হুসাইনের (আ) চিরঞ্জীব মহাবিপ্লব-৪
ইমাম হুসাইন (আ) কি শিয়া মুসলমানদের হাতেই শহীদ হয়েছিলেন!?
শোকাবহ মহররম উপলক্ষে ইমাম হুসাইনের (আ) চিরঞ্জীব মহাবিপ্লব শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার চতুর্থ পর্ব থেকে সবাইকে জানাচ্ছি সংগ্রামী সালাম ও গভীর শোক আর সমবেদনা।
ইমাম হুসাইনের কারবালা বিপ্লবের ব্যাপারে একটি বিখ্যাত মিথ্যাচার হল ইমাম হুসাইন (আ) নিজ অনুসারীদের হাতেই বা আহলে-বাইতপন্থী মুসলমান তথা শিয়া মুসলমানদের হাতেই শহীদ হয়েছিলেন! অথচ ব্যাপারটি সম্পূর্ণ অবাস্তব। এটা ঠিক যে কুফায় হযরত আলীর রাজনৈতিক সমর্থক ও পরবর্তীকালে ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনের রাজনৈতিক সমর্থকদের সংখ্যা ছিল বিপুল এবং তাদের অনেকেই প্রয়োজনের সময় এই তিন মহান নেতাকেই সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছিল। কুফায় নিজ সমর্থকদের সংখ্যা বেশি থাকায় হযরত আলী তাঁর রাজধানী মদিনা থেকে কুফায় স্থানান্তর করেছিলেন। অবশ্য পবিত্র মক্কা ও মদিনাকে যে কোনো যুদ্ধ-বিগ্রহ বা অশান্তি থেকে রক্ষা করাও ছিল এ পদক্ষেপের অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু ইমাম হুসাইন-আ. তাঁর অনুরাগীদের হাতেই শহীদ হয়েছিলেন এটি একটি ডাহা মিথ্যাচার! ইমাম হুসাইনের ঘাতকরা তথা ইয়াযিদ বিন মুয়াবিয়া, ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ, ওমর ইবনে সা'দ, শিমার জিল জউশান,সিনান ইবনে আনাস নাখায়ী, খুলি ইবনে ইয়াযিদ আছবাহী ও মাররা ইবনে মুনকিয, আমর ইবনে সাবিহ সাইয়াদি, মুহাম্মাদ ইবনে আশআস ইবনে কাইস- এরা কি শিয়া মুসলমান ছিল?
আশুরার দিন শহীদ হওয়ার প্রাক্কালে ইমাম হুসাইন-আ. যখন দেখতে পান যে শত্রুরা তথা ইয়াযিদি সেনারা ইমামের তথা নবী-পরিবারের নিরস্ত্র নারীদের তাঁবুর দিকে হামলা চালাতে অগ্রসর হচ্ছে তখন ইমাম উচ্চস্বরে বলেছিলেন, হে আবু সুফিয়ানের শিয়ারা বা আবু সুফিয়ানের অনুসারীরা! তোমাদের প্রতি আক্ষেপ! তোমাদের যদি কোনো ধর্ম নাও থাকে ও কিয়ামতের বিচারকে যদি ভয় নাও করে থাকো অন্তত দুনিয়াতে স্বাধীনচেতা মানুষের মত হও! নিজেদের যদি আরব বলে মনে কর তাহলে অন্তত আরবদের বৈশিষ্ট্য ও স্বভাবগুলো মেনে চল! এ অবস্থায় শিমার জবাব দিয়ে বলে: হে ফাতিমার পুত্র! কি বলছ বা কি বলতে চাও? তখন ইমাম হুসাইন-আ. বলেছিলেন, যুদ্ধ বা সংঘাত আমার তোমাদের সঙ্গে ও আমার সঙ্গেই তোমাদের বিরোধ, কিন্তু নারীরা যুদ্ধরত নয়, তাই যতক্ষণ আমি জীবিত আছি ততক্ষণ তোমার অজ্ঞ ও আগ্রাসী সেনাদেরকে আমার পরিবারের আবাসে হামলা চালানো থেকে বিরত রাখো। -এ থেকেও স্পষ্ট ইমাম হুসাইন-আ. সেদিন শত্রু সেনাদের ও হামলাকারীদের নিজের শিয়া না বলে তাদেরকে আবু সুফিয়ানের অনুসারী বলে উল্লেখ করেছিলেন! আর এরা অবশ্যই সুন্নি মুসলমানদের দৃষ্টিতে শিয়া মুসলমান বলে পরিচিত নয়!
