জুন ২০, ২০২৩ ২১:০৮ Asia/Dhaka

শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক আজকের অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় আপনাদের সঙ্গে রয়েছি আমি… ও আমি…।  আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা হাশরের ৭ নম্বর আয়াত পর্যন্ত আলোচনা করেছিলাম। আজ আমরা এই সূরার ৮ থেকে ১৩ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন করব।  প্রথমেই এই সূরার ৮ থেকে ১০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

لِلْفُقَرَاءِ الْمُهَاجِرِينَ الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا وَيَنْصُرُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ (8) وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (9) وَالَّذِينَ جَاءُوا مِنْ بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آَمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ (10)

“[এই গনীমতের কিয়দংশ] নিঃস্ব মুহাজিরদের জন্য [ধার্য করা হলো] যারা নিজেদের বাড়িঘর ও সম্পত্তি হতে উৎখাত হয়েছে। তারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও সস্তুষ্টির অন্বেষণ করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে। এরাই তো সত্যাশ্রয়ী।” (৫৮:৮)

“আর [আনসারদের জন্যও একথা প্রযোজ্য] যারা মুহাজিরদের আগমনের আগে এ নগরীকে নিবাস হিসেবে গ্ৰহণ করেছে ও ঈমান গ্রহণ করেছে, তারা তাদের কাছে যারা [মক্কা থেকে] হিজরত করে এসেছে তাদের ভালবাসে এবং মুহাজিরদেরকে যা দেয়া হয়েছে তার জন্য তারা তাদের অন্তরে কোন (না পাওয়াজনিত) হিংসা অনুভব করে না, আর তারা নিজেরা প্রচণ্ড অভাবগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও মুহাজিরদেরকে নিজেদের উপর অগ্ৰাধিকার দেয়। বস্তুতঃ যাদেরকে অন্তরের কার্পণ্য থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে, তারাই সফলকাম।” (৫৮:৯)

“আর [তারাও] যারা মুহাজির ও আনসারদের পরে এসেছে, তারা বলে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে ও ঈমানে অগ্রণী আমাদের ভাইদেরকে ক্ষমা করুন এবং আমাদের অন্তরে মুমিনদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।”(৫৮:১০)

গত আসরে আমরা সেই গনিমাতের মালের কথা উল্লেখ করেছিলাম যা কোনো যুদ্ধ বা রক্তপাত ছাড়াই ইহুদিদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল। এরপর এই আয়াতগুলোতে বলা হচ্ছে: এই গনিমতে মুসলিম যোদ্ধাদের অংশ নেই, কারণ তারা যুদ্ধ করে তা অর্জন করেনি। এই গনিমত বণ্টনের দায়িত্ব রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এবং তিনি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে অভাবীদের মধ্যে তা বণ্টন করে দেবেন।

এখানে প্রথম অগ্রাধিকার পাবেন সেইসব নিঃস্ব মুহাজির মক্কায় যাদের ঘরবাড়ি ও সুন্দর জীবন ছিল। কিন্তু মদীনায় হিজরত করার কারণে তারা নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। দ্বিতীয় অগ্রাধিকার পাবেন সেইসব আনসার যারা নিজেরা দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও মুহাজিরদের আশ্রয় দিতে কার্পণ্য করেননি বরং নিজেদের ঘরে স্থান দিয়ে সাধ্যমতো তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছেন।

অগ্রাধিকারের পরবর্তী স্তরে মুহাজির বা আনসার নন বরং তাদের পরবর্তী যুগে যারা ঈমান এনেছেন তাদের কথা বলা হয়েছে। পরিভাষাগতভাবে তাদেরকে তাবেঈন বলে অভিহিত করা হয়। এই আয়াতগুলোতে আরো বলা হচ্ছে, আল্লাহর রাসূলকে মুসলিম সমাজ থেকে দারিদ্র দূরীকরণ করার জন্য সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা চালাতে হবে। বাকি মুমিনদের গনিমাতের মালের প্রতি কোনোরকম আকর্ষণ না রেখে তা দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- প্রতিটি মানুষের মাতৃভূমিতে বসবাস করার অধিকার রয়েছে। কাজেই মাতৃভূমি থেকে কাউকে বহিষ্কার করা হলে তার স্বাভাবিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়।

২- ঈমানদার নিঃস্ব মানুষ আল্লাহর সাহায্যের পানে তাকিয়ে থাকেন এবং কোনো মানুষের কাছে কিছু চান না।  তবে স্বচ্ছল মানুষের উচিত এ ধরনের মানুষের খোঁজখবর রাখা এবং সাধ্য অনুযায়ী তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করা।

৩- তারাই প্রকৃত ঈমানদার যারা কঠিন পরিস্থিতিতে এবং চরম আর্থিক কষ্টের মধ্যেও আল্লাহর রাস্তায় সাহায্য করতে কুণ্ঠিত হয় না।

৪- ঈমানদার অসহায়দের সাহায্য করা মুমিন ব্যক্তিদের অন্যতম  বৈশিষ্ট্য।

৫- লোভ, লালসা, হিংসা, বিদ্বেষ ও কার্পণ্য থেকে দূরে থাকতে পারলেই মানুষ পূর্ণতায় পৌঁছাতে পারে এবং এটি তার চূড়ান্ত সাফল্যের চাবিকাঠি।

