কুরআনের আলো
সূরা আর-রহমান : আয়াত ১-৯ (পর্ব-১)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। গত আসরে আমরা সূরা কামারের আলোচনা শেষ করেছি। কাজেই আজ আমরা পবিত্র কুরআনে এটির পরবর্তী সূরা অর্থাৎ সূরা আর-রহমানের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপনের চেষ্টা করব। এই সূরাটি আর-রহমান শব্দ দিয়ে শুরু হয়েছে যা আল্লাহ তায়ালার অন্যতম গুণবাচক নাম। সৃষ্টিজগতের প্রতি মহান আল্লাহর রহমত বা দয়া যে কতোটা বিস্তৃত ও ব্যাপক তা এই শব্দের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
এছাড়া, এই সূরায় পার্থিব জীবন ও পরকালে মানুষের প্রতি আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য বস্তুগত ও আত্মিক নিয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর আল্লাহর বান্দাদের বারবার প্রশ্ন করা হচ্ছে- তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন কোন নিয়ামত অস্বীকার করবে?
তো প্রথমেই এই সূরার ১ থেকে ৪ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
الرَّحْمَنُ (1) عَلَّمَ الْقُرْآَنَ (2) خَلَقَ الْإِنْسَانَ (3) عَلَّمَهُ الْبَيَانَ (4)
“আর-রহমান। অর্থাৎ অনন্ত করুণাময় (আল্লাহ)।” (৫৫:১)
“তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন।”(৫৫:২)
“তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ।”(৫৫:৩)
“তিনিই তাকে শিখিয়েছেন মনের কথা প্রকাশ করতে।”(৫৫:৪)
পবিত্র কুরআনে মহান প্রতিপালকের নাম ‘আল্লাহ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং রহমান তাঁর একটি গুণবাচক নাম। এই গুণবাচক নামটি আল্লাহ তায়ালার অসীম রহমতের বিষয়টি প্রকাশ করে। কিন্তু পবিত্র কুরআনে এই নামটি আল্লাহর পরিবর্তে এতবার ব্যবহৃত হয়েছে যে, এটি আল্লাহর নামের বিকল্পে পরিণত হয়েছে। এই সূরায় রহমান নামটি আল্লাহর নামের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে পবিত্র কুরআন নাজিল ও তা রাসূলের মাধ্যমে মানুষ ও জ্বিন জাতিকে শিক্ষা দেয়ার ঘটনা এত বেশি মর্যাদাপূর্ণ যে, এই সূরায় কাজটিকে মানুষ সৃষ্টির চেয়েও অগ্রগণ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। মানুষ তখনই মানবীয় গুণাবলীতে বিকশিত হয়ে উঠতে পারে যখন সে আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলে এবং আল্লাহর গুণে নিজেকে গুনান্বিত করে নেয়।
মানুষের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যের মধ্য থেকে এখানে তার কথা বলার যোগ্যতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যা মানুষকে অন্যান্য জীব-জন্তু থেকে আলাদা করে তোলে। জন্তু-জানোয়ারেরও মানুষের মতো চোখ, কান, মুখ, জিহ্বা থাকলেও তারা মানুষের মতো করে কথা বলতে পারে না।
এখানে এ বিষয়টিও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কথা বলার সক্ষমতার ব্যাপক অর্থের মধ্যে লেখা এবং পড়াও অন্তর্ভুক্ত। মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যতখানি উন্নতি করেছে তা সম্ভব হয়েছে কথা বলার এই যোগ্যতার কারণেই। মানুষ কথা বলতে পারে বলেই তার সারাজীবনে অর্জিত অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করে রেখে যেতে পেরেছে এবং মানব সভ্যতা একটু একটু করে উন্নতি সাধনের মাধ্যমে আজকের অবস্থায় উপনীত হয়েছে।
এই আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:
