আলাপন
'বাংলাদেশে আজকের দুর্নীতির মূলে রয়েছে জবাবদিহিতা ও ভোটাধিকার না থাকা'
বাংলাদেশে ওয়াসার এমডি তাকসিম খানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগসহ বিভিন্ন দুর্নীতি, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, দুর্নীতিবাজদের বিচার না হওয়া প্রসঙ্গে রেডিও তেহরানকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার জোনায়েদ সাকি।
বিশিষ্ট এই রাজনীতিবিদ বলেন, আমাদের দেশের চাকুরীসহ বিভিন্ন বিষয়ে জবাবদিহিতার জায়গা যে নেই, একধরনের স্বেচ্ছাচারী শাসন যে এখানে আছে সেটা বোঝা যায় এই ধরনের ব্যক্তির একই অবস্থানে থাকার বিষয়টিতে।
একজন ব্যক্তিকে কীভাবে এতটা বছর একইপদে রাখা হয়! এর মধ্যদিয়ে কিন্তু খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়, অন্যদিকে আমাদের অক্ষমতাকে ভীষণভাবে প্রকাশ করে যে একজন ব্যক্তির আর কোনো বিকল্প নেই। যেকোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এটি একটি ভীষণ দুর্বলতা!
বাংলাদেশের আজকের দুর্নীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে জবাবদিহিতাহীন পরিস্থিতি এবং এদেশে কোনো ভোটাধিকার নেই। কোনো নির্বাচিনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জনগণ সরকার নির্ধারণ করতে পারে না।
পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: জনাব জোনায়েদে সাকি, ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে এবং এ নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নানা ধরনের তথ্যনির্ভর রিপোর্ট বের হচ্ছে। যদিও আগে এমন অনেক আরো দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে তো সেসব ঘটনাসহ এই ঘটনাটিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
জোনায়েদে সাকি: দেখুন, ওয়াসার এমডি'র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বাড়ি আছে এরকম একটি সংবাদ দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে এসেছে। পরবর্তীতে দেখেছি তিনি সেইসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে যেহেতু অভিযোগ এসেছে ফলে এ বিষয়ের যথাযথ তদন্ত হওয়া উচিত। তদন্তের মধ্য দিয়ে এখানে কোনো অনিয়ম এবং দুর্নীতির জায়গা আছে কিনা সেটা খুঁজে বের করা দরকার। কিন্তু মূল প্রশ্নটা থাকে যে একজন ব্যক্তিকে এক পদে এতদিন ধরে কীভাবে রাখা হয়? আর এটি একটি জববাদিহিতাহীন জায়গা তৈরি করে। আমাদের দেশের চাকুরীসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে জবাবদিহিতার জায়গা থাকে- সেটি যে নেই, একধরনের স্বেচ্ছাচারী শাসন যে এখানে আছে সেটা বোঝা যায় এই ধরনের ব্যক্তির একই অবস্থানে থাকার বিষয়টিতে।
রেডিও তেহরান: জোনায়েদ সাকি আপনার কথার সূত্র ধরেই জানতে চাইছি, তাকসিম এ খান-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকও। সেকথা তিনি নিজে বলেছেন। তো দ্বৈত নাগরিক একজন ব্যাক্তির পক্ষে দেশের একটি প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে থাকার আইনগতবৈধতা আছে কি না-তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যদি এসম্পর্কে একটু বলেন?
জোনায়েদে সাকি: জ্বি, নিঃসন্দেহে এটি একটি আইনি প্রশ্ন। একদিকে যেমন আইনগত প্রশ্ন যে একজন ব্যক্তিকে কীভাবে এতটা বছর একইপদে রাখা হয়! এর মধ্যদিয়ে কিন্তু খুবই খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়, অন্যদিকে আমাদের অক্ষমতাকে ভীষণভাবে প্রকাশ করে যে একজন ব্যক্তির আর কোনো বিকল্প নেই। যেকোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এটি একটি ভীষণ দুর্বলতা!
