জুন ১৪, ২০২৩ ১৪:৪১ Asia/Dhaka

গত আলোচনায় আমরা ইরানের আরেকজন খ্যাতনামা মনীষী ইবনে সিনার জীবনী ও তার গবেষণা কর্মের কিছু দিকের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দয়েছিলাম। আজকের আলোচনায়ও আমরা এ সংক্রান্ত আলোচনা অব্যাহত রাখবো।

গত পর্বের আলোচনায় আমরা বলেছিলাম ইবনে সিনা কমপক্ষে ২৩০ টি বই লিখেছেন। এ প্রসঙ্গে ইবনে সিনার বিখ্যাত গ্রন্থ শেফার কথা উল্লেখ করেছিলাম। এ বইটি সম্পর্কে মার্কিন বিশিষ্ট প্রাচ্যবিদ ও ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডুরান্টও ভূয়সি প্রশংসা করেছেন। সেই মধ্যযুগে এরকম একটি বই লেখা ইবনে সিনার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রখরতা এবং দূরদর্শিতার পরিচায়ক। মানবীয় চিন্তাদর্শের ইতিহাসে গ্রহণযোগ্য এবং নির্ভরশীল গবেষণাকর্মের সারিতে এই গ্রন্থটি অন্যতম। এই গ্রন্থটিকে একটি দর্শন বিষয়ক বিশ্বকোষ বলা যেতে পারে। আবু আলি সিনা এই গ্রন্থটির মাধ্যমে ইসলামি সাংস্কৃতিক চিন্তাধারাকে পশ্চিমা জগতে পরিচয় করাতে পেরেছিলেন।

আবু আলি হোসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সিনার উপাধি ছিল শায়খুর রায়িস। তিনি একাধারে ছিলেন দার্শনিক, চিকিৎসাবিদ, গণিতবিদ এবং বিখ্যাত একজন জ্ঞানীগুণী মনীষী। ছোটবেলায় তিনি কোরআন, ফিকাহ, সাহিত্য এবং ভারতীয় হিসাববিদ্যা শেখায় কিছুটা সময় কাটান এবং দশ বছর বয়সেই পুরো কোরআন আয়ত্ত করেন। ১৬ বছর বয়সেই এই মহান মনীষী বিখ্যাত একজন ডাক্তার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। অনেক বড়ো বড়ো ডাক্তারও তাঁর চিকিৎসাবিদ্যার গভীরতার সামনে নিজেদেরকে অত্যন্ত ছোট্ট বলে মনে করত।  নূহ বিন মানসুর সামানি যখন ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন কোনো চিকিৎসকই তাঁর চিকিৎসা করতে পারলেন না, সবাই অপারগতা প্রকাশ করলেন। অবশেষে আবু আলী সিনা তাঁর মেধা ও সৃজনশীলতা দিয়ে চিকিৎসা করার ফলে রোগী আল্লাহর ইচ্ছায় সুস্থ হয়ে যায়। এর ফলে সামানীয় শাসকের ব্যাপক মনোযোগ আকৃষ্ট হয় ইবনে সিনার ব্যাপারে। তিনি ইবনে সিনাকে সামানীয়নিদের লাইব্রেরি ব্যবহার করার অনুমতি দেন।

ইবনে সিনা এই সুযোগকে কাজে লাগান এবং বছর দুয়েকের মধ্যে ঐ লাইব্রেরির সকল বিষয়ের বই পড়া শেষ করেন। এই লাইব্রেরিতে নিজের পড়ালেখা সম্পর্কে স্বয়ং ইবনে সিনা বলেন, ‘লাইব্রেরির ভেতরে বহু কক্ষ। প্রত্যেক কক্ষেই থরে থরে বই সাজানো। বিভিন্ন তলায় বিষয় ভিত্তিক সাজানো ছিল বইগুলো। কোনো তলায় সাহিত্যের বই কোনো তলায় ফিকাহর, আবার কোনো তলায় চিকিৎসাসহ আরো বহু বিষয়ের বই সাজানো। আমি সেখানে আমাদের পূর্ববর্তী মনীষীদের লেখা বইগুলো পড়ার চেষ্টা করেছি। যখন যেটা চাইতাম সেটাই নিতাম। তিনি আরো বলেন,  সেখানে দুর্লভ বইগুলোও পাওয়া যেত। এমন অনেক বই পেয়েছি যেগুলো এর আগে দেখিনি, নামও তার আগে শুনিনি। আমার বয়স যখন আঠারো পূর্ণ হয় তখন মোটামুটি প্রায় সকল বিদ্যাই আয়ত্ত করেছিলাম এবং তারপর থেকে কোনো কিছুই আর আমার কাছে অনাবৃত থাকলো না। কেবল পার্থক্যটুকু ছিলো এই তখন আমার স্মৃতি ছিলো খুবই প্রখর আর এখন চিন্তা ও জ্ঞান হয়েছে শক্তিশালী।

ইবনে সিনার  ভাস্কর্য

ইবনে সিনা ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণযুগের চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন। চিকিৎসাবিদ্যায় তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে ‘আলকানুন ফিত তিব’।

