মে ২১, ২০২৩ ১৩:৫৭ Asia/Dhaka

রসায়ন হল প্রাচীনতম বিজ্ঞানের একটি এবং বিশ্বের বৃহত্তম বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয়বস্তু। এই বিজ্ঞানের গুরুত্ব ও এর বহুবিধ ব্যবহার পদ্ধতি বিশেষ করে জ্ঞানগবেষণা ও শিল্প ক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রয়োগের কারণে মানবজীবনে রসায়ন শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। খাদ্য, পোশাক, চিকিৎসা, ওষুধ, পারফিউম এবং রঙের উৎপাদন ও ব্যবহারের জন্য রসায়নের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা মানবজীবনে রসায়নের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা করবে। আশা করি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাব।

রসায়ন এমন একটি বিজ্ঞান ও উপাদান যা পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে শুরু করে ছায়াপথ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরণের পদার্থের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করতে পারে এবং পদার্থ কীভাবে পরিবর্তিত হয় ও কীভাবে উত্পাদিত হয় সেটাও বোঝা সম্ভব। রসায়ন শাস্ত্র এমনসব বিশেষজ্ঞ তৈরি করে যারা কিনা গবেষণা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার ও সৃষ্টিজগতের নানা রহস্য উৎঘাটন করেন। রসায়নশাস্ত্র যেকোনো বস্তুর চূড়ান্ত বা সর্বশেষ অবস্থান বর্ণনা করে এবং বস্তুর ক্ষুদ্রতম উপাদানগুলো চিহ্নিত করতে সহায়তা করে। বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে বিভিন্ন রকমের রসায়নের অস্তিত্ব রয়েছে। রসায়ন বিজ্ঞানের সাহায্যে আমরা দেখতে পাই চুনাপাথরের টুকরোটি দুটি উপাদান অর্থাৎ ক্যালসিয়াম এবং দুটি আধা-ধাতু দিয়ে তৈরি। একটিতে রয়েছে কার্বন এবং অন্যটিতে রয়েছে অক্সিজেন। রসায়নের জ্ঞান শুধুমাত্র বস্তু বা পদার্থকে বিভাজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং তা রাসায়নিক উপাদানগুলোকে একত্রিত কোরে আরো জটিল বস্তু তৈরি করতে পারে। উপাদানের এই সংমিশ্রণকে রাসায়নিক মিথস্ক্রিয়া বলে।

উদাহরণস্বরূপ ক্লোরিনের কথা উল্লেখ করা যায় যা কিনা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় হলুদ-সবুজ বর্ণের গ্যাস রূপে থাকে। এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফসফরাস উপাদানের সাথে মিলিত হয় যা কঠিন কার্বন ও ফসফরাস ক্লোরাইডে পরিণত হয়। এখন পর্যন্ত মৌলিক উপাদান এবং সাধারণ মৌলিক উপকরণের যোগফল থেকে ১০০টির বেশি রাসায়নিক উপাদানের সন্ধান পাওয়া গেছে। 

রসায়ন দু'টি প্রধান শাখায় বিভক্ত। একটি জৈব রসায়ন এবং অন্যটি হচ্ছে খনিজ রসায়ন। জৈব রসায়ন সাধারণত হাইড্রোকার্বন ও হাইড্রোকার্বনের জাতকসমূহের গঠন, বৈশিষ্ট্য, সংযুক্তি এবং প্রস্তুতি বা সংশ্লেষণ নিয়ে আলোচনা করে। অতী প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ উদ্ভিদ ও প্রাণীজগত থেকে পাওয়া নানা রকম পদার্থ যেমন তেল, ঘি, মদ, বিভিন্ন  গন্ধ ও প্রসাধনী প্রভৃতি ব্যবহার করতো যা জৈব রসায়ন দ্বারা গঠিত। অন্যদিকে নিষ্প্রাণ খনিজ পদার্থ বা জড়বস্তু থেকে উৎপন্ন যৌগগুলোকে খনিজ রসায়ন নামে অভিহিত করা হয়।

রসায়ন হচ্ছে একটি মৌলিক বিজ্ঞান এবং এটি বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি হিসেবে পরিচিত। কারণ ‌এর এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা তাত্ত্বিক পর্যায়ে ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা উপলব্ধিতে সহযোগিতা করে। উদাহরণ স্বরূপ, রসায়নশাস্ত্র উদ্ভিদবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, বাস্তুবিদ্যা, সৃষ্টিতত্ত্ব ও ওষুধ নির্মাণের বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করে। রসায়ন এমন একটি বিষয় যার মাধ্যমে পরমাণু ও অনুগুলোর প্রতিক্রিয়া এবং নতুন রাসায়নিক যৌগ গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা যায়। মোটকথা, এটি আমাদের জীবন এবং পরিবেশের ওপর অনেক বড় প্রভাব ফেলতে সক্ষম। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে রসায়নশাস্ত্রের বিকাশ ও নতুন নতুন রাসায়নিক উপাদানের আবিষ্কার মানুষের আয়ু বৃদ্ধি এবং জীবন মানের উন্নয়নে অনেক বড় অবদান রেখেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে রসায়নের অস্তিত্ব রয়েছে এবং কোনো কিছুর পরিবর্তনে এটি ভূমিকা রাখে। একটি শীতল ও নির্জীব গ্রহ থেকে জীবনের অস্তিত্ব আছে এমন গ্রহের পার্থক্য থেকেই রাসায়নিক পরিবর্তনের বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়।

