কুরআনের আলো
সূরা আন-নাজম: আয়াত ৪৩-৬২ (পর্ব-৪)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠান কুরআনের আলোর এ পর্বে সূরা আন নাজম-এর ৪৩ থেকে ৬২ নম্বর আয়াতের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৪৩ থেকে ৪৯ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
(43) وَأَنَّهُ هُوَ أَمَاتَ وَأَحْيَا (44) وَأَنَّهُ خَلَقَ الزَّوْجَيْنِ الذَّكَرَ وَالْأُنْثَى (45) مِنْ نُطْفَةٍ إِذَا تُمْنَى (46) وَأَنَّ عَلَيْهِ النَّشْأَةَ الْأُخْرَى (47) وَأَنَّهُ هُوَ أَغْنَى وَأَقْنَى (48) وَأَنَّهُ هُوَ رَبُّ الشِّعْرَى (49) وَأَنَّهُ أَهْلَكَ عَادًا الْأُولَى
“আর তিনিই হাসান এবং তিনিই কাঁদান।” (৫৩:৪৩)
“আর তিনিই মারেন এবং তিনিই জীবিত করেন।”(৫৩:৪৪)
“আর তিনিই সৃষ্টি করেন জোড়ায় জোড়ায় পুরুষ ও নারী।”(৫৩:৪৫)
“শুক্রবিন্দু হতে, যখন তা [মাতৃগর্ভে] নিক্ষিপ্ত হয়।”(৫৩:৪৬)
“আর পুনরায় [আরেক জগত] সৃষ্টির দায়িত্বভার তাঁরই উপর।”(৫৩:৪৭)
“আর তিনিই অভাবমুক্ত করেন এবং সম্পদ দান করেন।”(৫৩:৪৮)
“আর তিনিই শি’রা [নক্ষত্রের] রব [কিছু লোক যার উপাসনা করত]।”(৫৩:৪৯)
গত আসরে গোটা বিশ্বজগতের ওপর আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌম ক্ষমতার কথা বর্ণনা করার পাশাপাশি একথাও বলা হয়েছিল যে, সবাইকে তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে। এরপর আজকের এই আয়াতগুলোতে সেকথার কিছু উদাহরণ পেশ করে বলা হচ্ছে: মানুষসহ সব প্রাণীর জীবন ও মৃত্যু আল্লাহরই হাতে রয়েছে। তোমরা কেউ নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসোনি এবং তিনিই তোমাদেরকে এ পৃথিবী থেকে নিয়ে যাবেন। নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করে অধিকতর আনন্দদায়ক জীবন উপভোগ করার জন্য তোমাদেরকে আল্লাহ তায়ালাই সুস্পষ্ট ভঙ্গিতে হাসি ও কান্নার ক্ষমতা দান করেছেন যা অন্য প্রাণীদের দেয়া হয়নি। তিনিই মানুষসহ সব প্রাণীর বংশধারা টিকিয়ে রাখার জন্য তোমাদের কাউকে নর এবং কাউকে নারী বানিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সামান্য শুক্রাণু দিয়ে অল্প কিছুদিনের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ নবজাতক আল্লাহই সৃষ্টি করেন।
একমাত্র আল্লাহই এই জগতের পর আরেকটি জগতের ব্যবস্থা করেছেন যেখানে তোমরা এই জগতের কর্মের ফল লাভ করবে। তোমরা জেনে রেখো, কোনো কর্মই বৃথা যায় না। আর আল্লাহই তোমাদেরকে কৃষিকাজ ও ব্যবসা বাণিজ্যসহ নানারকম কর্মযজ্ঞ শিখিয়েছেন যার মাধ্যমে তোমরা নিজেদের অভাব দূর করতে এবং ধন-সম্পদ অর্জন করতে পারো।
আল্লাহ তায়ালা যে শুধুমাত্র ভূপৃষ্ঠে বসবাসকারী প্রাণীদেরই প্রতিপালক তাই নন বরং মহাকাশে যেসব তারকারাজি রয়েছে তোমরা সেগুলোর নাম জানো বা না জানো সেগুলিরও স্রষ্টা ও প্রতিপালকও আল্লাহ তায়ালা। কাজেই হে কাফির ও মুশরিকরা! তোমরা এতকিছুর পরও কোন্ কারণে অন্যকে আল্লাহর সঙ্গে শরিক করো? তোমরা কেন আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো উপাসনা করো এবং তাদের সামনে নিজেদের মস্তক অবনত করো?
