কুরআনের আলো
সূরা আস- সফ: ১-৬ (পর্ব-১)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা মুমতাহিনার আলোচনা শেষ করেছিলাম। তারই ধারাবাহিকতায় আজ আমরা এর পরবর্তী সূরা অর্থাৎ সূরা সফের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন শুরু করব। মদীনায় অবতীর্ণ এই সূরাটিতে ১৪টি আয়াত রয়েছে। এই সূরার আয়াতগুলোর মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে মুসলিম ভূখণ্ড রক্ষা এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ। এই দু’টি শর্ত পূরণ করলে অন্যান্য ধর্ম ও মতাদর্শের ওপর ইসলামের বিজয়ের যে প্রতিশ্রুতি আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন তা বাস্তবায়িত হবে।
প্রথমেই এই সূরার ১ থেকে ৩ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
سَبَّحَ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ (1) يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ (2) كَبُرَ مَقْتًا عِنْدَ اللَّهِ أَنْ تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ (3)
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম”
“আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তার সবকিছু আল্লাহর প্রশংসা ও মহিমা ঘোষণা করে। আর তিনিই মহাপরামশালী প্রজ্ঞাময়।” ( ৬১:১)
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা কেন এমন কথা বলো যা তোমরা করো না?” ( ৬১:২)
“তোমরা যা কর না, তা বলা আল্লাহর নিকট বড়ই ক্রোধের বিষয়।”( ৬১:৩)
পবিত্র কুরআনের আরো কয়েকটি সূরার মতো এই সূরাটিও মহান আল্লাহর প্রশংসা দিয়ে শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে এই বাস্তবতার ওপর তাগিদ দেওয়া হয়েছে যে, বিশ্বজগতের প্রতিটি সৃষ্টি যেকোনো ধরনের দোষ, ত্রুটি, জুলুম ও অজ্ঞতা থেকে মহান আল্লাহর পবিত্রতার সাক্ষ্য দেয় এবং তাঁকে সব ধরনের প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে মনে করে।
পরের আয়াতে মুমিন ব্যক্তিদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয় স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হচ্ছে: কর্মহীন মৌখিক দাবির কোনো মূল্য নেই; বরং এর ফলে আল্লাহ তায়ালা ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। কখনও কখনও অনেককে বলতে শোনা যায়, জমিনে আল্লাহর দ্বীন সমুন্নত রাখার স্বার্থে প্রয়োজন হলে আমি আমার জান ও মাল আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করব। কিন্তু যখন ইসলামের শত্রুদের হামলার মুখে মুসলিম ভূখণ্ড রক্ষা করার প্রয়োজন হয় তখন এ ধরনের মানুষ পিছুটান দেয় ও জিহাদের ময়দান থেকে সরে পড়ে।
এই আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- পবিত্র কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, বিশ্বজগতের সকল সৃষ্টির উপলব্ধি ক্ষমতা আছে এবং তারা এক আল্লাহর মহীমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করার মাধ্যমে তাঁর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও প্রজ্ঞার সাক্ষ্য দেয়।
২- ঈমান ও দ্বীনদারির মৌখিক দাবি যথেষ্ট নয়। আমলে বা কাজে-কর্মে তার প্রমাণ দিতে হবে।
৩- যে ব্যক্তি মুখে দ্বীনকে সহযোগিতা করার দাবি করে কিন্তু কার্যত কিছুই করে না, সে যেন একথা না ভাবে যে, তার পক্ষে আল্লাহ তায়ালাকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এ ধরনের মানুষ পার্থব জীবন ও পরকালে আল্লাহর কঠিন শাস্তির মুখে পড়বে।
এবারে সূরা সফের ৪ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُمْ بُنْيَانٌ مَرْصُوصٌ (4)
“নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন যারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে সারিবদ্ধভাবে সুদৃঢ় প্রাচীরের মত।” (৬১: ৪)
আগের আয়াতগুলোতে তাদের প্রতি আল্লাহর চরম ক্ষোভের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে যারা ধর্ম পালন না করে বা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ না করেই মিথ্যা ঈমানদারির দাবি করে। এরপর এই আয়াতে বলা হচ্ছে, পক্ষান্তরে যারা কাজের লোক তারা আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ প্রাপ্ত হয়।
