জুন ২৮, ২০২৩ ১৭:১৩ Asia/Dhaka

গত পর্বে আমরা ইরানের খ্যাতনামা মনীষী ও বিজ্ঞানী জাবের ইবনে হাইয়্যানের জীবনী ও তার গবেষণাকর্মের কিছু দিকের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। ইরানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস বহু প্রাচীন। যুগে যুগে ইরানি মনীষীদের প্রচেষ্টায় চিকিৎসা বিজ্ঞান সমৃদ্ধ হয়েছে এবং মানব সমাজের কল্যাণে তা বিরাট অবদান রেখেছে। মুহাম্মদ জাকারিয়া রাজি, ইবনে সিনা, ফারাবি প্রমুখ ব্যক্তিরা শুধু ইরান নয় বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে পরিচিত। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা ইরানের আরো দু'জন বিখ্যত মনীষ

আবু যাকারিয়া ইয়াহিয়া বিন মাসভিয়ে খোজি ছিলেন একজন খ্যাতনামা ইরানি চিকিৎসক যিনি ইউহান্না নামে পরিচিত। তিনি হিজরি তৃতীয় শতাব্দীতে বাগদাদের আব্বাসীয় দরবারের নামকরা নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান চিকিৎসকদের একজন। বলা হয়ে থাকে ইউহান্নার পিতা তৎকালীন ইরান ভূখণ্ডের অন্তর্গত বাগদাদের জান্দি শাপুর হাসপাতালের নামকরা ফার্মাসিস্ট হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ওই হাসপাতালের প্রধান জিবরাইল বিন বাখতিশুয়া ছিলেন বাগদাদে বসবাসকারী খ্যাতনামা চিকিৎসক। তারই অনুরোধে আবু যাকারিয়া ইয়াহিয়া বিন মাসভিয়ে খোজি তথা ইউহান্নার পিতাকে বাগদাদের ওই হাসপাতালে কাজ করার আমন্ত্রণ জানানো হয়। ইউহান্না তার পিতার সাথে জিবরাইল বিন বাখতিশুয়ার কাছে চিকিৎসাবিদ্যা সংক্রান্ত জ্ঞানার্জন করেন। এরপর ইউহান্নাকে চিকিৎসা সংক্রান্ত বেশ কিছু গ্রন্থ বিশ্বের অন্যান্য ভাষা থেকে অনুবাদ করার দায়িত্ব দেয়া হয় এবং তার জন্য দক্ষ লেখকদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এ কারণে ধারণা করা হয়, যাকারিয়া ইয়াহিয়া তথা ইউহান্না সুরিয়ানি ও আরবি ভাষা ছাড়াও গ্রিক ভাষায়ও পারদর্শী ছিলেন। ইরানের এই বিখ্যাত খ্রিস্টান চিকিৎসা বিজ্ঞানী বাগদাদের তৎকালীন শাসক মামুন আব্বাসের যুগ থেকে নামকরা ডাক্তার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি বাগদাদে ২৪৩ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন এবং আব্বাসিয় শাসক মোতাওয়াক্কেলের নির্দেশে তাকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে সেখানে দাফন করা হয়।

যদিও ইউহান্না চিকিৎসাবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন, তবে মনে করা হয় তিনি যুক্তিবিদ্যাও অধ্যয়ন করেছিলেন। শিক্ষানুরাগী নামকরা ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতিতে আয়োজিত সেমিনারে দেয়া তার বক্তব্যগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে ব্যাপক প্রশংসিত হতো। আব্বাসিয় শাসক মামুনের শাসনামলে তিনি 'তাবিব আল মুলক' উপাধিতে ভূষিত হন। তৎকালীন সময়ের নামকরা চিকিৎসকরা উইহান্নার ব্যাপক প্রশংস করার পাশাপাশি তাকে একজন মহান চিকিৎসক হিসেবে অভিহিত করতেন।

চিকিৎসা বিষয়ে ইউহান্নার রচিত 'দাগাল আল-আইন' গ্রন্থটি সে সময় মেডিকেলের ছাত্রদের পড়ানো হতো। চক্ষু চিকিৎসক হতে গেলে ছাত্রদেরকে এ বইটি পড়ে পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট নিতে হতো। চিকিৎসা বিষয়ে তার অন্তত ৫০টি পুস্তিকা রয়েছে যার বেশিরভাগই চোখের নানা সমস্যা সংক্রান্ত। চক্ষু চিকিৎসা বিষয়ে তার অনেক লেখা ও প্রবন্ধ এক সময় খুবই নাম করেছিল।

এবারে আমরা আরও একজন বড় ইরানি মনীষীর জীবনী নিয়ে আলোচনা করব। ইরানের এই মনীষী চিকিৎসা-বিজ্ঞান জগতের এক বড় তারকা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। এই মহান চিকিৎসা-বিজ্ঞানীর নাম সাইয়্যেদ ইসমাইল জোরজানি। তিনি ছিলেন হিজরি পঞ্চম শতকের মনীষী। তাঁর  জন্ম হয়েছিল ইরানের জোরজানে যার বর্তমান নাম গোরগান। কাস্পিয়ান সাগরের কাছে অবস্থিত এই শহরে জোরজানির জন্ম হয়েছিল খ্রিস্টিয় ১০৪২ সালে। বলা হয় যে তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন মূলত ইস্ফাহান শহরের অধিবাসী। 

