কুরআনের আলো
সূরা জুমা: ১-৫ (পর্ব-১)
শ্রোতাবন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা সফের আলোচনা শেষ করেছি। কাজেই আজ থেকে আমরা সূরা জুমা নিয়ে আলোচনা শুরু করব।
মদীনায় নাজিল হওয়া এই সূরায় ১১টি আয়াত রয়েছে। এই সূরায় রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নবুওয়াতপ্রাপ্তির উদ্দেশ্য ও মানুষের মৃত্যু প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি মুমিন ব্যক্তিদেরকে জুমার নামাজ আদায় করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। প্রথমেই সূরার ১ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
يُسَبِّحُ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ الْمَلِكِ الْقُدُّوسِ الْعَزِيزِ الْحَكِيمِ (1)
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।”
“আসমানসমূহে যা আছে এবং যমীনে যা আছে সবই আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছে, যিনি [গোটা সৃষ্টিজগতের] অধিপতি, যেকোনো ত্রুটি থেকে পবিত্র, পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।”
আগের সূরাটির মতো এই সূরাও মহান আল্লাহর প্রশংসা দিয়ে শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, সৃষ্টিজগতের সবকিছু আল্লাহর প্রশংসা করে তসবিহ পাঠ করে। পবিত্র কুরআনের ভাষায়, জড় ও জীব নির্বিশেষে বিশ্বজগতের প্রতিটি সৃষ্টির বোধ শক্তি রয়েছে। এগুলো শুধুমাত্র যে তাদের সৃষ্টিকর্তাকে চেনে তাই নয় বরং তাঁর প্রশংসা ও মহীমা ঘোষণা করে। তবে আমাদের মানুষের পক্ষে এ বিষয়টি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। সূরা ইসরার ৪৪ নম্বর আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে: সাত আসমান ও যমীন এবং এগুলোর অন্তর্বর্তী সব কিছু আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করলেও তোমরা মানুষেরা তা বুঝতে পার না। আয়াতের পরবর্তী অংশে এ বিষয়ের ওপর জোর দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা শুধুমাত্র বিশ্বজগত সৃষ্টি করেই নিজের দায়িত্ব শেষ করেননি বরং এই জগতের সবকিছু পরিচালনার দায়িত্বও নিজে নিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু পার্থিব জগতের শাসকরা জনগণের প্রতি অন্যায় ও জুলুম করলেও আল্লাহ তায়ালা এমন মহাপরাক্রমশালী শাসক যিনি সব ধরনের ভুল-ভ্রান্তি ও ত্রুটি থেকে মুক্ত। তিনি নিজের কোনো বান্দার প্রতি জুলুম করেন না। কারণ, তিনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় এবং নিজের প্রজ্ঞা অনুযায়ী বিশ্বজগত পরিচালনা করেন।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:
১- আসমান ও জমিনে থাকা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, জড়পদার্থ, গাছপালা ও পশুপাখির সবাই আল্লাহর তসবিহ পাঠ করে এবং তাঁর ইবাদতে মশগুল থাকে।
২- মহান আল্লাহ নিজ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাহায্যে বিশ্বজগত পরিচালনা করেন এবং তার ইচ্ছাশক্তি ঠেকিয়ে দেওয়ার সাধ্য কারো নেই।
এবার সূরা জুমার ২ থেকে ৪ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ (2) وَآَخَرِينَ مِنْهُمْ لَمَّا يَلْحَقُوا بِهِمْ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ (3) ذَلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ (4)
“তিনিই নিরক্ষরদের একজনকে তাদের মধ্যে পাঠিয়েছেন রাসূলরূপে, যে তাদের নিকট আবৃত্তি করে তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে [অপবিত্রতা থেকে] পবিত্র করে এবং তাদেরকে শিক্ষা দেয় গ্রন্থ ও প্রজ্ঞা; যদিও ইতিপূর্বে তারা ছিল সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে।”
“এবং [তাঁকে রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন] তাদের মধ্য হতে অন্যান্যদের জন্যও যারা এখনো তাদের সাথে মিলিত হয়নি [বরং ভবিষ্যতে জন্মগ্রহণ করবে]। আর আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।”
“এই [নবুওয়াত] আল্লাহরই দয়া ও অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছে [এবং যাকে তিনি যোগ্য মনে করেন তাকে] তিনি এটা দান করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহের অধিকারী।”
এই তিন আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বর্ণনা করে বলা হচ্ছে: যে আরব জাতি স্বাক্ষরতা ও জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত ছিল এবং চরম মূর্খতা ও কুসংস্কারের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত ছিল মহান আল্লাহ তাদের কাছে নিজের বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য সেই জাতির মধ্য থেকেই একজনকে মনোনিত করলেন। এইনবদায়িত্ব ছিল নিজ জাতিকে হেদায়েত করা বা সৎপথ প্রদর্শন করা। আল্লাহর রাসূল প্রথমে তাদেরকে চারিত্রিক অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করেন এবং এরপর আল্লাহর ঐশী বাণী ও প্রজ্ঞাপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে তাদেরকে পূর্ণতার দিকে নিয়ে যান।
