জুন ০৮, ২০২৩ ১৫:৪০ Asia/Dhaka

শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন।  আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা হাদিদের ১৫ নম্বর পর্যন্ত আয়াত নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই সূরার ১৬ থেকে ২০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন করব।  প্রথমেই ১৬ ও ১৭ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

أَلَمْ يَأْنِ لِلَّذِينَ آَمَنُوا أَنْ تَخْشَعَ قُلُوبُهُمْ لِذِكْرِ اللَّهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ وَلَا يَكُونُوا كَالَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْأَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوبُهُمْ وَكَثِيرٌ مِنْهُمْ فَاسِقُونَ (16) اعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يُحْيِي الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا قَدْ بَيَّنَّا لَكُمُ الْآَيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ (17)

"যারা ঈমান এনেছে তাদের হৃদয় কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য নাযিল হয়েছে তার জন্য বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি? আর তারা যেন তাদের মত না হয় যাদেরকে আগে কিতাব দেয়া হয়েছিল—অতঃপর বহু কাল অতিক্রান্ত হওয়ার পর তাদের অন্তরসমূহ কঠিন হয়ে পড়েছিল। আর তাদের অধিকাংশই ফাসিক।” (৫৭:১৬)

“জেনে রাখো যে, আল্লাহই যমীনকে তার মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত করেন। আমি নিদর্শনগুলো তোমাদের জন্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছি যাতে তোমরা বুঝতে পার।” (৫৭:১৭)

এই দুই আয়াত অনুযায়ী, মুমিন ব্যক্তিরা যে বিপদের সম্মুখীন হতে পারেন তা হলো আল্লাহর স্মরণের ব্যাপারে উদাসীনতা ও তার কিতাবের আয়াতসমূহ ভুলে যাওয়া। যুগে যুগে এমন বহু মানুষ গত হয়েছে যারা প্রথমে আল্লাহ ও তাঁর নবীর প্রতি ঈমান এনেছিল, কিন্তু পরবর্তীতে পার্থিব জগতের মোহে এতটা মগ্ন হয়ে পড়েছিল যে, আল্লাহর নির্দেশের সামনে আত্মসমর্পণের মনোভাব হারিয়ে ফেলেছিল। আল্লাহর আদেশ ও নিষেধের ব্যাপারে তাদের অন্তত পাথরের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল।

অথচ ঈমানী চেতনার অর্থ হলো আল্লাহ ও তাঁর কিতাবের আয়াতসমূহের সামনে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ ও বশ্যতা স্বীকার করা এবং সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই চেতনায় বিন্দুমাত্র ভাটা না পড়া। পূর্ববর্তী বহু নবীর উম্মতদের ক্ষেত্রে এই বিপদ দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সে অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আল্লাহ তায়ালা এখানে বলছেন, মুসলমানরা যেন অতীত থেকে শিক্ষা নেয় এবং একই কাজের পুনরাবৃত্তি না করে।  আল্লাহর কিতাবকে সমুন্নত রাখা এবং কিতাবের নির্দেশাবলী পালনের ক্ষেত্রে যেন বিন্দুমাত্র উদাসীনতা সৃষ্টি না হয়।

পরের আয়াতে একটি সুস্পষ্ট সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: মহান আল্লাহ যেভাবে বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে মৃত ভূমিকে জীবিত করেন ঠিক তেমনি আল্লাহর স্মরণ এবং তাঁর আদেশ-নিষেধের সামনে বশ্যতা স্বীকার করার মাধ্যমে মানুষের অন্তরও জীবিত ও জাগ্রত হয়। অন্তরের মরিচা দূরভূত হয় এবং সেখানে আধ্যাত্মিকতার নূর বিচ্ছুরিত হয়।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- আল্লাহর স্মরণ ও কুরআন তেলাওয়াত মানুষের অন্তরকে বিগলিত করে এবং কঠিন হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে।

২- বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়ার প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়ে এবং আল্লাহর শিক্ষা অন্তর থেকে দূর হতে থাকে। এ ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পেতে আমাদেরকে বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত ও আল্লাহর জিকির করতে হবে।