আজ চৌঠা মহররম। আজ হতে ১৩৮৩ চন্দ্র-বছর আগে ৬১ হিজরির এ দিনে কুফায় নিযুক্ত ইয়াজিদের নরপিশাচ গভর্নর ইবনে জিয়াদ ‘কাজি শুরাইহ’ নামের এক দরবারি আলেম ও প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে নেয়া ফতোয়ার ভিত্তিতে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে হত্যার জন্য জনগণকে উস্কানি দেয়। কুফার মসজিদে ইবনে জিয়াদ ওই ফতোয়া শুনিয়ে একদল মানুষকে ইমামের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে। ইবনে জিয়াদ কুফার মসজিদে সমবেত জনগণকে এই বলে হুমকি দেয় যে, তাদেরকে হয় ইমাম হুসাইনের (আ) বিরুদ্ধে সেনা-সমাবেশ ঘটাতে হবে অথবা মৃত্যু-বরণ-- এ দু'য়ের যে কোনো একটি পথ বেছে নিতে হবে! তারা যদি হুসাইন (আ)'র বিপক্ষে যুদ্ধ করে তবে তাদের পুরস্কার দেয়া হবে বলেও জিয়াদ ঘোষণা দেয়। ইবনে জিয়াদের নির্দেশে তৈরি করা কাজি শুরাইহ'র ওই ফতোয়ায় বলা হয়েছিল হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের তথাকথিত খলিফা ও 'আমিরুল মুমিনিন' ইয়াযিদের আনুগত্য করেননি, তাই তাকে দমন করা তথা তার রক্তপাত ঘটানো মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব। উল্লেখ্য, ইমাম হুসাইন কুফার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়া সত্ত্বেও ইয়াযিদি সেনাদের বাধার মুখে ৬১ হিজরির দোসরা মহররম কারবালায় পৌঁছেন।
তেসরা মহররম ইমাম হুসাইনের (আ) কাফেলাকে ঘেরাও করতে কারবালায় এসেছিল ইয়াযিদ বাহিনীর কমান্ডার ওমর সাদ। তার সঙ্গে আসে চার হাজার সেনা। কুফার ১৩ হাজার বিভ্রান্ত মুসলমান ইমাম হুসাইন (আ.)’র বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ওমর সাদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। এদের মধ্যে শিমার বিন জিল জুশান ছিল ওই ১৩ হাজার সেনার চার জন গ্রুপ-লিডারের অন্যতম। হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)’র নেতৃত্বে কারবালার মহাবিপ্লব খোদাদ্রোহী ও মুনাফিক চরিত্রের অধিকারী উমাইয়া শাসকদের স্বরূপ উন্মোচন করেছিল। ইসলামের নামে ধর্মান্ধতা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ চালু করেছিল ইয়াযিদি শাসক গোষ্ঠী। উমাইয়াদের রাজতান্ত্রিক ইসলামে বসেছিল দরবারি আলেমদের মেলা। লাখ লাখ জাল হাদিস প্রচার করে ইসলাম সম্পর্কে ধুম্রজাল ও বিভ্রান্তি জোরদার করা হয়েছিল সে সময়। ইসলামের খাঁটি নেতাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা ও ভণ্ড প্রকৃতির নেতাদের মাহাত্ম্য প্রচার করা ছিল তাদের স্বভাব।
উমাইয়া রাজশক্তির পক্ষ থেকে ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর মহান সঙ্গীদেরকে ‘ইসলামী হুকুমাতের’ বিরুদ্ধে বিদ্রোহী বলে প্রচার করা হয়েছিল। বলা হয়, হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে হত্যার জন্য উদ্যত সেনাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল নামাজি। তারা বলছিল: তাড়াতাড়ি হুসাইনের মাথা কাটো, নামাজ বা জামায়াতে নামাজ আদায়ের সময় পার হয়ে যাচ্ছে! এরা একবারও হয়তো চিন্তা করেনি যে, রাসূল (সা.)’র আহলে বাইতের একজন মহান সদস্যকে তারা হত্যা করতে এসেছে! আর আহলে বাইত (আ.)’র ওপর দরুদ পেশ করা ছাড়া নামাজ আদায় হয় না। উল্লেখ্য জাহেলি যুগেও আরব মুশরিক ও কাফিররা পবিত্র মহররম মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ করত না। কিন্তু উমাইয়া শাসনামলে মুসলমান নামধারী শাসকরা এতটাই হীন ও নীচ হয়ে পড়েছিল যে তারা রাসূলের(সা.) নাতি ও তাঁর পরিবারকে এই নিষিদ্ধ বা পবিত্র মাসেই নৃশংসভাবে শহীদ করতে কুণ্ঠিত হয়নি।
বাংলার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সে যুগের উমাইয়া শাসকদের প্রকৃতি তুলে ধরেছিলেন এভাবে: ওরে বাংলার মুসলিম তোরা কাঁদ্।..তখতের লোভে এসেছে এজিদ কমবখতের বেশে/ ! এসেছে সীমার, এসেছে কুফা'র বিশ্বাসঘাতকতা,ত্যাগের ধর্মে এসেছে লোভের প্রবল নির্মমতা !/মুসলিমে মুসলিমে আনিয়াছে বিদ্বেষের বিষাদ, ...কাঁদে আসমান জমিন, কাঁদিছে মোহররমের চাঁদ।/একদিকে মাতা ফাতেমার বীর দুলাল হোসেনী সেনা,আর দিকে যত তখ্ত্-বিলাসী লোভী এজিদের কেনা।….এই ধূর্ত ও ভোগীরাই তলোয়ারে বেঁধে কোরআন,আলী'র সেনারে করেছে সদাই বিব্রত পেরেশান!/এই এজিদের সেনাদল শয়তানের প্ররোচনায় হাসানে হোসেনে গালি দিতে যেত মক্কা ও মদিনায়।...#
পার্সটুডে/মু. আমির হুসাইন/মো.আবুসাঈদ/১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।