সুঅভ্যাস গড়ার উপায় নিয়ে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান
সুন্দর জীবন-পর্ব ৪৫
আবেগ আমাদের বাস্তব জীবনে চারপাশের মানুষের সাথে সম্পর্ক ও মিথস্ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আবেগ সাধারণত ক্ষণস্থায়ী হয়ে থাকে। তবে কোনো বিষয় যদি বাস্তব জীবনের সাথে সম্পর্কিত হয়, কিংবা কোনো মতবাদ ভিত্তিক হয় সেক্ষেত্রে ঐ বিষয় সংক্রান্ত আবেগ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে।
আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কও আবেগ-অনুভূতির সাথে সম্পর্কিত। আমাদের মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু কিংবা সহকর্মীদের সাথে সম্পর্ক কেমন তা অনেকটাই নির্ভর করে তাদের প্রতি আমাদের আবেগ-অনুভূতি তথা দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, তার উপর। কর্মক্ষেত্রে আবেগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষকরে যখন দলবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হয়। কর্মক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্মানবোধ, সহমর্মিতা, বিশ্বাস, আস্থা ইত্যাদি আবেগিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভরশীল। জীবনের নানা স্তরে আবেগিক বিকাশ ঘটে। তবে আবেগের সঙ্গে শৈশবের সম্পর্কই বেশি। যেমন শৈশবেই ভয়ের বিকাশ হয়। শৈশবেই ভয় বিভিন্ন ভাবে ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখা যায়। তিন বছর বয়সে এবং বাল্যের শেষের দিকে শিশুর ভয় তীব্র আকার ধারণ করে।
ছেলে ও মেয়ের মধ্যেও ভয়ের পার্থক্য দেখা যায়। যেমন এই স্তরে মেয়েরা সাপ, বেজী, ব্যাঙ এ সমস্ত প্রাণীরা ভয় পায়। আর ছেলেরা এগুলোতে খুব একটা ভয় পায় না। ভয় অনেকটা শিখন জনিতও বটে। এ কারণে পরিবারের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের উপরও ভয়ের ধরন নির্ভর করে। যেমন নিম্নবিত্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা সন্তানেরা বাবা-মায়ের পিটুনি, বকুনি ও সামাজিক পরিবেশের সন্ত্রাসকে বেশি ভয় পায়। অন্যদিকে, উচ্চবিত্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা সন্তানেরা গাড়ি দুর্ঘটনা, ঝড়, স্কুলে দুর্ঘটনা ইত্যাদিকে বেশি ভয় করে। তবে সব শিশুই প্রথম দিকে জীবজন্তু, অচেনা পরিবেশ, বিভিন্ন ব্যক্তি যেমন ডাক্তার, পাগল ইত্যাদিকে ভয় করে। তবে প্রথম দিকের এই সব বস্তুতান্ত্রিক ভয় বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমতে থাকে। স্নেহ, মায়া-মমতায় ভরা উষ্ণ পরিবারের সন্তানেরা কিছু ক্ষেত্রে কম ভীতু হয়। আরেকটি বিষয় ভয়ের পেছনে করতে পারে তাহলো অভাববোধ। যেকোনো ধরণের অভাববোধ ভয়ের কারণ হতে পারে। তবে শিশুদের মানসিক বিকাশের সাথে সাথে মনে ভয় ও উদ্বেগ বাড়তে পারে।
রাগ হলো বাল্যকালের অতি পরিচিত আরেকটি আবেগিক আচরণ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে রাগের প্রকাশ বাড়তে থাকে। বড় হওয়ার সঙ্গে চাহিদার বৃদ্ধি ঘটে। আর চাহিদা পূরণ না হলেই রাগের সৃষ্টি হয়। বাল্যকালে সাধারণত যে সব কারণে শিশুর রাগ হয় তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে চাহিদার পূরণ না হওয়া, কাজে বাধা পাওয়া, অনবরত সমালোচনার শিকার হওয়া, একটু দোষ-ত্রুটি হলেই কঠোরতার সম্মুখীন হওয়া, অন্য শিশুর সাথে তুলনার শিকার হওয়া, অপছন্দনীয় কোন দোষ আরোপ করা ইত্যাদি। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে রাগের প্রকাশে পরিবর্তন আসে। বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষ চাইলে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিজের বা সন্তানের ভয় ও রাগের মতো নানা আবেগের কারণ চিহ্নিত করতে সক্ষম। আজকের আসরের এ পর্যায়ে আমরা শিশুদের আবেগের যাতে সুষম বিকাশ ঘটে সে বিষয়ে আলোচনার চেষ্টা করব। মনে রাখবেন, যেসব শিশু কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলায় ও বিধি নিষেধের মধ্যে বড় হয়, খাওয়া দাওয়া, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি ব্যাপারে বাবা-মা বেশি কড়াকড়ি করেন, আবেগের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা পেয়ে এই সব শিশু মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়।
শিশুদের কঠোর নিয়ম-কানুনে বেধে রাখা সঠিক পন্থা নয়। জোর করে শিশুর কান্না বা হাসি থামানোর চেষ্টাও শিশুর পক্ষে ক্ষতিকর। সাধারণত ৪/৫ বছরের আগে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার মতো দৈহিক ও মানসিক পরিপক্বতা শিশুর হয় না। এ কারণে ৪/৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে, শিশু অনুকরণ প্রিয়। মা-বাবা যা ভয় করেন, যে রকম মেজাজ দেখান, আচরণ করেন, শিশু সেগুলো শিখে নেয়। কাজেই তাদের সামনে আচরণের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। মানসিক চাপ ও উত্তেজনাকে কিভাবে গঠনমূলক কাজে ব্যয় করা যায়, অপ্রীতিকর পরিস্থিতি কিভাবে মোকাবেলা করা যায় -শিশুকে শেখাতে হবে। শিশু যাতে আবেগের সাথে জড়িত মানসিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আবেগ প্রকাশের ওপর নিয়ন্ত্রণ নয় বরং আবেগের উদ্দীপকের নিয়ন্ত্রণ করা শেখাতে হবে। আবেগিক বিকাশ পরিচালনায় ভালো আবেগগুলো চর্চা করার ও উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা করতে হয়। ক্ষতিকর আবেগের প্রভাব কমিয়ে ভালো আবেগের বিকাশ ঘটালেই ব্যক্তিসত্তার সুষম বিকাশ ঘটবে। বড়দের জন্য শ্রদ্ধা, পরস্পরের জন্য সহানুভূতি আর সব কিছুর মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।
সুন্দরের প্রতি আসক্তি, মহৎ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, প্রতিবেশীর প্রতি সহমর্মিতা এসবই শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শানিত করা সম্ভব। উপযুক্ত বিষয়ে আনন্দ আর বেদনা পেতে শিখতে হবে। পরিবারের সুস্থ আবেগময় পরিবেশ শিশুর মধ্যে কেবল সুস্থ আবেগের বিকাশ ঘটায় তা নয়, পরিবারের ভালোবাসা, নিরাপত্তা, আনন্দঘন পরিবেশ শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। মনোবিজ্ঞানীরাও বলেন, ভালোবাসা-বঞ্চিত শিশুদের শারীরিক, মানসিক, আবেগিক ও সামাজিক বিকাশ ব্যাহত হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আবেগময় বঞ্চনা শিশুর শারীরিক বিকাশ বা বর্ধনকেও প্রভাবিত করে। প্রত্যেক শিশু যাতে বয়স অনুযায়ী পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে সেই উদ্দেশ্যে বাবা-মা, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে এই চেষ্টা থাকতে হবে।
শিশুদের নিজের ও অন্যদের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। হতাশামূলক পরিস্থিতিকে সহজ ভাবে নেওয়ার শিক্ষা দিতে হবে। জয়-পরাজয়কে সহজ ও সংযত ভাবে গ্রহণ করতে ও সাফল্যের উল্লাসকে সংযত ভাবে প্রকাশ করতে শেখাতে হবে। অন্যের প্রতি ঈর্ষান্বিত না হওয়ার অভ্যাস গঠনে ও বয়স উপযোগী মূল্যবোধ তৈরি করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। শিশু যদি এগুলো ঠিকমত করতে পারে তাহলেই তার আবেগিক বিকাশ সন্তোষজনক হবে। #
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।