৩- সকল যুগের সকল উম্মতের জন্য আল্লাহর বিধান অভিন্ন। কাজেই মুসলমানসহ অন্য কোনো উম্মত যেন নিজেকে অপরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে না করে।

৪-  মানুষের অন্তরকে আল্লাহ ও তাঁর কালামে পাকের সামনে অনুগত রাখতে হবে। এছাড়া, সৃষ্টিজগতে আল্লাহর নিদর্শন প্রত্যক্ষ করার জন্য মানুষকে তার বিবেককে কাজে লাগাতে হবে।

এবারে সূরা হাদিদের  ১৮ ও ১৯ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

إِنَّ الْمُصَّدِّقِينَ وَالْمُصَّدِّقَاتِ وَأَقْرَضُوا اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا يُضَاعَفُ لَهُمْ وَلَهُمْ أَجْرٌ كَرِيمٌ (18) وَالَّذِينَ آَمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ أُولَئِكَ هُمُ الصِّدِّيقُونَ وَالشُّهَدَاءُ عِنْدَ رَبِّهِمْ لَهُمْ أَجْرُهُمْ وَنُورُهُمْ وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ (19)

“নিশ্চয় দানশীল পুরুষগণ ও দানশীল নারীগণ এবং [যারা] আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান করে তাদেরকে দেয়া হবে বহু গুণ বেশী এবং তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার।” (৫৭:১৮)

“আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তারাই তাদের প্রতিপালকের নিকট সিদ্দীক [তথা সত্যনিষ্ঠ] ও শহীদ [হিসেবে গণ্য]। তাদের জন্য রয়েছে তাদের প্রাপ্য পুরস্কার ও নূর [বা জ্যোতি]। আর যারা অবিশ্বাস করেছে ও আমার নিদর্শনাবলীকে মিথ্যাজ্ঞান করেছে, তারাই জাহান্নামের অধিবাসী।”(৫৭:১৯)

আগের দুই আয়াতে আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাঁর বশ্যতা স্বীকার করার কথা বলার পর এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে: অসহায় ব্যক্তিদের দান করা বা সাদাকা প্রদান আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণেরই শামিল। পার্থিব জীবনে আমরা যে দান করি তা আল্লাহকে ঋণ দেয়ারই নামান্তর। কিয়ামতের দিন যখন আমাদের নেকির প্রয়োজন হবে তখন আল্লাহ তায়ালা আমাদের আজকের দানকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে আমাদেরকে  ফিরিয়ে দেবেন।  নিঃসন্দেহে এরকম মুমিন ব্যক্তিরা আল্লাহ তায়ালার কাছে সিদ্দিক ও শহীদের মতো উচ্চ মর্যাদা প্রাপ্ত এবং তাদের জন্য আল্লাহ সিদ্দিক ও শহীদের সমান পুরস্কার নির্ধারণ করে রেখেছেন। কিন্তু যারা সুস্পষ্ট নিদর্শন দেখার পরও তা মিথ্যাজ্ঞান ও  প্রত্যাখ্যান করে কিয়ামতের দিন তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।

এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

১- কেউ নিজেকে ঈমানদার দাবি করলে সে যেন অসহায়কে সাহায্য করে।  দানকারীরা সেইসব সত্যবাদী বা সিদ্দিকের সমান মর্যাদা লাভ করবেন যারা তাদের ঈমানে সত্যিকার একনিষ্ঠ।

২- অসহায়কে দান করা বা ঋণ দেয়া উভয়ই আল্লাহ তায়ালাকে ঋণ দেয়ার সমতুল্য।  দান বা ঋণ প্রদান বাহ্যিক দৃষ্টিতে আর্থিক ক্ষতি মনে হলেও বাস্তবে তাতে রয়েছে বিশাল লাভ।

