মে ০৬, ২০২৩ ১৬:৩১ Asia/Dhaka

'ইরান, পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারে তেহরানের ভূমিকা' শীর্ষক অনুষ্ঠানে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। গত পর্বে অনুষ্ঠানে সিল্করোড নিয়ে চীন-মার্কিন বিরোধের বিষয়ে কথা বলেছি। আজও আমরা এ সংক্রান্ত আলোচনা অব্যাহত রাখব।

চীনের প্রস্তাবিত 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' প্রকল্প বাস্তবায়নের পেছনে বেইজিং এর বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বের দেশগুলোর কাছে চীনা পণ্যের বাজার ধরে রাখা। চীনের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে পারস্য উপসাগর ও কাস্পিয়ান সগর এলাকার জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। এসবের বাইরে চীনের আরেকটি বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমেরিকার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, চীন 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতিতে আমেরিকার একক আধিপত্য ও মোড়লিপনাকে প্রতিহত করে বিশ্বে নতুন অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অন্যকথায় বলা যায় 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে চীন আসলে পরাশক্তি হতে চায় এবং এর জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এ কারণে চীন একদিকে নিজের পণ্যের বাজার সৃষ্টির চেষ্টা করছে অন্যদিকে বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান ব্যবস্থা বা  কাঠামোতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চীনের প্রস্তাবিত 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' প্রকল্প এ অঞ্চলসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া, পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমেও এ অঞ্চলের দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনের ওই প্রকল্প ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে সিপিইসি প্রকল্প এবং ইরান ও চীনের মধ্যকার ২৫ বছর মেয়াদি অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি চীনের প্রস্তাবিত 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' নীতিরই অন্তর্গত। এর ফলে ওই দুই প্রকল্প বাস্তবায়ন অনেক সহজ হয়ে যাবে। চীনা প্রকল্পের আওতায় স্থল ও সমুদ্র পথের বাণিজ্যকে টার্গেট করা হয়েছে। 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' প্রকল্পের অন্তর্গত চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার সিপিইসি প্রকল্পের স্থল অংশ পশ্চিম চীনের কশগার শহর থেকে শুরু হয়েছে এবং তা শেষ হয়েছে পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দরে গিয়ে। এটি চীন ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক করিডোর নামে পরিচিত। এই করিডোর আবার চীনের সিল্করোড প্রকল্প এবং ইরান ও চীনের মধ্যকার ২৫ বছর মেয়াদি অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তির সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত।       

মোটকথা, ইরান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে চীনের সাথে কৌশলগত অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিস্তারে এসব অর্থনৈতিক চুক্তি ও প্রকল্প অসামান্য অবদান রাখবে। চীন ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক করিডোর তথা সিপিইসি এবং ইরান-চীন ২৫ বছর মেয়াদি অর্থনৈতিক সহযোগিতা চুক্তি 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' প্রকল্পের অন্তর্গত হওয়ায় অর্থনীতির বাইরে অন্যান্য ক্ষেত্রেও এ দেশগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠবে। কেননা একদিকে ইরানের ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি রুশ অর্থোডক্স সমাজের সাথে এবং অন্যদিকে আরব ও ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতি চীনা কনফুসিয়াস সভ্যতা-সংস্কৃতির সাথে এক অপূর্ব ও ঐতিহাসিক মেলবন্ধন ঘটাবে। এ ধরনের আঞ্চলিক সম্পর্ক গড়ে উঠলে ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও চীনের মধ্যে সব ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি হবে।  তবে ইরান ও চীনের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কোনোভাবেই আমেরিকার মনোপুত হবে না এবং তারা যে ভাবেই হোক এ ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করবে। কিন্তু আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অভিন্ন স্বার্থের আলোকে এ অঞ্চলের দেশগুলোর ঐকান্তিক ইচ্ছাশক্তি আমেরিকার সব ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দেবে।