এই আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:
১- ভালো-মন্দ, জীবন-মৃত্যু, হাসি-কান্না ইত্যাদিকে দৃশ্যত পরস্পরবিরোধী মনে হলেও এগুলোর উৎস মহান আল্লাহ। তিনিই পৃথিবীকে মানুষের জন্য বসবাস উপযোগী করে তোলার জন্য এসব বিষয় সৃষ্টি করেছেন।
২- সব প্রাণীকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করে তাদের বংশধারা রক্ষা করা আল্লাহ তায়ালার অন্যতম অলৌকিক ক্ষমতা ছাড়া আর কিছু নয়।
৩- আমরা যেন ধন-সম্পদকে আমাদের নিজেদের উপার্জিত বলে মনে না করি। কারণ, যে মেধা ব্যয় করে এসব অর্জন করেছি তা আল্লাহ তায়ালাই আমাকে দিয়েছেন এবং এসব সম্পদের প্রকৃত মালিকও তিনিই।
এবারে এই সূরার ৫০ থেকে ৫৫ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
(50) وَثَمُودَ فَمَا أَبْقَى (51) وَقَوْمَ نُوحٍ مِنْ قَبْلُ إِنَّهُمْ كَانُوا هُمْ أَظْلَمَ وَأَطْغَى (52) وَالْمُؤْتَفِكَةَ أَهْوَى (53) فَغَشَّاهَا مَا غَشَّى (54) فَبِأَيِّ آَلَاءِ رَبِّكَ تَتَمَارَى (55) هَذَا نَذِيرٌ مِنَ النُّذُرِ الْأُولَى
“আর তিনিই প্রাচীন আদ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছিলেন। ” (৫৩:৫০)
“এবং [ধ্বংস করেছিলেন] সামুদ সম্প্রদায়কে, অতঃপর [তাদের কাউকেই] তিনি বাকি রাখেননি। ” (৫৩:৫১)
“এবং তাদেরও আগে [ধ্বংস করেছিলাম] নূহের সম্প্রদায়কে যারা ছিল অত্যন্ত জালিম ও চরম অবাধ্য।” (৫৩:৫২)
“আর তিনি (লূত জাতির) শহরগুলোকে উৎপাটিত করে নিক্ষেপ করেছিলেন।” (৫৩:৫৩)
“অতঃপর ওই শহরগুলোকে আচ্ছন্ন করল যা আচ্ছন্ন করার!” (৫৩:৫৪)
“সুতরাং [হে মানুষ!] তুমি তোমার রবের কোন অনুগ্রহ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করবে?” (৫৩:৫৫)
আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই আয়াতগুলোতে বলা হচ্ছে: কাফির ও জালিমরা কেন অতীত জাতিগুলোর পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয় না? তাদের কি জানা নেই কোনো কোনো সভ্যতাকে আমি তাদের পাপ, জুলুম ও ঔদ্ধত্বের কারণে ধ্বংস করে দিয়েছি? এবং তাদের কোনো অস্তিত্বই আজ আর অবশিষ্ট নেই? আদ, সামুদ, নূহ এবং লুত সম্প্রদায় নবীদের একত্ববাদের আহ্বান উপেক্ষা করে জুলুম করেছিল এবং চরম ঔদ্ধত্ব দেখিয়েছিল। এ কারণে এই পার্থিব জীবনেই তাদেরকে এমন কঠিন ঐশী আজাব পাকড়াও করে যে, সামান্য কয়েকজন ঈমানদার ও সৎকর্মশীল মানুষ ছাড়া সবাই ধ্বংস হয়ে যায়। এটি একটি বাস্তবতা যে, সমাজের কিছু মানুষ কুফরি, অকৃতজ্ঞতা ও জুলুম করে এবং আল্লাহর পার্থিব ও আধ্যাত্মিক অনুগ্রহগুলোকে স্বীকার করে না। এ ধরনের মানুষ আল্লাহর সঙ্গে এমন উদ্ধত ও অবাধ্য আচরণ করে যে, যে শাস্তি তাদেরকে কিয়ামতের দিন দেয়া হতো তার কিছুটা পার্থিব জীবনেই তারা পেয়ে যায়।
এই আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় কয়েকটি দিক হচ্ছে:
১- অতীত জাতিগুলোর ইতিহাস পড়ে তাদের খারাপ কাজের পরিণতি থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। তাহলে আমরা তাদের ভ্রান্ত পথ অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকতে পারব।