১- আল্লাহ তায়ালার যে গুণের আওতায় কোনোরকম বাছবিচার ছাড়াই সকল সৃষ্টি অন্তর্ভুক্ত তা হচ্ছে রহমত। মহান আল্লাহ চান মানুষ যেন প্রতিটি কাজ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম দিয়ে শুরু করার মাধ্যমে এসব কাজে তাঁর রহমতের পরশ বুলিয়ে নেয়।
২- শিক্ষকতা আল্লাহ তায়ালার অন্যতম মর্যাদা। মানব জাতির প্রথম শিক্ষক খোদ আল্লাহ তায়ালা এবং এই শিক্ষকতার প্রধান গুণ হচ্ছে রহমত।
৩- যেকোনো শিক্ষা গ্রহণ করার যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ সৃষ্টি আল্লাহ তায়ালার রহমতেরই বহিঃপ্রকাশ। মানবজাতিকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য কুরআন শিক্ষা দেয়ার ঘটনায়ও আল্লাহ তায়ালার অফুরন্ত দয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
৪- জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনে কথা বলার শক্তি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে এবং এখানেও আল্লাহর রহমত বা দয়ার প্রকাশ ঘটেছে।
এবারে সূরা আর-রহমানের ৫ ও ৬ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ بِحُسْبَانٍ (5) وَالنَّجْمُ وَالشَّجَرُ يَسْجُدَانِ (6)
“সূর্য ও চন্দ্রের রয়েছে নির্ধারিত হিসাব।” (৫৫:৫)
“আর তৃণলতা ও গাছপালা (তাঁরই জন্য) সাজদায় অবনত।”(৫৫:৬)
এই দুই আয়াতে আসমানের প্রতি দৃষ্টিপাত করার পর জমিনের প্রতি আলোকপাত করে বলা হয়েছে: সূর্য ও চন্দ্র নির্ধারিত হিসাব ও শৃঙ্খলা অনুযায়ী আবর্তিত হচ্ছে। এগুলোর ওজন ও ভর, ভূপৃষ্ঠ থেকে চন্দ্র ও সূর্যের এবং তাদের পরস্পরের দূরত্ব এ সব কিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সূর্য থকে পৃথিবীর নির্ধারিত দূরত্ব যদি সামান্য কমবেশি করা হয় তাহলে ভূপৃষ্ঠের সকল প্রাণি প্রচণ্ড গরম অথবা প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মারা পড়বে। এছাড়া, নিজ কক্ষপথে পৃথিবীর ঘুর্ণয়নের ফলে দিন-রাত সৃষ্টি এবং বছরে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার ফলে মাস ও ঋতু সৃষ্টি হওয়ার ঘটনাও সেই সৃষ্টিজগতের শৃঙ্খলা ও সূক্ষ্ম হিসাবনিকাশের কারণেই সম্ভব হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, চন্দ্র ও সূর্য এতটা সূক্ষ্মভাবে নিয়ম মেনে চলে যে, বহু বছর আগেই সুনির্দিষ্টিভাবে চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের দিনক্ষণ বলে দেওয়া সম্ভব।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সূর্যের মতো বিশাল অগ্নিগোলক মানুষের জন্য আল্লাহ তায়ালার বড় নেয়ামতগুলোর একটি। কারণ, সূর্যের আলো ও উত্তাপ ছাড়া পৃথিবীর কোনো প্রাণির পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। বীজ থেকে উদ্ভিদের অঙ্কুরোদ্গম, গাছ থেকে মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ ইত্যাদি সবকিছুই সম্ভব হয়েছে এই সূর্যের কারণে।
চন্দ্রও তার নিজস্ব পরিমণ্ডলে মানবজাতির বেঁচে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চাঁদ অন্ধকার রাত্রে জোসনা দিয়ে মানুষের জন্য আলোর ব্যবস্থা করে। চন্দ্রের আকর্ষণে ভূপৃষ্ঠে যে জোয়ার-ভাটা এবং ভরা কটাল ও মরা কটাল সৃষ্টি হয় তা সাগর ও নদীর পানিপ্রবাহের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে এবং এই পানিপ্রবাহ দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়। এছাড়া, পৃথিবীর বুকে রয়েছে নানারকম গাছপালা ও তৃণলতা যেগুলো মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীর খাদ্যের উৎস। এই গাছপালা আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত নিয়ম মেনে চলে এবং বিন্দুমাত্র নিয়মের বরখেলাফ করে না।
এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- আসমান ও জমিন একটি সুনির্দিষ্ট ও সুনির্ধারিত নিয়মে চলে। কেউই আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত গতিপথ লঙ্ঘন করে না।
২- বিশ্বজগত সর্বোচ্চ উপায়ে মানব জাতির সেবায় নিয়োজিত। কিন্তু সেই মানবজাতি এই প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসের কাজে উঠেপেড়ে লেগে আছে।
৩- গোটা বিশ্বজগত আল্লাহ তায়ালার পূর্ব নির্ধারিত নিয়ম মেনে চলার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ আনুগত্য পালন করছে।
এবারে সূরা আর-রহমানের ৭ থেকে ৯ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
وَالسَّمَاءَ رَفَعَهَا وَوَضَعَ الْمِيزَانَ (7) أَلَّا تَطْغَوْا فِي الْمِيزَانِ (8) وَأَقِيمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَلَا تُخْسِرُوا الْمِيزَانَ (9)
“আর [আল্লাহ] আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং [প্রতিটি বিষয় পরিমাপের জন্য] স্থাপন করেছেন দাঁড়িপাল্লা।”(৫৫:৭)
“যাতে তোমরা ওজনে ও পরিমাপে সীমালংঘন না কর।”(৫৫:৮)
“আর তোমরা ওজনের ন্যায্য মান প্রতিষ্ঠিত কর এবং ওজনে কম দিও না।”(৫৫:৯)
আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই তিন আয়াতে সুবিশাল আসমান সৃষ্টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যেখানে রয়েছে হাজার হাজার কোটি গ্রহ ও নক্ষত্র এবং সেগুলো নিজ নিজ কক্ষপথে সুশৃঙ্খলভাবে আবর্তিত হচ্ছে। এরপর বলা হচ্ছে, যে আল্লাহ তায়ালা এই সুবিশাল আসমান সৃষ্টি করেছেন তিনি পার্থিব জীবনের লেনদেনের জন্য মানদণ্ড নির্ধারণ করেছেন যাতে তোমরা সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকতে এবং অন্যায় থেকে দূরে থাকতে পারো। তোমরা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে এবং আর্থিক লেনদেনে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য করে চলবে এবং অপরের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি এড়িয়ে চলবে। সব সময়ের মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা ও লেনদেনের ক্ষেত্রে তোমরা ন্যায়সঙ্গত মানদণ্ড বজায় রাখবে।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:
১- সুবিশাল বিশ্বজগত সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা ও মানদণ্ডের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে। কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়া হঠাৎ করেই এসব সৃষ্টি হয়ে যায়নি।
২- আল্লাহর সৃষ্টিজগত যেমন নির্দিষ্ট মানদণ্ডে পরিচালিত হচ্ছে তেমনি মানুষকে তার দৈনন্দিন কাজকর্ম ও লেনদেনে ভারসাম্য বজায় রাখতে বলা হয়েছে। আর এ কাজের জন্য সহায়ক হিসেবে নবীরাসূল ও কিতাব পাঠানো হয়েছে এবং মানুষকে দেয়া হয়েছে বিবেক বা সুস্থ বুদ্ধিবৃত্তি।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। মহান আল্লাহ এ আলোচনা থেকে আমাদের সবাইকে শিক্ষা গ্রহণ করার তৌফিক দান করুন।
পার্সটুডে/এমএমআই/এমবিএ/১৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।