পাকিস্তান ও চীনের অর্থনৈতিক করিডোর তথা তথা সিপিইসি এবং ইরান ও চীনের মধ্যকার ২৫ বছর মেয়াদি অর্থনৈতিক চুক্তি চীনের প্রস্তাবিত 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' প্রকল্পের অন্তর্গত এবং এ প্রকল্পের সাথে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশের ৫৬টি দেশ যুক্ত হবে। একবিংশ শতাব্দিতে চীনের এ প্রকল্পকে কেন্দ্র করে চীন ও আমেরিকার মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনকি এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভারত মহাসাগর ও পারস্য উপসাগর এলাকা পর্যন্তও বিস্তৃত হতে পারে। কেননা এশিয়ায় পারস্য উপসাগরীয় এলাকা হচ্ছে প্রাকৃতিক জ্বালানির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র বা উৎস এবং হরমুজ প্রণালীর উপর দিয়ে এ অঞ্চলের  তেল ও গ্যাস প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু দেশে রপ্তানি হয়।

আলোচনার এ পর্যায়ে আমরা চীন ও আমেরিকার মধ্যকার প্রতিযোগিতায় ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও চীনের মধ্যে সহযোগিতার প্রভাব এবং সিল্করোডের  সঙ্গে যুক্ত 'ওয়াখান' করিডোরের ভূমিকার বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করবো। চীন ও আফগানিস্তানের মধ্যকার সংযোগ সড়কটি 'ওয়াখান' করিডোর নামে পরিচিত এবং এটি ঐতিহাসিক সিল্করোডেরই অংশ। চীন ও আফগানিস্তানের মাঝখানে অবস্থিত খুবই সরু এই এলাকাটি পশ্চিম চীন ও ভূমধ্যসাগর এলাকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক হিসাবে একসময় এর খ্যাতি ছিল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দি থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দিতে মোঙ্গলদের হামলার আগ পর্যন্ত সময়ে চীন ও পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হতো এই 'ওয়াখান' করিডোর। ভৌগোলিক দিক দিয়ে এটি অত্যন্ত জটিল ও পর্বতময় এলাকা এবং বছরের বেশিরভাগ সময় এখানে বরফ জমে থাকে।

'ওয়াখান' করিডোরের বিরাট অংশ আফগানিস্তানের মধ্যে অবস্থিত। দেশটির সাবেক শাসক আমির আব্দুর রহমান খানের আগের শাসকরা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তে বিতর্কিত ডুরান্ট লাইন মেনে নেয়ার পর 'ওয়াখান' করিডোরের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব হারিয়ে যায়। তবে স্থানীয় প্রভাবশালীরা যারা 'মীর' নামে পরিচিত তারা এখনো 'ওয়াখান' করিডোর ও এর আশেপাশের এলাকাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে।

ব্রিটিশদের  মাধ্যমে সীমান্ত ভাগের পর আফগানিস্তানের তৎকালীন বাদশা আমির আব্দুর রহমান খানকে 'ওয়াখান' করিডোর দখল করার জন্য ব্রিটিশরা চাপ দেয় যাতে ওই অঞ্চলের কিছু এলাকা আফগানিস্তানের হাতে থাকে। এতে করে 'ওয়াখান' করিডোরের একদিকে থাকবে ব্রিটিশ প্রভাবিত ভারতবর্ষ অন্যদিকে থাকবে রুশ প্রভাবিত এলাকা যাতে তৎকালীন সময়ে এ দুই পরাশক্তির মধ্যে কোনো সামরিক সংঘাত না বাধে।

'ওয়াখান' করিডোর এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে এটি পশ্চিম চীনকে আফগানিস্তানের মাধ্যমে ইরান, দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া ও ভূমধ্যসাগরীয় এলাকাকে যুক্ত করেছে এবং এটি ছিল প্রাচীন সিল্করোডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ব্রিটিশরা কখনোই চায়নি 'ওয়াখান করিডোর চীনের নিয়ন্ত্রণে থাকুক অন্যদিকে রাশিয়াও কখনো  চায়নি এটি চীনের নিয়ন্ত্রণে থাকুক। ফলে সর্বোত্তম পন্থা ছিল এই এলাকাটি আফগানিস্তানের হাতেই থাকবে।   #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।