এতো নির্ভরযোগ্য কোনো গ্রন্থ সে সময় অন্তত চিকিৎসাশাস্ত্রে ছিল না। এই বইটি অনূদিত হবার পর পশ্চিমারা ব্যাপকভাবে বইটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং তাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত বিদ্যালয় মহাবিদ্যালয়গুলোতে বইটিকে পাঠ্য করে দেয়।  গ্রিক চিকিৎসাবিদ জালিনূসের বই যেসব ইউরোপীয় চিকিৎসকদের কাছে দুর্বোধ্য ছিল তাঁরাও ইবনে সিনার কানুন গ্রন্থটির শরণাপন্ন হন। এর একটি কারণ ছিলো ইবনে সিনা তাঁর কানুন গ্রন্থে জালিনূসের দৃষ্টিভগিগুলোকেও বিশ্লেষণ করেছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে কানুন গ্রন্থটির বেশিরভাগ অনুবাদ হয়েছিল খ্রিষ্টীয় ষোল শতকে।  ইবনে সিনা বিভিন্ন শহরে প্রয়োজনীয় সফরে গেছেন। বিশেষ করে রেই শহর, হামেদান শহর এবং গোরগান শহরে গিয়েছিলেন তিনি। এইসব শহর সফরকালেই তিনি তাঁর কানুন গ্রন্থটি রচনা করেন।

চিকিৎসা শাস্ত্র এবং চিকিৎসা বিদ্যার ক্ষেত্রে তাঁর সমকালে এই গ্রন্থটিই ছিল সবচেয়ে সুশৃঙ্খল এবং গোছানো। সেই কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থাতেও এই গ্রন্থটি একটা সুশৃঙ্খল আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিল। কানুন পাঁচটি গ্রন্থের সমন্বিত সংকলন। এর প্রথম খণ্ডে রয়েছে মানুষের শরীর, রোগ এবং সুস্থতার জন্যে বিভিন্ন ঔষধের বর্ণনা। ১৯০৫ সালে এ বইটি ফ্রান্সে এবং ১৯৩০ সালে ব্রিটেনে অনূদিত হয়। দ্বিতীয় গ্রন্থে রয়েছে হার্বাল মেডিসিনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা। ইতালীয় ভাষায় এই গ্রন্থটি অনূদিত হয় এবং ১৫৯৩ সালে রোমে গ্রন্থটি ছাপা হয়। কানুনের তৃতীয় খণ্ডে ইবনে সিনা শরীরের প্রতিটি অঙ্গের রোগ সম্পর্কে লিখেছেন। চতুর্থ খণ্ডেও জ্বরের বিভিন্ন প্রকার রোগের বিচিত্র লক্ষণ, অপারেশন এবং দৃষ্টিশক্তির সমস্যা নিয়ে লিখেছেন। কানুনের পঞ্চম এবং সর্বশেষ খণ্ডে বু আলি সিনা ঔষধ তৈরি, এগুলোর মিশ্রণ এবং তার উপায় সম্পর্কে লিখেছেন। এছাড়াও ইবনে সিনা তাঁর কানুন গ্রন্থে নিজের ব্যক্তিগত বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও অর্জন সম্পর্কে লিখেছেন।

সর্বোপরি বলা যায় ইবনে সিনা তাঁর কানুন গ্রন্থটিতে তাঁর সময়কার গ্রিক এবং আরব চিকিৎসাবিদ্যার খুঁটিনাটিও সামগ্রিকভাবে সংকলিত করেছেন। যার ফলে এই গ্রন্থটি হয়ে উঠেছিল চিকিৎসা শাস্ত্রের জন্যে একটি আকর বা অবশ্য পাঠ্য একটি গ্রন্থ। বইটির ঐ বৈশিষ্ট্য আজো বিদ্যমান। চর্ম এবং মনোরাগ সম্পর্কেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করে গেছেন। 

কানুন গ্রন্থটি ছাড়াও ইবনে সিনা চিকিৎসা বিষয়ক আরো কয়েকটি বই লিখেছেন। চিকিৎসার তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক নিয়ম নীতিকে সহজে আত্মস্থ করার জন্যে ইবনে সিনা একটি কাব্যগ্রন্থও লেখেন। এই গ্রন্থটি উরজুযাতুন ফিত তিব নামে প্রসিদ্ধ। ইবনে সিনার কবিতা হিসেবে তাঁর এই বইটি খ্রিষ্টীয় তের শতক থেকে খ্রিষ্টীয় সতেরো শতক পর্যন্ত বেশ কয়েকবার ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। ইরানের বিশিষ্ট চিকিৎসাবিদ ও গবেষক ডক্টর বেলায়েতি ইবনে সিনার কবিতাকে কাব্যের আঙ্গিকে লেখা কানুন গ্রন্থেরই সারসংক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছেন।

ইবনে সিনা চিকিৎসা বিষয়ে, পেটের বৃহদন্ত সম্পর্কে, হার্টের বিভিন্ন রোগব্যাধি সম্পর্কে এবং সেইসাথে অন্যান্য রোগ বহু বিষয়ে অনেক চিঠিপত্র, গবেষণামূলক প্রবন্ধও লিখে গেছেন। তাঁর সমসাময়িককালে তো বটেই, পরবর্তীকালেও সেইসব লেখা নিয়ে গবেষকগণ ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছেন। গবেষণার এই ধারা এখনো আগের মতোই অব্যাহত রয়েছে।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/১৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