রাসায়নিক উপাদান প্রকৃতির বিস্ময় ও রহস্য উৎঘাটনে আমাদের সহযোগিতা করে এবং মানুষ তা থেকে উপকৃত হয়। রসায়নশাস্ত্রের বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন যে, কীভাবে রসায়নের ইতিবাচক ব্যবহারের মাধ্যমে মানব বিপর্যয় রোধ করা যায় এবং পৃথিবীর প্রাণী জগতের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা যায়।

খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার বছর আগে, প্রথম রাসায়নিক বিক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে  মানুষ আগুন নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল রপ্ত করেছিল।

প্রাচীনকালে মানুষের কাছে আগুন ছিল একটি বিস্ময়কর শক্তি যা কিনা একটি পদার্থকে অন্য পদার্থে রূপান্তরিত করতে পারে। আগুনের কারণে কাঁচের আবিষ্কার হয়েছে এবং ধাতব পদার্থ পরিশোধন ও চিহ্নিতকরণ সম্ভব হয়েছে। ইংরেজি alloy বা সংকর ধাতু হচ্ছে একাধিক ধাতু বা একটি ধাতুর সাথে বিভিন্ন উপাদানের মিশ্রণ। সংকর ধাতুর আবিষ্কার ব্রোঞ্জ যুগের জন্ম দেয়। রসায়ন ও ধাতুবিদ্যার এই জ্ঞান পরবর্তীতে যুদ্ধের সরঞ্জাম তৈরিতে প্রয়োগ করা হয়।

প্রাচীন মিশরীয়রা ধাতুবিদ্যায় পারদর্শী ছিল। রোমান সম্রাট মিশর আক্রমণ করার পর আলকেমি সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল। এ কারণে লিখিত গবেষণাকর্ম খুব কমই অবশিষ্ট ছিল। সেই যুগে আরবের রসায়ন চর্চাকে আলকেমি বলা হতো। রসায়ন সংক্রান্ত গবেষণা কর্ম পুড়িয়ে ফেলা হলেও যে সামান্য কিছু অবশিষ্ট ছিল তার মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ 'স্টকহোম প্যাপিরাস' এবং 'লিডেন প্যাপিরাসের' কথা উল্লেখ করা যায়। তবে আলকেমি ও রসায়নের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। অ্যালকেমি, এক রহস্যময় বিদ্যা। কোনো একটা পদার্থকে ভেঙে তাৎক্ষণিকভাবে অন্য এক পদার্থে রূপান্তর করাই হচ্ছে এই বিদ্যার মূল বৈশিষ্ট্য। মিশরীয়রা মনে করতেন আলকেমি হচ্ছে সেই শাস্ত্র যার চর্চার মাধ্যমে ধাতু বিশেষ করে তামাকে সোনায় পরিণত করা যায় ।

ইরানে হেসার টিলা ও সিয়াল্ক টিলায় খননকাজ চালিয়ে খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে প্রাচীন ইরানে ব্যবহৃত কালো চকচকে ধূসর রঙের মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। ধারনা করা হচ্ছে এটাই প্রথম মৃৎপাত্র যা চকচকে লেয়ার দিয়ে তৈরি যার সঙ্গে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের সম্পর্ক ছিল। 

প্রাচীনকালের ইরানিরা চেহারার সৌন্দর্যবৃদ্ধি বা সাজার জন্য সুরমাসহ বিভিন্ন রঙের তৈরি উপাদান ব্যবহার করত। এসব উপাদান পশুর চর্বি ও ছাই থেকে সংগ্রহ করা হতো এবং তাতে প্রাকৃতিক বিভিন্ন রঙ মেশানো হতো। ওই যুগে ফিরোজা পাথর সুন্দর রঙের জন্য বিখ্যাত ছিল এবং ইরান ছিল একমাত্র দেশ যারা খনি থেকে এই পাথর উত্তোলন করতো। ইরানে রসায়নবিজ্ঞান শুরুর ইতিহাস খুঁজতে গেলে প্রাকৃতিক রঙের এই বিচিত্র ব্যবহারের ইতিহাসের মধ্যে অনুসন্ধান করতে হবে। এমনকি কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে আলকেমি বিজ্ঞানচর্চা ইরান থেকে মিশর এবং বাদবাকি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/২১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

 

ট্যাগ