ধৈর্য ও ইমানের সম্পর্ক মাথার সঙ্গে দেহের সম্পর্কের মত: হযরত আলী (আ)
আসমাউল হুসনা' -৮৬ (সাবুর নামের তাৎপর্য)
মহান আল্লাহ'র আসমায়ুল হুসনার তালিকাভুক্ত আরেকটি নাম সাবুর। সাবুর হলেন তিনি যিনি নানা কষ্ট ও সংকট বা বিপদ-আপদ ধৈর্য ধরে সহ্য করতে পারেন বা এক কথায় যিনি ধৈর্যশীল।
সাব্র্ বা ধৈর্য ও এ সম্পর্কিত শব্দ পবিত্র কুরআনে অন্তত ৯০ বার এসেছে। আর প্রতিবারই এই শব্দের সঙ্গে এসেছে নানা কল্যাণমূলক বিষয়ের কথা। মহান আল্লাহ'র সাবুর হওয়ার অর্থ বান্দাহদের পাপ, কুফর, শির্ক ও বিদ্রোহের বা নাফরমানির মোকাবেলায় কোনো জবাব না দেয়া বা কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখানো। কারণ মহান আল্লাহ মানুষকে ইবাদত বা দাসত্বের জন্য সৃষ্টি করা সত্ত্বেও তাদেরকে সঠিক ও ভুল পথের যে কোনো একটি বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন বিবেক-বুদ্ধি ও নবী-রাসুল পাঠানোর পাশাপাশি। মহান আল্লাহ চাইলে পাপীকে ও খোদাদ্রোহীকে পাপ বা বিদ্রোহ করার সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস করে দিতে পারেন। কিন্তু তিনি পাপী ও খোদাদ্রোহীকে সুপথ গ্রহণের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেন যাতে তারা বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হতে পারে।
মহান আল্লাহ'র সাবুর নাম তাঁর হালিম নামের কাছাকাছি। মানুষের ক্ষেত্রে হালিম বলতে এমন মানুষকে বোঝায় যিনি ক্রোধ ও উত্তেজনার পরিস্থিতিতেও এসবের শিকার না হয়ে প্রশান্ত ও সহিষ্ণু এবং আত্মবিশ্বাসে অবিচল থাকেন। তাই ক্রোধের বিপরীতেই বেশি ব্যবহার করা হয় হালিম শব্দটি। অন্যদিকে হালিম-এর তুলনায় সাবুর আরও ব্যাপক ও সামগ্রিক অর্থবোধক। কারণ সাবুর পর্যায়ের ধৈর্য অর্জন করতে হলে শয়তানের কুমন্ত্রণা, মনের খেয়ালিপনা বা মন্দের প্রতি আকর্ষণ মোকাবেলার পাশাপাশি আল্লাহর আনুগত্য করার ও দাসত্ব বা ইবাদত করার কষ্টগুলোও সহ্য করতে হয় এবং নানা বিপদ-আপদের মোকাবেলায় শান্ত ও স্বাভাবিক থেকে নিজের জিহ্বা ও শরীরের অঙ্গগুলোকেও সংযত রাখতে হয়।
মহান আল্লাহ সাবুর বা ধৈর্যশীল। তাই তিনি নবী-রাসুল ও তাঁদের অনুরাগী বা অনুসারী সবাইকেও এই গুণ অর্জনের আহ্বান জানান। নানা বিপদ-আপদে ধৈর্য ধরে ধর্মের ও সত্যের আহ্বান জানানো এবং সেই পথে নানা কষ্ট ও সংকটে অবিচল থাকাই যে সাফল্য বা বিজয়ের রহস্য মহান আল্লাহ তা উল্লেখ করেছেন পবিত্র কুরআনে। তাই পবিত্র কুরআনে এ শব্দ বা এ সম্পর্কিত শব্দ ৯০ বারেরও বেশি এসেছে। যেমন, মহান আল্লাহ সুরা বাকারার ১৫৩ নম্বর আয়াতে বলেছেন, হে ইমানদাররা, তোমরা ধৈর্য ও নামাজের সহায়তা নাও, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে রয়েছেন।- আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী-আ. বলেছেন, তোমরা ধৈর্যশীল হও। ধৈর্য ও ইমানের সম্পর্ক মাথার সঙ্গে দেহের সম্পর্কের মত। মাথা ছাড়া দেহ যেমন মূল্যহীন তেমনি ধৈর্য ছাড়া ইমানেরও কোনো কল্যাণ নেই।মহান আল্লাহ'র সাবুর নাম সম্পর্কে যারা সচেতন তারা বিপদে আপদে ধৈর্য ধরেন ও তাদের মুখ ও অন্তরকেও শান্ত রাখেন। ধৈর্য মহান আল্লাহর প্রতি মুমিন মানুষের প্রেমময় সম্পর্ককে জোরদার করে। ধৈর্যশীল মানুষ আল্লাহর বিশেষ রহমত, সম্মান ও ক্ষমা লাভ করেন। ফলে ধর্মের পথে এ ধরনের মানুষ অবিচল থাকেন।