৬- দ্বীনি বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে দেশ, কাল, পাত্র, সীমান্ত, বর্ণ, গোত্র ইত্যাদি দেখার বিষয় নয়। বরং দ্বীনদারি ও ঈমানের ভিত্তিতে এ ধরনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

এবারে সূরা হাশরের ১১ থেকে ১৩ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

أَلَمْ تَر إِلَى الَّذِينَ نَافَقُوا يَقُولُونَ لِإِخْوَانِهِمُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَئِنْ أُخْرِجْتُمْ لَنَخْرُجَنَّ مَعَكُمْ وَلَا نُطِيعُ فِيكُمْ أَحَدًا أَبَدًا وَإِنْ قُوتِلْتُمْ لَنَنْصُرَنَّكُمْ وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ (11) لَئِنْ أُخْرِجُوا لَا يَخْرُجُونَ مَعَهُمْ وَلَئِنْ قُوتِلُوا لَا يَنْصُرُونَهُمْ وَلَئِنْ نَصَرُوهُمْ لَيُوَلُّنَّ الْأَدْبَارَ ثُمَّ لَا يُنْصَرُونَ (12) لَأَنْتُمْ أَشَدُّ رَهْبَةً فِي صُدُورِهِمْ مِنَ اللَّهِ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَفْقَهُونَ (13)

“আপনি কি মুনাফিকদেরকে দেখেননি? তারা আহলে কিতাবের কাফের ভাইদের বলে, তোমরা যদি বহিষ্কৃত হও, আমরা অবশ্যই তোমাদের সাথে দেশত্যাগী হব এবং আমরা তোমাদের ক্ষতির ব্যাপারে কখনো কারো কথা মানবো না এবং যদি তোমরা আক্রান্ত হও আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে সাহায্য করব। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী।”(৫৮:১১)

“বস্তুত [কাফেররা] বহিষ্কৃত হলে মুনাফিকরা তাদের সাথে দেশত্যাগ করবে না এবং তারা আক্রান্ত হলে এরা তাদেরকে সাহায্য করবে না এবং এরা সাহায্য করতে যদি আসেও [তবে বিপদ দেখলে] অবশ্যই পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে; তারপর তারা কোন সাহায্যই পাবে না।”(৫৮:১২)

“প্রকৃতপক্ষে মুনাফিকদের অন্তরে আল্লাহর চেয়ে তোমাদের ভয়ই সবচেয়ে বেশী। এটা এজন্যে যে, এরা এক বিবেক-বুদ্ধিহীন সম্প্রদায়।”(৫৮:১৩)

আগের আয়াতগুলোতে মুমিনদের তিনটি দল অর্থাৎ মুহাজির, আনসার ও তাবেঈনদের নিয়ে কথা বলা হয়েছে এবং তাদের ঈমান, ইখলাস, ন্যায়নিষ্ঠতা ও আত্মত্যাগের বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই তিন আয়াতে মুমিনদের বিপরীত দলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যারা মদীনায় মুসলমানদের সঙ্গে বসবাস করত এবং বাহ্যিকভাবে ঈমানদারির দাবি করত। অথচ এরা প্রকৃতপক্ষে ছিল মুনাফিক। তারা গোপনে মদিনার ইহুদিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আঁটত।

ইহুদিরা মুসলমানদের সঙ্গে করা চুক্তি লঙ্ঘন করে তাদের নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল। এরকম অবস্থায় আল্লাহর রাসূল ইহুদিদেরকে মদীনা ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ জারি করেন। কিন্তু মুনাফিক সর্দার ইহুদিদের কাছে গিয়ে বলে: আপনারা শহর ছেড়ে চলে যাবেন না বরং এখানেই থাকুন। আমরা আপনাদের সহযোগিতা করব। আর যদি যু্দ্ধ বেধে যায় তাহলে আমরা আপনাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। কিন্তু বাস্তবে ইহুদিরা আগের চুক্তি করে লঙ্ঘন করলে মুসলিম বাহিনী তাদেরকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। এ অবস্থায় মুনাফিকদের অন্তরে এতটা ভয় ও শঙ্কা কাজ করে যে, তারা আর ইহুদিদের সাহায্য করতে এগিয়ে যায়নি। এ কারণে ইহুদিরা মুসলমানদের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং মদীনা থেকে বিতাড়িত হয়।

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-

১- ইসলামে মুমিনরা পরস্পরের ভাই। অপরদিকে মুনাফিক, কাফির ও ইসলামের শত্রুদের পরস্পরে রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।  মুনাফিকদের থেকে মুমিনদের আলাদা করার জন্য এটি একটি অব্যর্থ মাপকাঠি।

২- মিথ্যা, প্রতারণা, ভয় ও শঙ্কা মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য। তারা যুদ্ধের ময়দানসহ যেকোনো আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে পলায়ন করে।

৩- মুনাফিকদের কোনো প্রতারণামূলক, হতাশাজনক বা অহেতুক উত্তেজনা সৃষ্টিকারী বক্তব্যে আমাদের ভয় পেলে চলবে না। বরং আমাদের উচিত হবে কথা ও কাজে তাদের অন্তরে ভীতি সৃষ্টি করা যাতে তারা মানে মানে কেটে পড়ে এবং ইসলাম-বিদ্বেষী পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত থাকে।

তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আমাদের সঙ্গ দেয়ার জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।  

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/৩

 

ট্যাগ