রেডিও তেহরান: জ্বি আমরা মূল যে প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছিলাম- তো এই দুর্নীতির মূল কারণ আসলে কি?
জোনায়েদে সাকি: মূল প্রসঙ্গটি হচ্ছে আসলে এখানে অর্থাৎ বাংলাদেশে সাধারণভাবে দুর্নীতি হচ্ছে। এরকারণ হচ্ছে জবাবদিহিতাহীন শাসন। দুর্নীতি আগেও ছিল কিন্তু বর্তমানে দুর্নীতির যে রূপ নিয়েছে এরসাথে আগের কোনো তুলনা হয়না। বর্তমানে দুর্নীতি বহুগুণ বেড়ে অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এরকম কোনো দৃষ্টান্ত আগে নেই। বর্তমান শাসনটা টিকে আছে বিভিন্ন ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা অবস্থান করেন তাদেরকে সুবিধাভোগী করে তোলা হয়। তাদেরকে যথেচ্ছভাবে দুর্নীতি করার সুযোগ দিয়েই কিন্তু শাসনটাকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যারা দুর্নীতি করছেন তারা এই শাসনকে টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে এটি একটি সিন্ডিকেট হিসেবে কাজ করছে।
ওয়াসার এমডির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এবং দেশের সামগ্রিক দুর্নীতি রাজনীতিবিদ জোনায়েদ সাকির সাক্ষাৎকার শুনছেন। ফিরছি খুব শিগগিরি আমাদের সাথেই থাকুন।
রেডিও তেহরান: আবারও ফিরে এলাম সাক্ষাৎকারে। জোনায়েদ সাকি, এই দুর্নীতির ফলাফল তো ভয়াবহ যা নাগরিক জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে-এই যে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হলো.. বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
জোনায়েদে সাকি: দেখুন, দুর্নীতির একটি ফলাফল হচ্ছে- এদেশে বিদ্যুৎ সংকট ছিল সেই সংকটের যে টেকসই সহজ সমাধানের জায়গাগুলো ছিল সেটা পরিহার করে কতিপয় ব্যক্তিকে লাভবান করার জন্য এই সংকটকে পুঁজি করে একটি পথে হাঁটা হলো। তারজন্য ভাড়া করা বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় যাওয়া হলো। সেগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখা হলো। আর এসবের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ ব্যাপারটিকে একটি খুবই ব্যয়বহুল জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো। দেশের গ্যাস না তুলে, দেশের জ্বালানীর ওপর নির্ভরশীল না হয়ে আমদানি নির্ভর জায়গায় যাওয়া কিংবা ভাড়াভিত্তিক জায়গায় যাওয়া, এটাকে ব্যয়বহুল করে মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া ও সেই টাকা কতিপয় মানুষের পকেটে যাওয়া-এই হচ্ছে এখানকার বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা। সরকার এতে এতই বেপরোয়া যে আগে যে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ছিল তাদের একটি শুনানির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম বাড়ান হতো এখন সরকার সেটাও নিজের হাতে নিয়ে নিচ্ছে এবং প্রতিমাসেই তারা তথাকথিত সমন্বয় করবে বলে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। অর্থাৎ পুরো বিদ্যুৎখাতে জবাবদিহিতাহীন লুণ্ঠন চলছে। সরকারের নীতিগত ভুলের কারণে অথবা লুটপাটবান্ধব নীতির কারণে তারা যে সংকট সৃষ্টি করেছে তার পুরো দায় এখন জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। আর এই জবাবদিহিতাহীন পরিস্থিতির মূল কারণ এদেশে কোনো ভোটাধিকার নেই। কোনো নির্বাচিনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জনগণ সরকার নির্ধারণ করতে পারে না। এটাই বাংলাদেশের আজকের দুর্নীতির মূল ভিত্তি।
রেডিও তেহরান: আগের অনেকগুলো ঘটনার প্রেক্ষাপটে মোটাদাগে বলা যায় যে, বড় বড় আর্থিক দুর্নীতি ও লুটপাটের ঘটনায় বেশিরভাগ লোকজন বিচার কিংবা শাস্তির মুখে পড়েনি।যেমন ব্যাংক দুর্নীতি, বিদেশে টাকা পাচার এবার ওয়াসার এমডির বিরুদ্ধে অভিযোগ- আপনার কি মনে হয় এই ঘটনাটিও তেমন হবে?