মুমিনের জীবনে যখন মহান আল্লাহর সাবুর নামের প্রতিফলন ঘটে তখন তাঁরা আল্লাহর প্রিয়পাত্র হন। হযরত আইয়ুব (আ) ধৈর্যের খোদায়ি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এই মহান নবী কেবল তাঁর সব সম্পদই হারাননি, তাঁর সন্তানদেরও হারিয়েছিলেন। এমনকি তিনি নিজেও কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সন্তানদের মৃত্যু ও এতসব হারানো সত্ত্বেও মহান আল্লাহর প্রতি তাঁর অনুরাগ ও কৃতজ্ঞতা-বোধ এবং বিনম্রতা তো কমেনি বরং বেড়ে যায়। মহান আল্লাহর দরবারে তাঁর বিনম্র প্রার্থনার মাত্রা বেড়ে যায় ! তাই মহান আল্লাহ আবারও তাঁকে সব নেয়ামত ফিরিয়ে দেন। সুরা সাদ-এর ৪৩ ও ৪৪ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: আমি তাঁকে দিলাম তার পরিজনবর্গ ও তাঁদের মত আরও অনেক আমার পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ এবং বুদ্ধিমানদের জন্যে উপদেশস্বরূপ।.... আমি তাঁকে পেলাম সবকরই। চমৎকার বান্দা সে। নিশ্চয় সে ছিল আমার দিকে প্রত্যাবর্তনশীল।–
অবশ্যই ধৈর্যের ন্যুনতম পুরস্কার হলে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও চিরস্থায়ী বেহেশত। সব সৎ কাজেরই রয়েছে সুনির্দিষ্ট পুরস্কার। তবে সুরা জুমার-এর দশ নম্বর আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী কিয়ামতের দিন তথা বিচার দিবসে ধৈর্যশীল মুমিনরা সীমাহীন বা অপরিমেয় মাত্রায় পুরস্কার পাবেন। সুরা রায়াদ-এর ২৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, সেদিন তাদের বলা হবে, ধৈর্য ও অধ্যবসায় বা প্রতিরোধের কারণে তোমাদের প্রতি সালাম। সেই চিরস্থায়ী আবাস বা বেহেশত কত উত্তম পরিণতি!-নবী-রাসুলদের মধ্যে মহানবী (সা) ছিলেন সর্বোত্তম ধৈর্যশীল ও মহাসহিষ্ণু! তাঁর প্রতি কত পরিহাস করা হয়েছে ও কত মিথ্যাচার আর অপবাদ তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে। তবুও মহান আল্লাহ তাঁকে নানা বিপদ-আপদ, প্রতিকূলতা ও বিরোধিতার মোকাবেলায় সর্বোচ্চ ধৈর্য ও 'সৌন্দর্যময় সহিষ্ণুতা' বা সাবরে জামিল অবলম্বন করতে বলেছেন! ফলে কঠিনতম পরীক্ষার মধ্যেও তিনি ছিলেন পাহাড়ের মত অবিচল ও মহাকাশের মত প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী।
হযরত ইমাম হুসাইন-আ ও তাঁর বোন হযরত যাইনাব-সা.ও ছিলেন ধৈর্যের অনন্য আদর্শ বা প্রতীক। যখন খোদাদ্রোহী ইয়াজিদ হযরত যাইনাবকে উপহাসমূলক এ প্রশ্ন করে, দেখলে তো আল্লাহ তোমাদের সঙ্গে কি আচরণ করলেন ও কারবালায় তোমাদের ওপর কি-সব নাজিল হল? তখন হযরত যাইনাব ইমাম হুসাইনের শিবিরের সবার আত্মত্যাগ ও বীরত্বের সৌন্দর্যকে তুলে ধরলেন এই অমর বাক্যটি উচ্চারণ করে: 'মা রায়াইতু ইল্লা জামিলা' অর্থাৎ আমিতো সৌন্দর্য ছাড়া আর কিছুই দেখিনি। - এ বাক্যটি মহীয়সী নারী হযরত যাইনাবের অশেষ ধৈর্য ও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টির উচ্চতম মাত্রাকে তুলে ধরে। তিনি এর মাধ্যমে বলতে চেয়েছেন আমরা তথা মহানবীর (সা.) পরিবার সর্বাবস্থায় আল্লাহর নির্দেশের অনুগত এবং আল্লাহর নির্ধারিত অবস্থাতে সন্তুষ্ট, কঠিনতম বিপদ ও পরীক্ষার মধ্যেও আল্লাহর প্রতি বিন্দুমাত্রও অভিমান জাগে না আমাদের!#
পার্সটুডে/এমএএইচ/০৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।