কুরআনের আলো
সূরা আল-হাশর: ১৪-১৯ (পর্ব-৩)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা হাশরের ১৩ নম্বর আয়াত পর্যন্ত আলোচনা করেছিলাম। আজ আমরা এই সূরার ১৪ থেকে ১৯ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন করব। প্রথমেই এই সূরার ১৪ ও ১৫ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
لَا يُقَاتِلُونَكُمْ جَمِيعًا إِلَّا فِي قُرًى مُحَصَّنَةٍ أَوْ مِنْ وَرَاءِ جُدُرٍ بَأْسُهُمْ بَيْنَهُمْ شَدِيدٌ تَحْسَبُهُمْ جَمِيعًا وَقُلُوبُهُمْ شَتَّى ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَعْقِلُونَ (14) كَمَثَلِ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ قَرِيبًا ذَاقُوا وَبَالَ أَمْرِهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (15)
“শত্রুরা সবাই সংঘবদ্ধভাবেও তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না, তবে [যুদ্ধ করবে] শুধু সুরক্ষিত জনপদের ভিতরে [ও শক্ত অবস্থানে থেকে] অথবা দূর্গ-প্রাচীরের আড়ালে থেকে; তাদের পরস্পরের মধ্যে [চলে] প্রচণ্ড যুদ্ধ । আপনি মনে করেন তারা ঐক্যবদ্ধ, কিন্তু তাদের মনের মিল নেই; এটা এজন্যে যে, এরা এমন এক সম্প্রদায় যারা চিন্তা করে না।” ৫৯:১৪
“[বনু নাজির গোত্রের ইহুদিদের ঘটনা] সেই লোকদের মত, যারা কিছুদিন পূর্বে তাদের অন্তর্গত ছিল [ও মুনাফিকদের প্রতিশ্রুতিতে প্রতারিত হয়েছে] এবং নিজেদের পথভ্রষ্টতার দুর্ভোগ ও ব্যর্থতা উপভোগ করেছে; আর তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।” ৫৯:১৫
গত অনুষ্ঠানে আমরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে মদীনার ইহুদিদের ষড়যন্ত্র এবং তাদের সঙ্গে মুনাফিকদের গোপন আঁতাত সম্পর্কে কথা বলেছি। এরপর এই দুই আয়াতে বলা হচ্ছে, তোমাদের শত্রুরা বাহ্যিকভাবে পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের মধ্যে ঐক্য নেই। তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ স্বার্থের পেছনে ছুটছে। এমনকি তাদের মধ্যে প্রচণ্ড শত্রুতা ও সংঘাত বিদ্যমান রয়েছে।
তোমাদের অর্থাৎ মদীনার মুমিনদের ব্যাপারে ইহুদিদের অন্তরে এমন ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে যে, তারা নিজেদের বাড়ির চারদেয়াল ও দুর্গের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছে এবং যুদ্ধের ময়দানে তোমাদের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। এর ফলে আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা তাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছো। কাজেই তারা মুনাফিকদের ওপর নির্ভরশীলতার দুর্ভোগ এই পৃথিবীতেও ভোগ করেছে। আর পরকালে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে মর্মন্তুদ শাস্তি।
এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- মুমিন ব্যক্তিরা যদি আল্লাহর ওপর নির্ভরতার মাধ্যমে শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায় তাহলে আল্লাহ তায়ালা শত্রুর অন্তরে এমন ভীতির সঞ্চার করেন যার ফলে তারা পশ্চাদপসরণ করে ও আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
২- ইসলামের শত্রুদের বাহ্যিক ঐক্য স্থায়ী ও অটুট নয়। প্রকৃত ঐক্য সৃষ্টি হয় ধর্মীয় ও মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে যা চিরস্থায়ী হয় ও অটুট থাকে।
৩- অতীত হচ্ছে ভবিষ্যত পথচলার পাথেয়। অতীত জাতিগুলোর পরিণতি থেকে ভবিষ্যত প্রজন্মগুলোর শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
এবারে সূরা হাশরের ১৬ ও ১৭ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
كَمَثَلِ الشَّيْطَانِ إِذْ قَالَ لِلْإِنْسَانِ اكْفُرْ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِنْكَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ (16) فَكَانَ عَاقِبَتَهُمَا أَنَّهُمَا فِي النَّارِ خَالِدَيْنِ فِيهَا وَذَلِكَ جَزَاءُ الظَّالِمِينَ (17)
“[মুনাফিকদের হাতে আহলে কিতাবদের প্রতারিত হওয়া] শয়তানের [ধোকার] মতো; সে মানুষকে বলে, কাফের হয়ে যাও; তারপর যখন মানুষ কুফরী করে তখন সে বলে, তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই! নিশ্চয় আমি সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহকে ভয় করি।” ৫৯:১৬
“ফলে তাদের দু'জনের পরিণাম হলো এই যে, তারা দু’জনই চিরস্থায়ী জাহান্নামবাসী এবং এটাই যালিমদের কর্মফল।” ৫৯:১৭
সূরা আনফালের ৪৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, মুশরিকদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রথম যুদ্ধ অর্থাৎ বদরের যুদ্ধে শয়তান মুশরিকদের অন্তরে এই ধারনা বদ্ধমূল করে দেয় যে, মুসলমানরা সংখ্যা অতি নগন্য; কাজেই তোমরাই এ যুদ্ধে বিজয়ী হবে। এভাবে শয়তান যুদ্ধের ময়দানে অবিচল থাকার জন্য মুশরিকদের উস্কানি দেয়। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর শয়তান যখন মুসলমানদের শক্তিমত্তা দেখতে পায় তখন সে মুশরিকদের অসহায় অবস্থায় রেখে পালিয়ে যায়।