জোনায়েদে সাকি: দেখুন, শাসন ব্যবস্থা এমনভাবে কেন্দ্রীভূত এবং নানাভাবে শাসন ব্যবস্থার যারা সহযোগী তাদেরকেই বিভিন্নস্থানে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসানো হয়েছে। এসব মিলে একটা সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। যারা নিজেদের ইচ্ছে ও সুবিধা অনুযায়ী পরিচালনা করছে। ফলে বাংলাদেশে এখন প্রথম কাজ দাঁড়িয়েছে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। আর ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গেলে বিদ্যমান ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে সেটা সম্ভব না। ফলে ব্যবস্থাগত বদল করতে হবে। সেই কারণে আমরা বলছি যে, রাষ্ট্রে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রুপান্তর এই মুহূর্তে আমাদের প্রধান জাতীয় লড়াই। আর এ লড়াইয়ে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হয়ত একটা নতুন উত্তরণে যাবে। অন্যদিকে বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থা টিকে থাকা মানে ব্যাপকতর লুটপাট আরও বেশি জবাবদিহিতাহীনতা এবং আরও বেশি ক্ষমতার একচেটিয়া করণ হবে।
রেডিও তেহরান: অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে, তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকেই দুর্নীতির অভিযোগ ছিল এবং তার উচ্চ বেতনের রহস্য নিয়েও প্রশ্ন ছিল। তারপরও তিনি বহাল তবিয়তে কাজ করে গেছেন। আপনার কী মনে হয় সরকারের পক্ষ থেকে কোনো রকমের নির্লিপ্ততা ছিল?
জোনায়েদে সাকি: আমি তো দেখছি যে সরকার মোটেই নিলিপ্ত নয়। এইসমস্ত অনিয়ম, লুটপাট, দুর্নীতি, ভোট কেড়ে নেওয়া, মানুষের ওপর নির্যাতন ইত্যাদি বিষয়ে সরকার ভীষণ সক্রিয়। এসব কিছুই তো সরকারই পরিচালনা করছে। ফলে এতে আমি নির্লিপ্ততা দেখছি না বরং সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা দেখছি।
রেডিও তেহরান, জনাব জোনায়েদ সাকি, সবশেষে যে বিষয়টি জানতে চাইব, সেটি হচ্ছে তাকসিম খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে আমেরিকায় তার চৌদ্দটি বাড়ি রয়েছে এবং তিনি স্বীকার করেছেন তার স্ত্রীর নামে একটি বাড়ি আছে। এ সমস্ত অভিযোগ ও ঘটনার মধ্যে দুদক তদন্তে নেমেছে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে- বারবার এই ধরনের দুর্নীতি ও লুটপাটের ঘটনা কেন ও কিভাবে সম্ভব হচ্ছে-এটি একটি অনেক বড় প্রশ্ন?
জোনায়েদে সাকি: দেখুন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটা ক্ষমতার ভারসাম্য থাকবে। ফলে একটা জবাবদিহিতার জায়গা সৃষ্টি হবে। সংসদ, সরকার, বিচার বিভাগ- এগুলোর মধ্য যখন ক্ষমতার ভারসাম্য থাকে তখন জবাবদিহিতার জায়গা থাকে। তবে সবগুলো প্রতিষ্ঠান একটা প্রবল এককেন্দ্রীক ক্ষমতার অধিনস্ত। বাংলাদেশে রাষ্ট্র, দল ও সরকার সব একাকার হয়ে গেছে। একারণে কোনো কিছু আর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। ফলে দুর্নীতিকে সহায়তা করা হচ্ছে।
রেডিও তেহরান: জোনায়েদ সাকি রেডিও তেহরানের আলাপন অনুষ্ঠানে আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
জোনায়েদ সাকি: আপনাকেও ধন্যবাদ।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৮