সুঅভ্যাস গড়ার উপায় নিয়ে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান
সুন্দর জীবন- পর্ব ৪১
পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রকে সুশৃঙ্খল ও উন্নত করতে প্রত্যেক মানুষেরই দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি। শিশুকাল থেকে দায়িত্বশীলতা অনুশীলন করলে বড় হয়েও এই অনুভূতি জাগ্রত থাকে। অনেক অভিভাবক অতি আদরের কারণে শিশুদেরকে কোনো দায়িত্ব দিতে চান না। এর ফলে নিজেদের সন্তানেরই ক্ষতি হয়। ভবিষ্যৎ জীবনে সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।
বাবা-মায়ের উচিৎ শিশু সন্তানদেরকেও কিছু দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত করা। এর ফলে নিজে নিজে কিছু করার যোগ্যতা গড়ে ওঠবে। শিশুদেরকে দায়িত্ব না দিলে তারা ক্রমান্বয়ে অলস হতে শুরু করে। এর ফলে এক সময় তাদের সব কাজেই অন্যের সহযোগিতার প্রয়োজন হয় এবং তারা মনে করতে থাকে অন্যেরাই তার সব কাজ করে দেবে, তার কোনো দায়িত্ব পালন করতে হবে না। এ কারণে শিশুদেরকেও তাদের বয়স অনুযায়ী ছোটখাটো দায়িত্ব দিতে হবে। শিশুদেরকে কিছু দায়িত্ব পালনের সুযোগ না দিলে তাদের মধ্যে বিনা পরিশ্রমে সব পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ক্রমেই বাড়তে থাকবে।
বিনা পরিশ্রমে কিছু অর্জনের মনোভাব কখনোই কারো জন্য সাফল্য বয়ে আনে না। বাবা-মা বা অভিভাবকদেরকে চেষ্টা করতে হবে শিশু সন্তানদেরকে এমন কিছু দায়িত্ব দেওয়ার যা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশেও ভূমিকা রাখে। যেমন তিন থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা নিজেরাই কিছু ক্ষেত্রে বাছাইয়ে যোগ্যতা অর্জন করে ফেলে। তারা কিন্ডার গার্টেনে যাওয়ার জন্য কী ধরণের পোশাক পরবে সে বিষয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে এক্ষেত্রে বাবা-মায়ে'র নজরদারি অবশ্যই থাকতে হবে। খাবারের বিষয়েও তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কী ধরণের খাবার সে খাবে সে বিষয়ে এই বয়সী শিশুরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাদেরকে খাবার নির্বাচনের সুযোগ দিতে পারেন এই বয়সেও। অবশ্য শিশুর জন্য ক্ষতিকর হলে সেই খাবার খাওয়া থেকে তাকে বিরত রাখতে হবে।
পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা তাদের খেলা শেষে খেলনাগুলো গুছিয়ে রাখতে পারে। কাজেই পাঁচ বয়সী শিশুদেরকে আপনি তাদের খেলনাগুলো গুছিয়ে রাখার দায়িত্ব দিতে পারেন। দায়িত্ব দেওয়ার পাশাপাশি তাদেরকে এই দায়িত্ব পালনে উৎসাহ দিতে হবে। শুধু খেলনা গুছিয়ে রাখা নয়, খেলতে গিয়ে খেলার স্থানে যদি কোনো ময়লা লাগিয়ে ফেলে তাহলে তা ধোয়ার দায়িত্বও পালন করতে পারে এই বয়সী শিশুরা। তবে তাকে অবশ্যই ধোয়ার কৌশল শিখিয়ে দিতে হবে। শিখিয়ে দিলে সে নিজেই তা পারবে। শিশুরা যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করে তখন তারা আরও বেশি দায়িত্ব নিতে সক্ষম হয়। সাত-আট বছরের শিশুরা ঘরের কাজেও সহযোগিতা করতে পারে। রাতের খাবারের পর টেবিলটা গুছিয়ে রাখার মতো সহজ কাজগুলো তাদেরকে দেওয়া যেতে পারে। এই বয়সে শিশুদের হাতে কিছু টাকা দিয়ে সেই টাকা সঠিক উপায়ে খরচ করতে বলা যেতে পারে। এর মাধ্যমে শিশুরা ক্রমেই শিখতে পারবে কোন কাজে কতটুকু অর্থ ব্যয় করা উচিত। এক সপ্তাহের জন্য তাদেরকে কিছু টাকা দিতে পারেন। এরপর সে ঐ টাকা কীভাবে খরচ করল তা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।