অবশ্য মহানবীর রিসালাতের দায়িত্ব শুধু মক্কাসহ আরব উপদ্বীপের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী যারা তাঁর দাওয়াতের বাণী গ্রহণ করে তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং মহান ঐশী শিক্ষার আলোয় অবগাহন করে নিজেদের ধন্য করবে তাদের সবাই বিশ্বনবী (সা.)-এর উম্মতের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর এই প্রক্রিয়া চলবে কিয়ামত পর্যন্ত। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে যত নবী-রাসূল এসেছেন বিশেষ করে তাঁদের সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন মানবজাতির প্রতি মহান আল্লাহর সেরা দয়া ও অনুগ্রহ। কারণ, নবী-রাসূলগণ জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, কুসংস্কার, উগ্রতা ও উদাসীনতার অন্ধকার থেকে মানবজাতিকে মুক্তি দিয়ে তাদেরকে ঐশী বাণীর আলোকে পবিত্রতা ও সৌভাগ্যের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন ও সত্যের পথ প্রদর্শন করেছেন।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- নবীদের রিসালাতের ফলে মানব সমাজ সমৃদ্ধি ও পূর্ণতার দিকে ধাবিত হয়।
২- যে সমাজের মানুষ গভীর অজ্ঞতা, মূর্খতা ও কুসংস্কারে নিমজ্জিত সেই সমাজেরই একজন মানুষকে নবুয়াতের দায়িত্ব দেয়াই একটি মুজিযা বা অলৌকিক ঘটনা।
৩- তাজকিয়া বা আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংশোধন হতে হবে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা ও রাসূলে আকরাম (সা.)-এর সুন্নত অনুযায়ী; কোনো মানব-রচিত মতাদর্শ বা ভুয়া আধ্যাত্মিক শক্তির মাধ্যমে নয়।
৪- ইসলামের নবীর রিসালাত শুধুমাত্র আরব জাতি বা তাঁর যুগের মানুষদের জন্য সীমাবদ্ধ নয়; বরং সকল যুগের সকল জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে অন্ধকার থেকে মুক্তি দিতে তিনি ধুলির ধরায় আগমন করেছেন।
এবারে সূরা জুমার ৫ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:
مَثَلُ الَّذِينَ حُمِّلُوا التَّوْرَاةَ ثُمَّ لَمْ يَحْمِلُوهَا كَمَثَلِ الْحِمَارِ يَحْمِلُ أَسْفَارًا بِئْسَ مَثَلُ الْقَوْمِ الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآَيَاتِ اللَّهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ (5)
“যাদেরকে তাওরাতের দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়েছিল [এবং তার অনুসরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল], কিন্তু তারা তা বহন করেনি [এবং তা মেনে চলেনি], তাদের উদাহরণ গাধার মত! যে বহু পুস্তক বহন করে [কিন্তু এই পুস্তকের শিক্ষা বাস্তবায়ন করে না]। কত নিকৃষ্ট সে সম্প্রদায়ের দৃষ্টান্ত যারা আল্লাহর আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে! আর আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না।”
আগের আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াতের কথা বলার পর এই আয়াতে মুসলমানদের সতর্ক করে দিয়ে বলা হচ্ছে: তোমরা ইহুদিদের মতো হয়ো না যাদের ওপর তাওরাত নাজিল হয়েছিল কিন্তু তাদের একাংশ এই ঐশী গ্রন্থের শিক্ষা পালন করেনি বরং শুধুমাত্র তাওরাতের বাহ্যিক রূপটি ঠিক রেখেছে। তাদের আরেকটি দল তাওরাতের বাহ্যিক রূপটিও অক্ষুণ্ন রাখেনি বরং এই ঐশী গ্রন্থের শিক্ষা প্রত্যাখ্যান করেছে।
যে পশুটি বইয়ের বোঝা পিঠে করে নিয়ে চলে যায় সে শুধু বোঝার ওজন বুঝতে পারে কিন্তু বইয়ের মধ্যে যে জ্ঞান আছে সে সম্পর্কে তার কোনো ধারনা থাকে না। ঠিক তেমনিভাবে যেসব মুসলমান বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কুরআন হাতে নেয়, এটিকে চুমু খায় এবং সম্মান প্রদর্শন করে তারা এই মহাগ্রন্থের ওজন বহন করে মাত্র। এ ধরনের মানুষ কুরআনের শিক্ষা গ্রহণ বা ঐশী বিধান অনুযায়ী নিজেদের জীবন সাজাতে পারে না।
এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- পবিত্র কুরআন উদাসীন মানুষ ও আমলবিহীন আলেমদের পশুর সঙ্গে তুলনা করেছে। কারণ, তারা আল্লাহর ওহীর নূরের অবগাহনে সিঞ্চন করেনি এবং এই কিতাবের সদ্ব্যবহার করেনি।
২- শুধুমাত্র কুরআন তেলাওয়াত করলেই হবে না বরং এর শিক্ষাকে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করতে হবে। তা না হলে মানুষকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহী করতে হবে।
৩- ঐশী শিক্ষা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন না করা প্রকারান্তরে ওই শিক্ষাকে অস্বীকার করারই শামিল। এর ফলে মানুষ হেদায়েতের আলো থেকে বঞ্চিত হয়।
তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। আগামী আসরেও আপনাদের সঙ্গ পাওয়ার আশা রাখছি। #
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ বাবুল আখতার/৩১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।