৩- দুনিয়ার এই জীবনই চূড়ান্ত কিছু নয়; কাজেই পার্থিব জীবনের ধন-সম্পদ দেখে কাউকে বিচার করা সমীচীন নয়। চূড়ান্ত সফলতা কিয়ামতের ময়দানে নির্ধারিত হবে। দানকারীরা সেদিন তাদের সৎকর্মের পুরস্কার পাবেন ও চিরকালীন শান্তির আবাসে প্রবেশ করবেন। পক্ষান্তরে পাপী ব্যক্তিরা জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তির মুখোমুখি হবে।

এবারে এই সূরার ২০ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

اعْلَمُوا أَنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ كَمَثَلِ غَيْثٍ أَعْجَبَ الْكُفَّارَ نَبَاتُهُ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَاهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَكُونُ حُطَامًا وَفِي الْآَخِرَةِ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَمَغْفِرَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانٌ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ (20)

“তোমরা জেনে রাখ, নিশ্চয় দুনিয়ার জীবন খেল-তামাশা, ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, পারস্পরিক গৰ্ব-অহংকার, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ছাড়া আর কিছু নয়। এর উপমা হলো বৃষ্টি, যার উৎপন্ন শস্য-সম্ভার কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, তারপর সেগুলো শুকিয়ে যায়, ফলে আপনি ওগুলো পীতবর্ণ দেখতে পান, অবশেষে সেগুলো খড়-কুটায় পরিণত হয়। আর আখেরাতে [পাপীদের জন্য] রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং [পরিপূর্ণ বশ্যতা স্বীকারকারীদের জন্য রয়েছে] আল্লাহর ক্ষমা ও সস্তুষ্টি। আর দুনিয়ার জীবন প্রতারণার সামগ্ৰী ছাড়া কিছু নয়।” (৫৭:২০)

এই আয়াতে মানুষের জীবনের বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এই অর্থে যে, সে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে পার্থিব চাকচক্যের কোনো একটি বেছে নিয়েছে। খেল-তামাশা ও ক্রীড়া কৌতুক শিশু ও কিশোর বয়সের কাজ। যুবক বয়সে মানুষ বেশি সাজগোজ ও জাকজঁমকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বয়স আরো বেড়ে গেলে অর্থ-সম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও নিজের অতীত নিয়ে মানুষ গর্ব ও অহংকার করে। আরো পরে মানুষ যখন জীবন সায়াহ্নে এসে যায় তখন তার মধ্যে দুনিয়াপ্রীতি ও কার্পণ্য বাড়তে থাকে। সে তখন আরো বেশি সম্পদ সঞ্চয়ের নেশায় মেতে ওঠে।  মানুষ জীবন সাধারণত ৬০ থেকে ৭০ বছর বা এর চেয়ে কম-বেশী হয়।  কিন্তু এক দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যায়, এই জীবনটি একটি বীজের মতো যা একদিন অঙ্কুরিত হয়ে ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে ওঠে এবং ফসল দান করার পর বাদামী বর্ণ ধারণ করে খড় কুটায় পরিণত হয়।

এই আয়াতটির কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

১- পার্থিব জীবনের প্রকৃত রহস্য জেনে গেলে মানুষ এই জীবনকে উদাসীনভাবে কাটানো বন্ধ করবে এবং জীবন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যাবে।

২- অতিরিক্ত দুনিয়াপ্রীতি ও পার্থিব জীবনের প্রতি মোহ মানুষকে প্রতারিত করে। এই জীবনের মোহে একবার জড়িয়ে পড়লে তা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। এমন সময় মানুষ সম্বিত ফিরে পায় যখন আর কিছু করার থাকে না।

৩- আল্লাহ ও ধর্মবিহীন জীবন শিশুকালের খেলাধুলার সমতুল্য; যদিও এই খেলার খেলোয়াড়েরা প্রাপ্তবয়স্ক।

৪- পার্থিব জীবন সবাই কমবেশি উপভোগ করে। কিন্তু একজন ঈমানদার মানুষের উপভোগ হয় আল্লাহ নির্দেশিত পথে। এই দুনিয়া কারো জন্য পরিপূর্ণতা অর্জন করে জান্নাত লাভের মাধ্যম আবার কারো জন্য প্রতারিত হয়ে জাহান্নামের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার উপকরণ।  

তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।  

পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