অপব্যয় করলে তাদেরকে মিতব্যয়িতার জন্য পরামর্শ দিতে হবে এবং প্রয়োজন ছাড়া যাতে অর্থ ব্যয় না করে তা শেখাতে হবে। দ্রুত টাকা খরচ করে এসে আবার যদি টাকা দাবি করে তাহলে তাকে টাকা দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং বুঝাতে হবে যে, তাকে এক সপ্তাহের জন্য টাকা দেওয়া হয়েছে। কাজেই এক সপ্তাহ শেষ হলে আবার তাকে টাকা দেওয়া হবে। বাবা-মাকে মনে রাখতে হবে যে, শিশুর সঙ্গে সফল একটা সম্পর্কের মধ্যদিয়ে সামনের দিকে এগোতে হবে। নিজের সুন্দর আচরণের পাশাপাশি কখনো কখনো দৃঢ়চেতা মনোভাব এই সম্পর্ককে লক্ষ্যপানে নিয়ে যেতে পারে। শিশুর মৌলিক চাহিদার বিষয়টি বোঝার পর সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। একইসঙ্গে বয়স অনুযায়ী শিশুর জন্য কিছু রীতি-নীতি ও সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে হবে। শিশুকে যখন সীমাবদ্ধতার কথা বলবেন তখন নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করবেন যে, সে সীমাবদ্ধতাগুলো ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে কিনা।
কিশোর বয়সে অর্থাৎ ১০-১১ বছর পার হওয়ার পর সন্তানেরা অনেক বিষয়েই মতামত দিতে পারে। এ কারণে পারিবারিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের মতামত নেওয়া জরুরি, তাদের সঙ্গে পরামর্শ করা গুরুত্বপূর্ণ। এই বয়স থেকে আপনি আপনার সন্তানকে ভালো কোনো বন্ধুর সঙ্গে বাইরে খেলতে যাওয়ার সুযোগ দিতে পারেন। এই বয়সী শিশুরা বাসায় একা সময় কাটাতেও সক্ষম। অবশ্য বাসায় একা থাকা বা বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রেও বাবা-মায়ের নজরদারির প্রয়োজন রয়েছে। সন্তানেরা যখন ১৫ বছরে পা রাখে তখন তারা একা বাইরে যেতে পারে এবং মাসিক ভিত্তিতে টাকা নিয়ে তা ভালো উপায়ে ব্যয়ের সক্ষমতা অর্জন করে। তারা এ সময় বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতেও যেতে পারে। একই সঙ্গে ১৫ বছর বয়সী সন্তানেরা ঘরের কাজে অনেক বেশি সহযোগিতা করতে সক্ষম। তবে তাদের কাছে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যাশা করতে হবে এবং কঠোর মনোভাব পরিহার করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
সন্তানকে দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ হিসেবে গড়ে তুলতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে বাবা-মা তথা পরিবারের বড় সদস্যদের দায়িত্বশীল আচরণ। সন্তানকে দায়িত্বশীল হিসেবে গড়ার জন্য সন্তানের সামনে নিজেকে এ ক্ষেত্রে আদর্শ ও অনুকরণীয় হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করুন। আপনি পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়সহ সব ক্ষেত্রে নিজের দায়িত্ব সুচারুভাবে পালনের চেষ্টা করুন। এর ফলে আপনার সন্তান আপনাকে দেখে দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে। সন্তানেরা কোনো ভালো কাজ করলে এবং তাদের দায়িত্ব ভালোভাবে সম্পন্ন করার চেষ্টা করলে তাদেরকে উৎসাহ দিন। সন্তানদের প্রতি অতি ভালোবাসা ও মমতার কারণে তাদেরকে অলস হিসেবে গড়ে তুলবেন না। এর ফলে বড় হয়ে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করা অথবা নিজের দায়িত্ব পালন করতে তারা সক্ষম হবে না। আপনি যদি এখন থেকে তাকে নিজের কাজগুলো নিজে করার এবং চিন্তা-ভাবনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ না দেন তাহলে তারা বড় হয়েও আপনার ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবে। নিজে থেকে তেমন কিছুই করতে পারবে না।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।