পৃথিবী সৃষ্টির আদি থেকে সব সময় যুদ্ধবিগ্রহ ছিল এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা চলতে থাকবে। এসব যুদ্ধ সাধারণত ক্ষমতা ও সম্পদ অর্জন এবং অন্য দেশের ভূখণ্ড ও সম্পদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে হয়ে থাকে। কিন্তু ইসলামে যে জিহাদের কথা বলা হয়েছে তা এসব লক্ষ্যে সংঘটিত হয় না। জালিমের শাসন ও শোসন থেকে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীকে মুক্তি দান এবং তাদের মাঝে আল্লাহর একত্ববাদের বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে জিহাদে অংশ নেন মুসলিম যোদ্ধারা।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে মুসলমানদের মধ্যে মতপার্থক্য ও বিভেদের কারণে ইসলামের শত্রুরা মুসলমানদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছে। এর ফলে মুমিন মুসলমানরা শত্রুদের আগ্রাসনের সামনে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিবর্তে নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করছে। । এ কারণে, এই আয়াতে ঈমানদারকে সীসাঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে জিহাদে অবতীর্ণ হতে বলা হয়েছে এবং এই ঐক্যকে বিজয়ের চাবিকাঠি বলে উপায় বাতলে দেওয়া হয়েছে।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দুটি বিষয় হচ্ছে:
১- আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা বা চেষ্টা চালানো ছাড়া তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব নয়।
২- অত্যাচারী ও আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করার সময় মুসলমানদেরকে নিজেদের মধ্যকার মাজহাবগত, জাতিগত ও ভাষাগত বিভেদ ভুলে সীসাঢালা প্রাচীরের মতো ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যেতে হবে।
এবারে সূরা সফের ৫ ও ৬ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ يَا قَوْمِ لِمَ تُؤْذُونَنِي وَقَدْ تَعْلَمُونَ أَنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ فَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ (5) وَإِذْ قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِنْ بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ فَلَمَّا جَاءَهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ قَالُوا هَذَا سِحْرٌ مُبِينٌ (6)
“আর [স্মরণ করুন], যখন মূসা তাঁর সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আমাকে কেন কষ্ট দিচ্ছ অথচ তোমরা জান যে, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহ্র প্রেরিত রাসূল? অতঃপর তারা যখন [সত্য থেকে বিচ্যুত হয়ে] বাঁকা পথ অবলম্বন করল তখন আল্লাহ্ তাদের হৃদয়কে বাঁকা করে দিলেন। আর আল্লাহ অবাধ্য পাপাচারী সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না।” (৬১:৫)
“আর [স্মরণ করুন], যখন মারইয়াম-পুত্র ঈসা বলেছিল, হে বনী ইসরাঈল! নিশ্চয় আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল এবং আমার পূর্ব থেকে তোমাদের কাছে যে তাওরাত রয়েছে আমি তার সত্যায়নকারী এবং আমার পরে আহমাদ নামে যে রাসূল আসবেন আমি তার সুসংবাদদাতা। পরে তিনি যখন তাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি নিয়ে আসলেন তখন তারা বলতে লাগল, এটা তো স্পষ্ট জাদু।” (৬১:৬)
এই দুই আয়াতে আল্লাহর দু’জন মহান নবী হযরত মূসা ও হযরত ঈসা আলাইহিমুস সালামের সঙ্গে বনি ইসরাইল জাতির দুর্ব্যবহারের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। বলা হচ্ছে: হযরত মূসা (আ.)-এর প্রতি ঈমান আনয়নকারীদের একটি দল আল্লাহর এই নবীকে অপমান-অপদস্থ ও তার ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে তাঁকে কষ্ট দেয়। তারা ঐক্যবদ্ধ থাকার পরিবর্তে দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এভাবে যাকে তারা মনেপ্রাণে আল্লাহর নবী বলে বিশ্বাস করত তাঁর সঙ্গে এমন অন্যায় আচরণের ফলে তারা আল্লাহর হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হয় এবং পরকালে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কঠোর শাস্তি।
হযরত ঈসা (আ.)ও নিজেকে দুই নবীর মধ্যবর্তী যুগের জন্য প্রেরিত উল্লেখ করে বলেন, তিনি তাঁর পূর্ববর্তী নবী হযরত মূসা (আ.)-এর সত্যতা নিশ্চিত করছেন এবং পরবর্তী নবী রাসূলুল্লাহ (সা.)র আগমনের সুসংবাদ দিচ্ছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বনি ইসরাইল জাতি তাঁর দাওয়াতের বাণী প্রত্যাখ্যান করে এবং নবীর পক্ষ থেকে প্রদর্শিত মুজিযা বা অলৌকিক ক্ষমতাকে যাদু বলে ব্যঙ্গ করে।
এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- পূর্ববর্তী নবীদের পাশাপাশি তাদের জাতিগুলোর ইতিহাসে আমাদের জন্য রয়েছে অনেক শিক্ষণীয় বিষয়। তাদের ইতিহাস জানা গেলে নানা ধরনের সমস্যা ও প্রতিকূলতার মোকাবিলায় বর্তমান সময়ের ঈমানদার মানুষদের ঈমান শক্তিশালী হয়।
২- নবী-রাসূলরা কষ্ট পান এমন আচরণ করলে আল্লাহর হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হতে হয়। এ ধরনের মানুষ কখনও ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করবে না।
৩- সকল নবী-রাসূলের পৃথিবীতে আগমনের লক্ষ্য ছিল একটাই। এ কারণে তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। তারা তাঁদের পরবর্তী নবী বা রাসূলের আগমনের সুসংবাদও দিয়েছেন।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ বাবুল আখতার/১৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।