স্বাস্থ্যকথা: শিশুর অতিরিক্ত চঞ্চলতা (এডিএইচডি) -পর্ব ৩
'শিশুর অতিরিক্ত চঞ্চলতা স্নায়ুবিকাশজনিত রোগ-অবহেলা করলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে'
প্রতিটি শিশু একেকজন গবেষক। তারা একেকজন পদার্থবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কিংবা দার্শনিক। এই যে বিজ্ঞানীসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পৃথিবী এবং জগৎটাকে উপলব্ধি করবে শিশু এবং তা বাস্তবায়ন করবে সেটা এডিএইচডি আক্রান্ত শিশুর পক্ষে করা সম্ভব হবে না। ফলে কীভাবে ঐ শিশুটি একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হবে! তাই অতিচঞ্চল শিশুর বিষয়ে অবহেলা না করে তাকে দ্রুত মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তা নাহলে ঐ শিশুর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
শিশুর চঞ্চলতা কি এডিএইচডি?
শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান স্বাস্থ্যকথার আসরে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশা করি আপনারা সবাই ভালো আছেন সুস্থ আছেন। দেহের মতো মনেরও রোগ হয় এবং তা দেহের রোগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। কখনও কখনও দেহের রোগের চেয়ে বেশি মারাত্মক হতে পারে। মনের বহু রকম রোগ আছে। আর সেই রোগ হতে পারে বড়দের শিশুদের সবার। আমরা আমাদের শিশু সন্তানের মনের রোগ নিয়ে এডিএইচডি নিয়ে আলোচনার তৃতীয় পর্বের আলোচনায় যাব। তার আগে বলে নিচ্ছি, সুস্থ–স্বাভাবিক শিশু খানিকটা চঞ্চল হবেই। সুস্থ শিশু মানেই হাসিখুশি ও দুরন্তপনা। তবে অতিচঞ্চল শিশুর সমস্যাকে বলা হয় অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার (এডিএইচডি)। বাংলায় এ সমস্যাকে বলে অতিচঞ্চল অমনোযোগিতা। এটি শিশুর একধরনের স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যা। আর বিষয়টি নিয়ে আমরা বাবা মায়েরা খুবই দুঃশ্চিন্তায় থাকি যদি আমাদের শিশু অতি চঞ্চল ও অমনোযোগী হয়। তো চলুন আজ এ বিষয়ক আলোচনার তৃতীয় পর্বে যাওয়া যাক। আমাদের সঙ্গে আরও অতিথি হিসেবে আছেন, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিস্টিউটের সাবেক বিভাগীয় প্রধান মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা.তাজুল ইসলাম।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও প্রযোজনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম রেডিও তেহরানের স্বাস্থ্যকথার আসরে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
রেডিও তেহরান: অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম আপনি গত দুই পর্বে শিশুর অতিচঞ্চলতা বা এডিএইচডি এবং করণীয় নিয়ে খুব সহজ সরল ও সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলেছেন। আমাদের শ্রোতা পাঠক বন্ধুরাও ওই আলোচনায় খুবই উপকৃত হয়েছেন। তো প্রসঙ্গে ধরেই আজকের আলোচনার শুরুতেই জানতে চাইব- ধরুন শিশুর বাহ্যিক চঞ্চলতা একেবারেই নেই-লাফালাফি, দুষ্টুমি এসব কিছুই করছে না বা অন্যের সাথে খারাপ আচরণও করছে না কিন্তু একা একা থাকছে এবং তার ভেতরে রয়েছে অসম্ভব চঞ্চলতা রয়েছে এটাকেও কি এডিএইচডি বলা যাবে?
অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম: জ্বি আপনি এডিএইচডির বেশ খানিকটা গভীরে চলে গেছেন। আমরা এর আগে এডিএইচডির সাধারণ সিমটম নিয়ে কথা বলেছি। এই এডিএইচডি বা শিশুর অতিরিক্ত চঞ্চলতার আবার কয়েকটি ভাগ আছে। আমরা ক্লাসিকাল টাইপগুলো আগে কথা বলেছি। এরবাইরে আরও ৪/৫ ধরনের ক্রাইটোরিয়া আছে। আমরা দুটো বিষয় বলেছি।
একটা হচ্ছে, Attention-deficit
অন্যটি হচ্ছে hyperactivity disorder।
দেখা যাচ্ছে শিশুটির হাইপার অ্যাক্টিভিটি নেই কিন্তু অ্যাটেনশান ডিফিসিট আছে। এটাকেও কিন্তু এডিএইচডির মধ্য ফেলতে হবে। আবার ঠিক উল্টোটাও হতে পারে। দেখা যাচ্ছে অ্যাটেনশান ডিফিসিট নেই কিন্তু হাইপার অ্যাক্টিভিটি আছে। তখনও এডিএইচডির মধ্যে পড়বে। আবার মিক্সড প্যাটার্নেরও হতে পারে। তবে এসবের জন্য অবজার্ভেশন খুবই জরুরি। তবে মূল যে তিনটি বৈশিষ্ট্য
১) Attention-deficit
২) hyperactivity disorder
৩) sustain cold directed beheavior করতে পারছে কি না।
অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিমুখী কাজ কর্ম করতে পারছে কি না? এইসব বৈশিষ্ট্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে দেখা যাবে বাচ্চাটির মিক্সড ধরণের এডিএইচডি থাকতে পারে। ফলে সেদিকে আমাদের নজর দিতে হবে।
রেডিও তেহরান: ডা. তাজুল ইসলাম, দেখুন, শিশুর অতি চঞ্চলতা আছে। কিন্তু আমরা এব্যাপারে খুব একটা গুরুত্ব দেই না। চিকিৎসকের কাছেও নিয়ে যাই না। অর্থাৎ গুরুত্ব দেই না। ভাবি একটু চঞ্চল ও ঠিক হয়ে যাবে। এমনও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়। তো যদি এভাবে গুরুত্ব না দেয়া হয় তখন ঐ বাচ্চার পরিণতি কি হতে পারে?
অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম: জ্বি আপনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন করেছেন। যদি এডিএইচডি আক্রান্ত শিশুর প্রতি যত্নশীল না হওয়া হয়, চিকিৎসা না করানো হয় তাহলে বাচ্চাটির বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যাবে। সাধারণ তার পেশীগত বিকাশ, আধ্যাত্মিক বিকাশ, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ এসব বিকাশ কিভাবে হয়? যখন একটা শিশু যখন পরিপূর্ণভাবে তার জীবনকে, তার পরিবশকে সঠিকভাবে প্রকাশ করে এবং মনোযোগ দিয়ে দেখে এবং সেখান থেকে শেখে। সেটি যদি সঠিকভাবে না হয় তাহলে তার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। তার আগামী জীবনও ব্যহত হবে।
শ্রোতাবন্ধুরা! শিশুর অতি চঞ্চলতা বা এডিএইচডি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুনছেন। ফিরছি খুব শিগগিরি। আমাদের সাথেই থাকুন।
রেডিও তেহরান: আবারও সাক্ষাৎকারে ফিরে এলাম। অধ্যাপক তাজুল ইসলাম, সাধারণ বাচ্চারা তো তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর ফোকাস করে শেখে, মনোযোগ দেয় জীবনের প্রতি। কিন্তু এডিএইচডির বাচ্চারা কি সেভাবে জীবনকে শিক্ষা নেয়া এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ফোকাস করতে পারে?
অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম: না, এডিএইচডির বাচ্চারা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর ফোকাস করে, জীবনের প্রতি মনোযোগ দিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না। ফলে এডিএইচডি আক্রান্ত বাচ্চাটি তার জীবন দক্ষতা হারিয়ে ফেলবে। এরফলে পরবর্তী জীবনে সে উৎপাদনশীল, মেধাবীভাবে বেড়ে ওঠার দ্বার তারজন্য রুদ্ধ হয়ে যাবে।
আগে তো বলেছি-ছোটবেলায় তো তার জীবনের বহু কিছুতে ব্যহত হয়েছে। স্কুলে দুষ্টুমি করা, লাফালাফি, ফালাফালি করেছে। নানারকমের দুর্ঘটনায় পড়েছে। কখনও কখনও ফাইটিং এ জড়িত হয়েছে। বাসাও বাচ্চাটিকে নিয়ে অনেক সমস্যা হয়েছে। অতএব চিকিৎসা না করালে কি সমস্যা হয় সেটি কিন্তু পরিবারের লোকেরাও বুঝতে পারে।
তবে এ প্রসঙ্গে একটু বলে রাখি, পরিবারের লোকেরা হয়তো মনে করে যে বাচ্চার এই দুরন্তপনা বা অতি চঞ্চলতা সময়ের সাথে সাথে একসময় কেটে যাবে। এই ধারণাটা ভুল। যাতে এই ধরনের ধারনা পরিবারের লোকেরা না করেন সেটি আপনার এই অনুষ্ঠান অর্থাৎ রেডিও তেহরানের স্বাস্থ্যকথা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমি সবাইকে জানাতে চাই। একটি বাচ্চা ছোট বেলায় তার পরিবার ও পরিবেশ থেকে এক্সপ্লোর করবে, মনোযোগ দিয়ে শিখবে। শিশুরা কিন্তু গবেষক। তারা একেক জন পদার্থবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। এই যে বিজ্ঞানীসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পৃথিবী এবং জগৎটাকে উপলব্ধি করবে এবং তা বাস্তবায়ন করবে সেটা তার পক্ষে করা সম্ভব হবে না। ফলে কিভাবে সেই ছেলে কীভাবে পূর্ণভাবে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হবে! এ বিষয়টি সব বাবা মাকে বুঝতে হবে।
রেডিও তেহরান: ডা. তাজুল ইসলাম সবশেষ যে প্রশ্নটি করব- আপনি বলছিলেন-আমাদের সন্তানদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক আছে, দার্শনিক আছে আরও অনেক অনেক কিছু। কিন্তু তার যদি এডিএইচডি থাকে তাহলে সে নিজেকে গড়তে পারবে না। ফলে তার চিকিৎসার ব্যাপারে বাবা মাকে সচেতন হতে হবে। আপনি ঐসব শিশুর বাবা মাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলুন।
অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম: জ্বি অবশ্যই ঐসব বাবা মাকে উদ্দেশ্য করে আমার পরামর্শ হচ্ছে- আপনার শিশু যদি এডিএইচডিতে আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে আপনাদেরকে সচেতন হতে হবে। সময় গেলে আপনার বাচ্চাটি ভালো হয়ে যাবে সুস্থ হয়ে যাবে এমন ধারণা করবেন না। তাহলে দেখবেন একসময় আপনার বাচ্চাটির কিছুই হয় নি। তখন কিন্তু আপনাদেরকেই পস্তাতে হবে। যখন দেখবেন এটি রোগের পর্যায়ে চলে গেছে। স্বাভাবিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না তখন তাকে মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে এবং চিকিৎসার আওতায় নিতে হবে। আমি আগেও বলেছি এজন্য কিছু সুনির্দিষ্ট ওষুধ আছে। এর মাধ্যমে কিন্তু অনেকটা ভালো হতে পারে। আর এরবাইরে কিছু থেরাপিও আছে।
অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম। শিশুর অতিচঞ্চলতা বা এডিএইচডি নিয়ে তিন পর্বের আলোচনা থেকে আমরা অনেক কিছু জানলাম এবং শিখলাম। তো এই তিনপর্বের আলোচনায় আমাদের সাথে থাকার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
তো শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! শিশুর অতিচঞ্চলতা একটি স্নায়ুবিকাশজনিত রোগ যাকে এডিএইচডি বলা হয়। চিকিৎসায় ওষুধ এবং নানারকম থেরাপির মাধ্যমে এটি ভালো হয়ে যায়। তবে শিশুকে মারধর করা যাবে না কিংবা বকাঝকা করা যাবে না। দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। কোনো রকম অবহেলা করা যাবে না।
তো আমাদের সব শিশুর সুস্বাস্থ ও সুন্দর জীবন কামনা করে স্বাস্থ্যকথার আসর এখানেই গুটিয়ে নিচ্ছি। অনুষ্ঠানটি কেমন লাগল চিঠি লিখে জানাতে ভুলবেন না। ভালো থাকুন সবাই।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৭