জুন ০৩, ২০২৩ ১৪:৫৮ Asia/Dhaka

রসায়ন হল প্রাচীনতম বিজ্ঞানের একটি এবং বিশ্বের বৃহত্তম বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয়বস্তু। এই বিজ্ঞানের গুরুত্ব ও এর বহুবিধ ব্যবহার পদ্ধতি বিশেষ করে জ্ঞানগবেষণা ও শিল্প ক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রয়োগের কারণে মানবজীবনে রসায়ন শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। খাদ্য, পোশাক, চিকিৎসা, ওষুধ, পারফিউম এবং রঙের উৎপাদন ও ব্যবহারের জন্য রসায়নের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমরা আলকেমি বিজ্ঞানের বিভিন্ন দিক এবং এ ক্ষেত্রে প্রাচীন ইরানের ভূমিকা নিয়েও কথা বলেছি। আজকের আলোচনায় আমরা রসায়নের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো।

প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকরা এটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতেন কেন রঙ, গন্ধ ও ঘনত্বের দিক থেকে একেক পদার্থের একেক বৈশিষ্ট্য? এবং কেনইবা কোনো পদার্থ কঠিন, কোনোটি তরল আবার কোনোটি গ্যাসীয় এবং কেন একে অপরের সাথে বিভিন্ন উপায়ে বিক্রিয়া করে। গ্রীক দার্শনিকরা রসায়ন ও প্রকৃতি সম্পর্কে প্রথম তত্ত্ব উপস্থাপন করেন যা কিনা ওই যুগের সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিকাশে বেশ ভূমিকা রেখেছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রাচীন গ্রিক গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ ও দর্শনের জনক হিসেবে খ্যাত থ্যালেস পানিকে মূল উপাদান হিসাবে বিবেচনা করেন যেখান থেকে পৃথিবী উদ্ভূত হয়েছিল। থ্যালেস যুগের ২০০ বছর পর অ্যারিস্টটল পৃথিবী সৃষ্টির পেছনে চারটি মূল উপাদান অর্থাৎ পানি, মাটি, আবহাওয়া ও আগুনের কথা বলেছিলেন।  গ্রিক দার্শনিক লুক্রেটিয়াস "দ্য নেচার অফ থিংস" নামে একটি বইয়ে দাবি করেছিলেন সমস্ত পদার্থ পরমাণু নামক অবিভাজ্য কণা দ্বারা গঠিত।

অতীতে, মানুষ সস্তা ধাতুকে সোনার মতো মূল্যবান ধাতুতে রূপান্তর করতে খুব আগ্রহী ছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল যে বস্তু বা উপাদান এ ধরনের মূল্যবান ধাতুতে পরিণত হতে পারে কিংবা মূল্যবান ধাতুতে পরিণত করতে ভূমিকা রাখতে পারে তা অবশ্যই যাদুকরী পাথর। এ ধরনের বিশ্বাস থেকে কিমিয়া বিজ্ঞানের উৎপত্তি। কিমিয়া পদ্ধতিতে শুধু যে সস্তা ধাতুকে মূল্যবান ধাতুতে রূপান্তর করার চেষ্টা করা হতো তা নয় একই সাথে মানুষ মনে করতো এর দ্বারা এমন ওষুধ তৈরি করা সম্ভব যাতে অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তোলা যায়। সে যুগের মানুষ মনে করতো আলকিমি বিজ্ঞানচর্চাকারীরা এমন এক অমৃত পানিয় আবিষ্কারে সক্ষম হবেন যা খেলে মানুষের মৃত্যুকে বিলম্বিত করা যাবে। যদিও তৎকালীন সময়ের আলকেমি বিজ্ঞানচর্চাকারীরা এ ধরনের অমৃত পানিয় আবিষ্কারে সক্ষম হননি কিন্তু প্রাথমিক গবেষণা চালিয়ে এবং ফলাফল রেকর্ড করে তারা আধুনিক রসায়নের ভিত্তি রচনা করে গেছেন।