আজকের এই দুই আয়াতেও শয়তানের সেরকম প্রতারণার কথা উল্লেখ করেছেন মহান আল্লাহ। নানা সংকটে জর্জরিত একজন মানুষকে শয়তান এই বলে ধোকা দেয় যে, আল্লাহ তোমাকে সাহায্য করতে পারবে না। তুমি বরং আল্লাহর চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল তাহলে তোমার সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু যখন সে আল্লাহকে ভুলে যায় তখন শয়তানও তাকে ত্যাগ করে চলে যায়। মদীনার মুনাফিকরাও ইহুদিদের এই বলে ধোকা দিয়েছিল যে, আমরা তোমাদের সহযোগিতা করব এবং তোমরাই মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হবে। কিন্তু মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মুনাফিকরা ইহুদিদের সাহায্য না করে তাদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছে। এ ধরনের মুনাফিকরা পার্থিব জীবনে মুমিনদের হাতে পরাজিত হয় এবং পরকালেও তাদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- নিফাক বা কপট চরিত্র ধারণ করলে মানুষের অন্তর হয়ে যায় শয়তানের অন্তর। সে সব সময় মানুষকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করে।
২- সহযোদ্ধাদের সমগামী হওয়া থেকে বিরত থাকা এবং তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা না করার জন্য মুনাফিকরা সব সময় আল্লাহকে ভয় করার অজুহাত দেখায়। কঠিন বিপদের দিনে যাতে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে সেজন্য তারা এ কাজ করে।
৩- শুধু যে শয়তান মানুষকে খারাপ কাজ করতে প্ররোচনা দেয় তাই নয় বরং মুনাফিকরাও একই কাজ করে। মুনাফিকরা হচ্ছে মানুষরূপী শয়তান এবং লোকভোলানো কথায় এরা মানুষকে মুগ্ধ করে।
এবারে সূরা হাশরের ১৮ ও ১৯ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ (18) وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ نَسُوا اللَّهَ فَأَنْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ أُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ (19)
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; এবং প্ৰত্যেকের উচিত চিন্তা করে দেখা আগামীকালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত।” ৫৯:১৮
“আর তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে; ফলে আল্লাহ তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছেন। তারাই তো ফাসিক।” ৫৯:১৯
মদীনার মুনাফিক ও ইহুদিদের ব্যাপারে আলোচনা শেষে এখানে মহান আল্লাহ মুমিনদের উদ্দেশ করে বলছেন: তোমরা তাদের পরিণতি থেকে শিক্ষা নাও এবং আল্লাহকে ভুলে যেও না। কারণ, তা করলে আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেবেন। তখন তোমরা ক্রমান্বয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভের পরিবর্তে পার্থিব জগতের ভোগ্য বস্তুসমুহের মোহে পড়ে থাকবে। আর এ ধরনের জীবনের পরিণতি ফাসিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা।
কাজেই যেকোনো অবস্থায় আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণে রাখতে হবে, তাঁর জিকির করতে হবে। যেকোনো গুনাহের কাজ করার সময় আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে এই ভেবে যে, তিনি সবকিছু শুনছেন সবকিছু দেখছেন। আর যেকোনো সৎকাজ করার সময় আমাদেরকে ভাবতে হবে আল্লাহ তায়ালা আমাদের কর্ম দেখছেন এবং সৎকর্মের প্রতিদান দিতে তিনি কখনও ভুলবেন না। তিনি পরকালের জন্য আমাদের কৃতকর্ম সংরক্ষণ করেন।
এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার নিজের পরকালের পুঁজি অর্জন করে নিয়ে যেতে হবে। আমার মৃত্যুর পর আমার সন্তানরা আমার রুহের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে সৎকাজ করবে- এই আশায় বসে থাকা যাবে না।
২- আল্লাহ সব সময় আমাকে দেখছেন- অন্তরে এই অনুভূতি থাকলে মানুষের তাকওয়া বা খোদাভীতি বৃদ্ধি পায়। ফলে তার পক্ষে সৎকাজ করা এবং আল্লাহর নির্দেশিত নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা সহজ হয়।
৩- যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভুলে যায় সে যেন প্রকারান্তরে মানুষ সৃষ্টির বিজ্ঞচিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে ভুলে যায়। আর যে ব্যক্তি তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য ভুলে যায় সে মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা থেকে দূরে সরে যায়। এ ধরনের মানুষ তাদের গোটা জীবন ও আল্লাহ প্রদত্ত যোগ্যতা ও প্রতিভাকে ধ্বংস করে ফেলে।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি।
পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/ ২০
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।