সাইয়্যেদ ইসমাইল জোরজানির যুগে জোরজান শহরটির অবস্থান ছিল উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির চরম শিখরে। তাই তিনি প্রাথমিক পড়াশুনার পর্বটি শেষ করেন এখানেই। জোরজানি যৌবনের প্রাক্কালে এ শহরেই তথা প্রাচীন গোরগানেই  শুরু করেছিলেন চিকিৎসা-বিদ্যা অধ্যয়ন। বিশ্বনন্দিত ইরানি চিকিৎসা-বিজ্ঞানী ইবনে সিনা কিছুকাল জোরজান শহরে ছিলেন। এ সময় তিনি সেখানে চিকিৎসা-বিজ্ঞান সংক্রান্ত তাঁর জগত-বিখ্যাত বই 'কানুন' লেখার পাশাপাশি কয়েকজন শিষ্য বা ছাত্রও গড়ে তোলেন।

ইবনে সিনা ছাড়াও আরও একজন বড় বিজ্ঞানী ও চিকিৎসাবিদ সে সময় থাকতেন সেই প্রাচীন গোরগানে। এই বিজ্ঞানীর নাম আবুল ফারাজ আলী ইবনে হুসাইন। তিনি ছিলেন চিকিৎসা-বিজ্ঞান সংক্রান্ত 'মিফতাহ আততিব' শীর্ষক বিখ্যাত বইয়ের লেখক। ৪০০ থেকে ৪০৫ হিজরি- এই ৫ বছর তিনি ছিলেন গোরগানে। তিনি এই শহরে বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে  অধ্যাপনা করেছেন। খুব সম্ভবত সাইয়্যেদ ইসমাইল জোরজানি ছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানে ইবনে সিনা ও আবুল ফারাজের শীর্ষস্থানীয় ছাত্রদের ছাত্র। 

জোরজানির লেখনী থেকে জানা যায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য তিনি বেশ কয়েকটি অঞ্চলে সফর করেছিলেন। এসবের মধ্যে রয়েছে নিশাপুর, ফার্স ও খুজিস্তান। এ ছাড়াও জোরজানি একই লক্ষে ইরাকের নানা অঞ্চলে সফর করেছেন। এইসব সফরের মাধ্যমে তিনি অংশ নিতেন প্রখ্যাত চিকিৎসাবিদদের ক্লাসে।

জোরজানির এইসব সফর থেকে হিজরি পঞ্চম শতকের চিকিৎসা-বিজ্ঞানের বড় ও বিখ্যাত কেন্দ্রগুলোর কথাও জানা যায়। সে যুগে উত্তরপূর্ব ইরানের নিশাপুর শহরটিও ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক বড় কেন্দ্র। এখানে ছিল বেশ কয়েকটি বড় ও বিখ্যাত হাসপাতাল। আবুল কাসেম ইবনে আবি সাদিক নিশাপুরি নামের একজন বিখ্যাত চিকিৎসকের ক্লাসে অংশ নেয়ার জন্যই জোরজানি নিশাপুরে এসেছিলেন।

জোরজানি চিকিৎসা-বিশ্বকোষ লিখেছিলেন ফার্সি ভাষায়। চিকিৎসা বিষয়ে ফার্সি ভাষায় এর আগে আর কখনও এমন পূর্ণাঙ্গ বিশ্বকোষ কেউ রচনা করেননি। এ বই ইরানের চিকিৎসা-বিজ্ঞানের ধারায় অসাধারণ অগ্রগতির সূচনা করে। ইরানের চিকিৎসা-বিজ্ঞানের পুনরুজ্জীবন ও এর বিকাশের জাতীয় আন্দোলনের মধ্যমনি হয়ে পড়ে জোরজানির এ বইটি তথা চিকিৎসা-বিশ্বকোষ। এ বই বিজ্ঞানে ইরানকে শতভাগ স্বনির্ভর করে এবং তা হয়ে ওঠে ইরানের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তার মাধ্যম।  জোরজানির এ বই ইরানের চিকিৎসা-পল্লী ও কেন্দ্রগুলো শক্তিশালী করার ক্ষেত্রেও রেখেছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

জোরজানির চিকিৎসা বিশ্বকোষের ছিল নয়টি খণ্ড। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অনুরোধে তিনি এর সঙ্গে যুক্ত করেন দশম খণ্ড। এতে ওষুধ তৈরি এবং ওষুধ সংক্রান্ত নানা দিক যেমন, ওষুধের ব্যবহার, প্রতিক্রিয়া ও কার্যকারিতা সম্পর্কিত বিদ্যা তথা ফার্মাকোলজি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন জোরজানি।#

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/২৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