মার্কিন নও-মুসলিম মিসেস জ্যামিকা নিইল-এর ইসলাম গ্রহণের কাহিনী
সত্য ও বাস্তবতা এমন এক বিষয় যা কখনও ধামাচাপা দেয়া যায় না। যেমনটি বলা হয়, ‘ধর্মের ঢোল আপনিই বাজে’, ঠিক তেমনি ইসলাম প্রচারের জন্যও ঢোল-তবলার বা প্রচারণার দরকার হয় না। তাই সত্য-পিয়াসী মানুষের কাছে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বজনীনতা ঠিকই ফুটে ওঠে।
ইসলামের বিরুদ্ধে নানা বাধা, বিষোদগার ও নেতিবাচক প্রচারণা সাময়িকভাবে এর সৌন্দর্য ও বেহেশতী সৌরভকে অসচেতন ব্যক্তি বা অমুসলিমদের কাছে আড়াল করতে পারলেও সব বাধা ছাপিয়ে সত্য-পিয়াসীদের মনের মুকুরে স্থান করে নেয় ইসলামের অনির্বাণ আলো। প্রদীপ্ত সূর্যের আলোর মতই ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে দিগ-দিগন্তে। কেউ আগে বা কেউ পরে অফুরন্ত আলোর এ বন্যায় অবগাহন করে ধন্য করছেন নিজেদের। মার্কিন নও-মুসলিম মহিলা মিসেস “জ্যামিকা নিইল” এমনই সৌভাগ্যবানদের একজন। যৌবনেই ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণার পুরস্কার হিসেবে ঈমানের অমূল্য সম্পদ অর্জন করেছেন এই মার্কিন মহিলা।
এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন: “আমি জন্ম নিয়েছিলাম এক গোঁড়া খ্রিস্টান পরিবারে। (এ ধর্মের তুলে ধরা) যিশু খ্রিস্ট বা হযরত ঈসা মাসিহ (আ.)-এর আদর্শের সৈনিক ছিলাম আমি। বিশ্বের সব মানুষকে খ্রিস্টান বানিয়ে তাদের আত্মাকে মুক্ত করার স্বপ্ন দেখতাম। পবিত্র বাইবেল পুরোপুরি না পড়েই এর বক্তব্যগুলোয় শতভাগ বিশ্বাসী ছিলাম। কিন্তু একদিন এ বইয়ের একটা বিষয় নজরে পড়ল যার অর্থ আমার কাছে পুরোপুরি অবোধগম্য মনে হয়েছে। ভাবলাম এখনও এ বিষয়টা বোঝার মত বয়স হয়ত আমার হয়নি। তাই সেটা দেখালাম একজন খ্রিস্টান পণ্ডিতকে। কিন্তু তিনিও আমার সন্দেহকে সঠিক বলেই স্বীকার করলেন। এভাবে চিন্তার যে জগত আমি গড়ে তুলেছিলাম তা ধ্বসে পড়ল।”
এরপর জ্যামিকা পুরো বাইবেল পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তিনি যতই পড়ছিলেন ততই প্রশ্ন বাড়ছিল তার মনে। তিনি এ সম্পর্কে বলেছেন, “নিজেকে প্রশ্ন করতাম, কিভাবে আল্লাহ একই সময়ে এক ও তিন ব্যক্তি হতে পারেন? একবার মনে হল, এটা সম্ভবত: খোদা বা প্রভুর সত্তাগত বিষয়, তাই তা আমার উপলব্ধির উর্ধ্বের বিষয়। কিন্তু অচেনা ও অপরিচিত প্রভুর এবাদত করতে আমার মন সায় দেয়নি। অন্যদিকে “নিকিয়া পরিষদ’ও আমাকে নাড়া দিয়েছিল প্রচণ্ডভাবে। এই পরিষদের সদস্যরা মাটির পৃথিবীর মানুষ হয়েও নিজেদেরকে ঈশ্বরের মাধ্যমে পরিচালিত বলে দাবি করত এবং তারা এটা ঠিক করত যে কোন্ কোন্ অংশগুলোকে বাইবেলে রাখতে হবে ও বদলে ফেলতে হবে কোন্ কোন্ অংশগুলোকে!”
বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ধর্ম ইসলাম অজ্ঞতার নিন্দা করে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান, নৈতিকতা ও ঈমানের আলো ছড়িয়ে দেয়। পবিত্রতা ও সততার জন্য খ্যাত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র আলোকোজ্জ্বল অভিজ্ঞতাসহ ইসলামের এই নীতি-আদর্শ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ইসলামের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গী মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মানানসই বলেই তা সার্বজনীনতা লাভ করেছে। এ কারণেই সামাজিক অঙ্গনসহ মানব জীবনের সব ক্ষেত্রেই ইসলামের রয়েছে মহত্তম অবদান।
মানব-প্রকৃতির ধর্ম বলেই ইসলাম সব সময়ই মানুষকে চিন্তা ও গবেষণা করতে উৎসাহ যোগায় যাতে সত্যকে অবিকৃত ও যথাযথ আঙ্গিকে উপলব্ধি করা সম্ভব হয়। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওপর নাজিল হওয়া কুরআন ও ইসলামের মধ্যে যে উদ্ভট, অবাস্তব ও অযৌক্তিক কিছুর স্থান নেই তা স্পস্ট করার জন্যই জ্ঞান চর্চা ও গবেষণাকে গুরুত্ব দিয়েছে এই মহান ধর্ম।
ইসলাম সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে এ ধর্মকে নিজের বিবেক ও প্রকৃতির সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই দেখতে পেয়েছেন মার্কিন নও-মুসলিম মহিলা মিসেস “জ্যামিকা নিইল”। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “খ্রিস্ট ধর্মের মধ্যে এতসব অসঙ্গতি দেখার পরই স্রস্টার প্রতি বিশ্বাস হারাইনি। আমি শুধু এটাই বুঝতে পেরেছিলাম, আমি যে দিকে এগুতে চাচ্ছি খ্রিস্ট ধর্ম তার সঠিক পথ নয়, তাই বিশেষ কোনো ধর্মের প্রতি বিশ্বাস না রেখেই স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান ও গবেষণা শুরু করলাম। এসব গবেষণায় আমার অনেক সময় কেটেছে। ই-মেইলের মাধ্যমে অনেক ভাই-বোন আমাকে সহায়তা করতেন এবং আমার নানা প্রশ্নের জবাব দিতেন। তারা ইসলামের পথ ও প্রথা আমার কাছে তুলে ধরতেন। অবশেষে প্রকৃত সৌভাগ্যের পথ সম্পর্কে আমি নিশ্চিত উপলব্ধি অর্জন করে ইসলামকেই ধর্ম হিসেবে বেছে নিয়েছি।”
ইসলামে নারীর রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। এ ধর্ম মানবীয় দিক থেকে নারী ও পুরুষকে সমান মনে করে। কিন্তু নারী ও পুরুষের শারীরিক ও মানসিক পার্থক্যের আলোকে এ মহান ধর্ম তাদের দায়িত্ব এবং অধিকারের ন্যায়সঙ্গত সীমানা নির্ধারণ করেছেন। অন্য কথায় ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ হিসেবে নারীর ওপর পুরুষের এবং পুরুষের ওপর নারীর কোনো কর্তৃত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কেবল তাকওয়াই হল মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড।
সুরা হুজরাতের ১৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “হে মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেজগার। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন।”
মার্কিন নও-মুসলিম মহিলা মিসেস “জ্যামিকা নিইল” নারী হিসেবে তার প্রকৃত মর্যাদা ও অবস্থান খুঁজে পেয়েছেন পবিত্র ইসলাম ধর্মে। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “পশ্চিমা সমাজে নারীর অবস্থা ও নারী সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গী আমার কাছে কখনও পছন্দনীয় ছিল না। পাশ্চাত্যের জনগণের সাধারণ সংস্কৃতিতে নারীর কেবল যৌন বিষয়কেই গুরুত্ব দেয়া হয়। অথচ আমি বুঝতে পেরেছি যে, ইসলামে নারীর রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। ইসলাম মা হিসেবে নারীকে দেয় সর্বোচ্চ সম্মান এবং কেবল শারীরিক শক্তি ছাড়া সব ক্ষেত্রেই নারী ও পুরুষকে সমান মনে করে এই মহান ধর্ম। ইসলামের ইতিহাসে এমন অনেক মহিয়সী নারীর জীবনী দেখা যায় যারা স্বাবলম্বী ছিলেন। তাই এ ধর্ম আমার সম্মান অর্জনে সক্ষম হয়েছে, কারণ, এ ধর্মই নারী জাতিকে সম্মান করে।”
ইসলামের বিস্তারকে এমন ঢেউয়ের সাথে তুলনা করা যায় যা একটি নির্দিষ্ট বিন্দু থেকে সূচিত হওয়া সত্ত্বেও ছড়িয়ে যায় চারদিকে এবং ক্রমেই এর পরিধি বাড়তেই থাকে। আজ আমরা দেখছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ইসলাম এখন এক অনস্বীকার্য বাস্তবতা। অতীতে পশ্চিমারা ইসলামকে কেবলই কিছু নীতি-কথার ধর্ম এবং কখনও বা কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্ম বলে উল্লেখ করত। কিন্তু ইসলাম আজ এত ব্যাপকতা ও শক্তি অর্জন করেছে যে প্রাচ্যের ফরাসি চিন্তাবিদ ও ইসলাম-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক লা মান্দ বলছেন: “হারানো পথ ফিরে পাওয়ার জন্য পাশ্চাত্য ইসলামের মুখাপেক্ষী।” প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী সভ্যতা বিষয়ের অধ্যাপক লুই কার্ডোও বলেছেন, “বস্তুবাদী বা জড়বাদী পাশ্চাত্যে আধ্যাত্মিক শূন্যতার কারণে আধুনিক বিশ্ব এখন জড়বাদ ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে ভারসাম্যের চেষ্টা করছে। আর ইসলাম এই চাহিদা পুরণ করতে সক্ষম।”#
পার্সটুডে/আমির হোসেন/আশরাফুর রহমান/৯