অক্টোবর ১০, ২০২৩ ১৪:৫৩ Asia/Dhaka
  • আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনে বিপর্যস্ত নারী ও শিশু
    আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনে বিপর্যস্ত নারী ও শিশু

গত পর্বের আলোচনায় আমরা ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন সেনাদের নৃশংসতা বিশেষ করে নারীদের ওপর তাদের অকথ্য নির্যাতনের কিছু ঘটনা তুলে ধরেছিলাম। আলোচনার শেষে আমরা আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের কথা উল্লেখ করেছিলাম। আজকের আলোচনায় আমরা মার্কিন আগ্রাসনে আফগান ইরাকি নারীদের অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা

আফগানিস্তান এমন একটি দেশ যা বিভিন্নভাবে মার্কিন আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ২০০২ সালে দক্ষিণ আফগানিস্তানের কাকরাক গ্রামে সংঘটিত নৃশংস ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। ওই বছরের জুলাই মাসে মার্কিন সেনারা এই গ্রামের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়ে ৪৮ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল। এরপর ব্যাপক সমালোচনার মুখে ওই হামলার পরের দিন মার্কিন ও আফগান সেনারা ঘটনা তদন্তের জন্য ওই গ্রামে যায়। তারা সেখানে গিয়ে দেখে অসহায় নারী ও শিশুদের মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।

আফগানিস্তানে বেসামরিক মানুষ বিশেষ করে নারী ও শিশু হত্যায় আমেরিকার অপরাধের মাত্রা কেবল এ ঘটনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। মার্কিন নৃশংসতার আরো অনেক দুঃখজনক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে সারা বিশ্ব। মার্কিন বিমান হামলায় ৬০ জন শিশুসহ ৯০ জন আফগান বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।  ঘটনাটি ঘটেছে আফগানিস্তানের আজিজাবাদ অঞ্চলের নওয়াবাদ গ্রামে। এই অঞ্চলের আফগান সংসদ সদস্য বলেছেন, গ্রামবাসীরা একটি স্মরণ সভায় সমবেত হলে তখন তারা মার্কিন বিমান হামলার শিকার হয়েছিল।

আফগানিস্তানের ফারাহ প্রদেশে অবস্থিত একটি গ্রামে আমেরিকার বিমান হামলায় এই গ্রামের বহুসংখ্যক লোক নিহত হয়েছিল। যদিও প্রকাশিত পরিসংখ্যানে নিহতের সংখ্যা নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে তবে সব পরিসংখ্যানেই মৃতের সংখ্যা বিপুল বলে উল্লেখ করা হয়। আফগান সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় যে ওই বোমা হামলায় প্রায় ১৪০ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে যাদের মধ্যে বেশীরভাগ ছিল নারী ও শিশু। 

নানগারহার প্রদেশের সাঙ্গিন এলাকায়ও আমেরিকার বিমান হামলায় যারা নিহত হয়েছিল তাদের মধ্যে ৫২ জনের বেশি ছিল নারী ও শিশু।

এছাড়া, ২০২১ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে, "কান্দাহার গণহত্যা" নামে একটি ঘটনায় এক মার্কিন সেনা কমান্ডার রবার্ট বিলস একাই কান্দাহার প্রদেশের পাঞ্জাওয়াই জেলায় একই পরিবারের ১৬ জনকে হত্যা করেছিল। এর মধ্যে ৯টি শিশু এবং ১১ জন নারী ছিল। লোমহর্ষক ও হত্যাকাণ্ডের পর মৃতদেহগুলোকে জ্বালিয়ে দেয়া হয়।

মানবাধিকারের দাবিদার মার্কিন সরকারের অপরাধযজ্ঞ কেবল আফগানিস্তান কিংবা ভিয়েতনামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। আমেরিকা ২০০৩ সালের ২০ মার্চ ইরাকে বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালায় যার নাম ছিল "অপারেশন ইরাকি ফ্রিডম"। ইরাকের জনগণকে সাদ্দামের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার নামে মার্কিন ওই আগ্রাসনে ১২ লাখের বেশি ইরাকি প্রাণ হারিয়েছে। এসব হামলায় নিহতদের মধ্যে ৪০ শতাংশ ছিল নারী ও শিশু। এই অসম যুদ্ধের সবচেয়ে তিক্ত ঘটনাটি ছিল ইরাকের নারী ও শিশুদের উপর নজিরবিহীন সহিংসতা ও যৌন নিপীড়ন। আন্তর্জাতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের বছরগুলোতে ৪০ হাজারেরও বেশি ইরাকি নারীকে অপহরণ ও ধর্ষণ করা হয়েছিল। এছাড়া, ১০ হাজারেরও বেশি ইরাকি নারী আমেরিকার কারাগারে বন্দী ছিল, তাদের মধ্যে ৯৫ শতাংশ নারী মার্কিন বর্বর সেনাদের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল। ইরাকে নারীদের বিরুদ্ধে মার্কিন সেনাদের অপরাধযজ্ঞের আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা হচ্ছে একটি গ্রামে বহুসংখ্যক মেয়েকে তারা ধর্ষণ করেছিল। একটি ঘটনার ব্যাপারে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছিল, ১৬ বছর বয়সী ইরাকি মেয়েকে তার বাবার সামনে মার্কিন সেনারা গণধর্ষণ করেছিল।

