এপ্রিল ৩০, ২০২৩ ১৬:০৫ Asia/Dhaka

আজকের আলোচনা শুরু করব ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট এপিজে আবুল কালামের একটি উক্তি দিয়ে। তিনি বলেছেন, একটি জাতি অনেক ব্যক্তির প্রভাবে দুর্নীতি-মুক্ত ও সুন্দর নানা ভাবনার অধিকারী হতে পারে, আর এক্ষেত্রে যে তিন শ্রেণীর অবদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তারা হলেন বাবা, মা ও শিক্ষক। 

বর্তমান যুগের একটি বড় সংকট হল পারিবারিক সহিংসতা। ক্লান্ত-শ্রান্ত মানুষেরা পরিবারে এসে যখন নিতে চান বিশ্রাম ও পেতে চান প্রশান্তির পরশ এবং ভুলে যেতে চান বাইরের জগতের নানা কষ্ট ও মানসিক চাপ তখন যদি পরিবার সেসবের আশ্রয়স্থল না হয়ে বরং হয় সহিংসতা, দ্বন্দ্ব ও প্রতিহিংসার কেন্দ্রস্থল তখন তা সত্যিই মর্মান্তিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাইরের চেয়েও বেশি মাত্রায় অশান্তির এই আগুন ঘরে ঘরে জ্বালানোর জন্য যারাই দায়ি হন না কেন তা আজ বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই এক করুণ বাস্তবতা। দেশে দেশে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনেরও অনেক ভূমিকা রয়েছে এই পারিবারিক অশান্তির পেছনে।

 বৈশ্বিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে পারিবারিক সহিংসতার শতকরা ৯০ ভাগ শিকারই হচ্ছেন নারী এবং অন্য দশভাগ হচ্ছেন পুরুষ। দেখা গেছে পুরনো সামাজিক ধারায় পারিবারিক সহিংসতার মাত্রা ছিল বেশি এবং সেসব গোপন রাখার কারণে প্রতিকারও অন্য সমাজগুলোর তুলনায় বেশ কঠিন ছিল।  

পারিবারিক সহিংসতার শতকরা ৯০ ভাগ শিকারই হচ্ছেন নারী এবং  দশভাগ হচ্ছেন পুরুষ

অবশ্য কথিত আধুনিক পশ্চিমা সমাজে নারীর প্রতি আইনি সহায়তার বিধান থাকা সত্ত্বেও সেখানকার পরিবারগুলোতেও বিপুল সংখ্যক নারী সহিংসতা ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী দেশটিতে ২০১৭ সালে ১০০ জনেরও বেশি নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। দেশটিতে সাবেক কিংবা বর্তমান স্বামী বা স্ত্রীর হাতে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ১২৫ জন এবং এদের মধ্যে ১০৯ জন হলেন নারী ও ১৬ জন হলেন পুরুষ।  

পরিবারগুলোতে নারীরা দৈহিক, যৌন ও মানসিক বা চিন্তাগত সহিংসতার শিকার হচ্ছে। অনেক সময় দৈহিক বা মানসিক দিক থেকে পঙ্গু নারী ও এমনকি শিশুরাও এ ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। শিশুদের ওপর এসব নির্যাতনের তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেখা যায়। এসব শিশু যখন বড় হয় তখন তারাও অনেক সময় সহিংসতার ঘটনা থেকে কুশিক্ষা নিয়ে নিজ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঠিক একই ধরনের ন্যাক্কারজনক আচরণ করে যা করা হয়েছিল তাদের ওপর। এভাবে সহিংসতার বিষাক্ত চক্র যুগ যুগ ধরে অব্যাহত থাকে! দেখা গেছে অপরাধীদের ৮০ শতাংশই সহিংস পরিবেশ দেখেই বড় হয়েছে। যেসব ছেলে পারিবারিক সহিংসতা দেখে বড় হয়েছে তাদের ৭০ শতাংশই অন্যদের চেয়ে পরিবারের নারীর প্রতি বেশি সহিংস আচরণ করে থাকে। এভাবে এক শ্রেণীর পুরুষ পরিবারে মোড়লীপনা দেখাতে গিয়ে সহিংস আচরণের মাধ্যমে বা জুলুম করার মাধ্যমে অন্যদের জন্যও নির্যাতক ও নির্যাতিত শ্রেণী গড়ে তুলছে! 