কোনো বস্তুর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গিতে কেবল তখনই পরিবর্তন আসতে শুরু করে যখন রবার্ট বয়েল ১৬৬১ সালে 'দ্য স্কেপটিক্যাল কেমিস্ট' বইতে তিনি রসায়ন ও আলকেমির মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেছিলেন। এরপর রসায়ন বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় এটি বিবর্তিত ও পূর্ণাঙ্গ রসায়নশাস্ত্রে পরিণত হয়। আলকেমি ও রসায়ন এ দু'টি বিজ্ঞানের মাধ্যমেই পদার্থের বৈশিষ্ট্য এবং কীভাবে পদার্থ রূপান্তরিত হয় তা আমরা জানতে পারি। তবে এ ক্ষেত্রে আধুনিক রসায়ন হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। মুসলিম বিজ্ঞানীদের গবেষণাকর্মের সাথে প্রাচীন জ্ঞানের সংমিশ্রণের কারণে মধ্যযুগে রসায়ন শাস্ত্রে বিপ্লবের সূচনা হয়। মুসলিম বিজ্ঞানীরা বিশেষ করে ইরানি বিজ্ঞানীরা প্রাচীন গ্রিক ভাষার বহু বই অনুবাদের কাজ শুরু করেন এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাদের গবেষণাকর্মগুলো রপ্ত কোরে নিজেদের জ্ঞানভাণ্ডারকে আরো সমৃদ্ধ করেন।

মধ্যযুগে ইরানের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন জাবের ইবনে হাইয়ান যিনি ছিলেন ইমাম জাফর সাদেক (আ.)এর সুযোগ্য ছাত্র। জাবের ইবনে হাইয়ানকে রসায়নের জনক বলে অভিহিত করা হয়। রসায়ন ক্ষেত্রে তিনি তাত্ত্বিক এবং পরীক্ষামূলক পদ্ধতির প্রবর্তন করেছিলেন। প্রাচীন গ্রিক ও মিশরিয় আলকেমিস্টদের কাজগুলো ছিল কেবল চিন্তা ভিত্তিক। কিন্তু জাবের ইবনে হাইয়ান নিজের চিন্তাকে গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি 'আন্‌বিক' নামে এমন একটি কৌশল বা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন যার মাধ্যমে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের পরীক্ষা চালাতেন। 'আন্‌বিক' ছিল পদার্থ পাতন করার একটি সহজ যন্ত্র। কোনো তরল পদার্থকে তাপ প্রদানের মাধ্যমে বাষ্পে পরিণত কোরে তাকে পুনরায় শীতলীকরণের মাধ্যমে তরলে পরিণত করার পদ্ধতিকে পাতন বলে। এ ছাড়া, জাবের ইবনে হাইয়ান রসায়নের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছিলেন যার অনেকগুলো এখনও ব্যবহৃত হয়। যেমন, হাইড্রোক্লোরিক ও নাইট্রিক এসিড সংশ্লেষণ, পাতন এবং কেলাসীকরণ।

অন্যান্য বিখ্যাত মুসলিম রসায়নবিদ যেমন, ইবনে সিনা, আবু ইউসুফ কান্দি এবং আবু রেইহান আল-বিরুনির মতো ব্যক্তিরা প্রাচীন আলকেমি যুগের জাদুকরী পাথরসহ তৎকালীন সময়ে রসায়নের কিছু তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করেছেন। খাজা  নাসিরউদ্দিন তুসিও রসায়ন বিষয়ে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনা তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, একটি বস্তু বা পদার্থ এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তন হতে পারে কিন্তু অদৃশ্য হতে পারে না। ইরানের আরেকজন খ্যাতনামা মনীষী মোহাম্মদ জাকারিয়া রাজি যিনি আধুনিক পরীক্ষাগার ব্যবহার করে ২০টিরও বেশি পরীক্ষাগার যন্ত্রের নকশা ও বর্ণনা তুলে ধরেন যার মধ্যে আজো কিছু ব্যবহার হচ্ছে। বলা যায়, তিনি আধুনিক রসায়নের জন্য একটি শক্ত ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তিনি অ্যালকোহল, সালফিউরিক এসিড ও কেরোসিনের আবিষ্কারক হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন।

যাইহোক, ইরানে রসায়ন বিজ্ঞানের ইতিহাস বহু প্রাচীন। প্রাচীন অ্যালকেমিস্টদের সময় থেকে যারা মূল্যহীন ধাতু থেকে সোনা তৈরির চেষ্টা করেছিলেন পরবর্তীতে রাজির মতো বিজ্ঞানীদের মূল্যবান বৈজ্ঞানিক গবেষণাকর্ম এ সবই রসায়ন বিজ্ঞানে ইরানের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রমাণ বহন করে। তবে ইরানে রাসায়নিক শিল্পের ইতিহাস এদেশে ইরান-জার্মানি ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় থেকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে এ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। ইরানের এই প্রতিষ্ঠানে রাসায়নিক, বৈদ্যুতিক এবং যান্ত্রিক প্রকৌশল বিষয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রায় বিশজন শিক্ষার্থীকে গ্রহণ করা হতো। দুই বছর পড়া সমাপ্ত করার পর তাদেরকে বলা হতো কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