২০০৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক বাহিনী ইরাক দখলের পর, আবু গ্বারিব কারাগারে থাকা অসহায় ইরাকি মহিলারাও মার্কিন সেনাদের দ্বারা ধর্ষিত হতো এবং নানাভাবে অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হতো। কারাগারে আটক  অনেক যুবতী ছিল যাদের স্বামীরাও জেলখানায় আটক ছিল।

তারা স্বামীদের  সাথে যোগাযোগ করে যেভাবেই হোক নিজেদের মৃত্যু কামনা করতো যাতে জেলখানার অসহ্যকর যন্ত্রণা থেকে তারা রেহায় পেতে পারে। এসব নারীরা এতোটাই মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েছিল  যে জেলখানা থেকে বের হয়ে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এ ব্যাপারে খ্যাতনামা সাংবাদিক সাইমন হার্শ বলেছেন, ইরাকের আবু গ্বারিব কারাগারে নারীদের সাথে যে নৃশংস আচরণের ঘটনা ঘটেছে তা ভিয়েতনামের মাই লাই গ্রামের নারীদের সাথে নির্যাতনের ঘটনাকে ছাড়িয়ে গেছে।

শুধু নারীদের ওপরই নয় ইরাকের জেলখানায় আটক পুরুষ বন্দীদের ওপরও অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তাদেরকে উলঙ্গ করে হিংস্র কুকুরের সামনে ছেড়ে দেয়া হয়, তাদের ওপর বিকৃত যৌন নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের জন্য এমন কোনো উপকরণ ছিল না যা তাদের ওপর প্রয়োগ করা হয়নি।

বাস্তবতা হচ্ছে, জাপানে মার্কিন পরমাণু বোমা হামলা, ভিয়েতনামের মাই লাই গ্রামে মার্কিন বর্বর সেনাদের নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণ, ভিয়েতনামে ব্যাপক রাসায়নিক বোমা হামলা, আফগানিস্তানে বেসামরিক মানুষজনকে হত্যা করা, ইরাকের জনগণকে স্বাধীনতা এনে দেয়ার নামে সেখানে মার্কিন সেনাদের অপরাধী কর্মকাণ্ড এসবই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের অপরাধযজ্ঞের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এভাবে দশকের পর দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে, মানবতার বিরুদ্ধে ভয়াবহ অপরাধযজ্ঞ চালিয়ে আসছে। তাই নারীর অধিকার নিয়ে তারা যেসব শ্লোগান দেয় তা আসলে প্রতারণা ও ফাকা বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৭ বছরের ইতিহাসে এ ধরনের বহু কালো অধ্যায় যুক্ত হয়েছে। তারা যতই মানবাধিকার রক্ষার কথা বলুক, নারী অধিকারের কথা বলুক না কেন তাদেরকে এখন আর কেউ বিশ্বাস করে না। বরং তারা বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকির ঘটনা, ভিয়েতনামে নারীদের ওপর অত্যাচার এবং ইরাক ও আফগানিস্তানের নারী, মেয়ে ও শিশুরাই যে মার্কিন সেনাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছে তাই নয় বিশ্বের আরো অন্যান্য প্রান্তেও নারীরা মার্কিন সহিংসতার শিকার হয়েছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা কি অবস্থায় রয়েছে তা নিয়েও বহু প্রশ্ন রয়েছে। সাপ্তাহিক দর্পণ অনুষ্ঠানের আগামী পর্বে সুযোগ মতো আমরা আমেরিকায় বসবাসারী নারীদের অবস্থা সম্পর্কে আলোচনার চেষ্টা করবো।# (সমাপ্ত)

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