দুঃখজনক ব্যাপার হল সংসারকে টিকিয়ে রাখতে অনেক নারীই মুখ বুজে সংসারে পুরুষের বা স্বামীর দৈহিক ও মানসিক জুলুম সহ্য করেন। ব্যাপারটা এমন যে নির্যাতন সইতে সইতে তারা এসবকে জীবনের এক স্বাভাবিক অংশ বলেই যেন মেনে নিচ্ছেন। নিরবতা ও প্রতিবাদহীনতার কারণে এ ধরনের নির্যাতন জোরদার হচ্ছে। 

স্বামীর উচিত নয় স্ত্রীকে নিজের দাসী বা কর্মী ভাবা

 

পারিবারিক সহিংসতা হতে নারীকে রক্ষা করতে ও এ ধরনের সহিংসতা বন্ধ করতে বহু দেশেই নানা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ পরিবার পর্যন্ত পৌঁছে না অনেক ক্ষেত্রেই! অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার নারী বা স্ত্রী সম্ভাব্য প্রতিশোধের ভয়ে নির্যাতকের বিরুদ্ধে মামলা বা সালিশের শরণাপন্ন হতেও ভয় পান।

এটা স্পষ্ট পরিবারের ভেতরেই যদি নারী বা মা নিরাপদ না থাকেন তাহলে তারা সন্তানকে সুশিক্ষিত করার দায়িত্বও যথাযথভাবে পালন করার সুযোগ পাবেন না। সহিংসতার শিকার মায়েরা আত্মবিশ্বাসের অভাবে হতাশার শিকার হন ও ক্রমেই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

ইসলামের দৃষ্টিতে স্বামী ও স্ত্রীকে পরস্পরের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তাই তাদের পারস্পরিক সদাচরণ খুবই জরুরি। তাদের সম্পর্ক হওয়া উচিত সব সময়ই প্রেমময় ও দয়াপূর্ণ। কেবল খোদায়ি আইনের আলোকে তারা কখনও একে-অপরের প্রতি কিছুটা কঠোর হতে পারেন। পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে পরিবারের নারীরা কোমল ফুলের মত। তাই খুবই সচেতনতা ও যত্ন নিয়ে তাদের সঙ্গে আচরণ করা উচিত।

স্বামী-স্ত্রী  যেন একই দরজার দুই কপাট, একই চেহারার দুই চোখ, একই বাংকারের দুই সেনা!..

রানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ির ভাষায় স্বামীর উচিত নয় স্ত্রীকে নিজের দাসী বা কর্মী ভাবা। পরিবারের ভেতরে ছাড়া বাইরেও নারী বা স্ত্রী যদি নিরাপদ পরিবেশে পড়াশুনা বা চাকরি করতে না পারেন এবং বিশ্রাম নিতে না পারেন তাহলে তা তাদের প্রতি জুলুম। ইসলামী সমাজে এ ধরনের জুলুম থাকা মোটেই কাম্য নয়। ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে স্বামী ও স্ত্রী হচ্ছেন একই ঘরের একটি দরজার দুই কপাটের মত, একই চেহারার দুই চোখের মত, জীবন-যুদ্ধের একই বাংকারের দুই সৈনিকের মত, একই দোকানের দুই শরিকের মত এবং তাদের শরীর ও মনের রয়েছে স্বকীয় কিছু বৈশিষ্ট্য; এমনকি চিন্তা ও অনুভূতিতেও রয়েছে স্বাতন্ত্র্য। ইসলামের নির্ধারিত সীমানা মেনে যদি তারা পরস্পরের সহযোগী হন তাহলে সে পরিবার হবে সুদৃঢ়, দয়া, প্রাচুর্য ও কল্যাণে ভরপুর। 

মহানবীর (সা) আহলে বাইতের অন্যতম নক্ষত্র ইমাম হুসাইন (আ) তাঁর স্ত্রীদের প্রতি গভীর অনুরাগী ছিলেন। স্ত্রী রোবাবের প্রতি অনুরাগের নিদর্শন হিসেবে তিনি তাঁর এক কবিতায় বলেছিলেন,  তোমার জীবনের শপথ! আমি সেই ঘরকে ভালোবাসি যে ঘরে রয়েছে সকিনা ও রোবাব! /তাদের দুজনকে ভালোবাসি বলে আমি তাদের পায়ে ঢেলে দিব  আমার সব সম্পদ।/ এর বিরুদ্ধে কারো কোনো প্রতিবাদ আমি কখনও মানবো না এ জীবনে কিংবা কবরেও!

একবার কয়েকজন ব্যক্তি ইমাম হুসাইনের ঘরে প্রবেশ করে তাতে মূল্যবান সুন্দর কার্পেট ও বালিশ দেখে বিস্মিত হয়ে বলল: নবী-পরিবারের সদস্যের এমন মূল্যবান আসবাবপত্র তাদের পছন্দের নয়! ইমাম বললেন, বিয়ের মোহরানার অর্থ দিয়ে আমার স্ত্রীরা এসব  সংগ্রহ করেছে  তাদের পছন্দ অনুযায়ী! তোমরা যা যা দেখছ তা আমার বা আমাদের নিজের নয়! – ইমাম হুসাইন (আ) নিজ স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য সোনা ও রূপার গয়না সংগ্রহ করেছিলেন এবং তিনি চাইতেন তারা এসবের মাধ্যমে নিজেদের সুসজ্জিত রাখবেন। #

পার্সটুডে/এমএএইচ/৩০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