২- আল্লাহর শাস্তি যে শুধু কিয়ামতের দিন দেওয়া হবে তা নয় বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে জালিম ব্যক্তি পৃথিবীতেই তার কর্মফল ভোগ করে যায়।
৩- মানুষের উপর অত্যাচার এবং আল্লাহর নির্দেশের সামনে অবাধ্যতার কারণে অতীতের উদ্ধত জাতিগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে।
এবারে সূরা নাজমের ৫৬ থেকে ৬২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
(56) أَزِفَتِ الْآَزِفَةُ (57) لَيْسَ لَهَا مِنْ دُونِ اللَّهِ كَاشِفَةٌ (58) أَفَمِنْ هَذَا الْحَدِيثِ تَعْجَبُونَ (59) وَتَضْحَكُونَ وَلَا تَبْكُونَ (60) وَأَنْتُمْ سَامِدُونَ (61) فَاسْجُدُوا لِلَّهِ وَاعْبُدُوا (62)
“এ [নবীও] অতীতের সতর্ককারীদের মতই একজন সতর্ককারী।” (৫৩:৫৬)
“কিয়ামত অতি নিকটে।” (৫৩:৫৭)
“আল্লাহ ছাড়া কেউই এটা প্ৰকাশ করতে সক্ষম নয়।” (৫৩:৫৮)
“তোমরা কি এ কথায় বিস্ময় বোধ করছ!” (৫৩:৫৯)
“আর হাসি-ঠাট্টা করছ! এবং কাঁদছ না!” (৫৩:৬০)
“বৃথা খেল-তামাশায় সময় ক্ষেপণ করছ।” (৫৩:৬১)
“অতএব তোমরা কেবল আল্লাহকে সিজদা কর এবং [তাঁর] ইবাদত কর।’ (৫৩:৬২)
সূরা নাজমের এই শেষ আয়াতগুলোতে যেসব মানুষ উদাসীনতা ও অহংকারে লিপ্ত রয়েছে তাদেরকে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: তোমাদের কি হলো যে, তোমরা কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে উপস্থিত হয়ে নিজেদের কর্মযজ্ঞের হিসাব দেয়ার ব্যাপারে নবীদের সতর্কতা উপেক্ষা করছ? তোমরা কীভাবে পরকালকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মনে করছ। অথচ মৃত্যু অতি নিকটে এবং মৃত্যুর পরই কিয়ামত শুরু হয়ে যাবে। পার্থিব জীবন তোমাদের কাছে এতটা মোহনীয় হয়ে উঠেছে যে, তোমরা পরকালের ব্যাপারে উদসীন হয়ে গেছ। আল্লাহর ভয়ে কাঁদার পরিবর্তে তোমরা সারাক্ষণ হাসি-তামাশায় লিপ্ত রয়েছ। ঈমানদার ব্যাক্তিদের ধর্মবিশ্বাসকে কটাক্ষ করছ এবং তাদের সঙ্গে অবমাননাকর ভাষায় কথা বলছ?
এসব আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- আমরা যেন কিয়ামতকে অনেক দূরের কোনো বিষয় না ভাবি।
২- যদি আমরা পরকালীন মুক্তির কথা চিন্তা করি তাহলে পার্থিব জগতেই সেজন্য ব্যবস্থা করে যেতে হবে। কারণ, পার্থিব পুঁজি না থাকলে কিয়ামতের দিন আল্লাহর ক্রোধ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে না।
৩- শুধুমাত্র পার্থিব জগতের কর্মকাণ্ড করতে গিয়েই আমোদের কান্না পায় না। আল্লাহর প্রিয় ব্যক্তিরা কিয়ামতের দিন নিজেদের পরিণতি কেমন হবে সেই শঙ্কায় কেঁদে কেটে বুক ভাসাতেন এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেন।
৪- প্রত্যেক নামাজের প্রতি রাকাতের শেষে যে দুটি সিজদা দেওয়া হয় তা দিতে পারলে মানুষের পক্ষে অহংকার, উদাসীনতা ও অবাধ্যতার পাপ থেকে মুক্তিলাভ করা সম্ভব।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। মহান আল্লাহ এ আলোচনা থেকে আমাদের সবাইকে শিক্ষা গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন।#
পার্সটুডে/এমএমআই/এমবিএ/৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।