অমর মনীষী আল ফারাবি-(পর্ব-৯)
ইহুদি দার্শনিক এবং চিন্তাবিদদের পাশাপাশি, বিভিন্ন বিষয়ে ফারাবি তার মতামত ও গবেষণাকর্ম দিয়ে খ্রিস্টধর্ম এবং ইউরোপের প্রাচীন রোমের ল্যাটিন ভাষাভাষী পণ্ডিতদেরকেও প্রভাবিত করেছিলেন। মধ্যযুগে আরবি-ল্যাটিন অনুবাদ আন্দোলনের সাথে গ্রীক থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ আন্দোলনের মিল রয়েছে। তখন প্রচুর সংখ্যক ইসলামী দার্শনিক ও পণ্ডিতদের গবেষণাকর্ম আরবি থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল এবং এভাবে পশ্চিমাদের কাছে মুসলিম গবেষণাকর্মগুলো তুলে ধরা হয়েছিল।
এইভাবে খ্রিস্টান বিশ্বের যেসব খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ছিলেন তারা যেসব মুসলিম মনীষীদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন আল-ফারাবি। পশ্চিমা বিশ্বে ফারাবির প্রভাব শুধু দর্শন ও যুক্তিবিদ্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং নীতিশাস্ত্র, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাতেও ফারাবির ব্যাপক প্রভাব ছিল।
অবশ্য পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান বিশ্বে ইসলামী দর্শনের প্রভাববিস্তার কেবলমাত্র অনুবাদ আন্দোলনের মাধ্যমেই হয়নি। যদিও পাশ্চাত্যে ফারাবিসহ মুসলিম মনীষীদের গবেষণাকর্ম ও ইসলামি দর্শন পরিচিতির ক্ষেত্রে অনুবাদগুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল কিন্তু এই পরিচিতি আংশিকভাবে মুসলমানদের সাথে পশ্চিমাদের যোগাযোগ ও ব্যক্তিগত সংযোগের কারণেও হয়েছিল। ফ্রেডরিক দ্বিতীয় হোহেনস্টাউফেনের (Fredrick-II-Hohenstaufen) সময়কালে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, যার ফলে ফারাবিসহ অন্য মুসলিম মনীষীদের দার্শনিক কাজের সাথে তাদের পরিচয় ঘটেছিল। একই সময়ে, কিছু খ্রিস্টান পণ্ডিত, যেমন র্যামন লুল ও র্যামন মার্টির মতো ব্যক্তিরা আরবি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন এবং কোনো অনুবাদক ছাড়াই আরবি লেখালেখি ও গবেষণাকর্মগুলো অধ্যয়ন করেছিলেন যা পরবর্তীতে তারা খ্রিস্টান ছাত্রদের কাছে তুলে ধরেছিলেন।
ল্যাটিন ভাষায় মুসলিম যে রচনাগুলো অনুবাদ হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল চিকিত্সা বিজ্ঞান সংক্রান্ত বইপুস্তক। তবে, আফ্রিকার তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত অনুবাদক কনস্টানটাইন এই রচনাগুলোর আরবি এবং ইসলামিক উৎসকে আড়াল করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে, মুসলিম গবেষণাকর্ম এবং মূল্যবান গ্রন্থগুলা অন্য ভাষায় অনুবাদের ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ অন্যান্য বিজ্ঞান ও দর্শন সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ইসলামিক উত্সকে অস্বীকার করা অনেকের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে।
টলেডো অঞ্চলের খ্রিস্টানরা ফারাবিসহ অন্য মুসলিম দার্শনিকদের গবেষণাকর্মগুলো অনুবাদ করার দিকে বেশি মনোনিবেশ করেছিলেন৷ ওই অঞ্চলের খ্রিস্টান অনুবাদকরা ১২ শতকের মাঝামাঝি থেকে মুসলমানদের দার্শনিক কাজগুলো অনুবাদ করতে শুরু করেছিলেন। তাদের মধ্যে ক্রেমোনার জেরার্ড ও ডোমিনিকস গোন্ডিসালভি ছিলেন প্রসিদ্ধ অনুবাদক। টলেডো অঞ্চলে অনুবাদের ঐতিহ্য শুরু হয়েছিল আল-ফারাবির বিজ্ঞান সংক্রান্ত গ্রন্থের অনুবাদের মধ্য দিয়ে। যা সেরমোনা এবং গোন্ডিসালভি দ্বারা ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ হয়।
তবে, অনুবাদকর্ম কেবল রোমসহ ইউরোপের অন্য অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সিসিলি অঞ্চল এবং দক্ষিণ ইতালিকেও লাতিন ভাষায় মুসলিম রচনাগুলোর অনুবাদের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে বিবেচনা করা হতো। সিসিলি অঞ্চলে, বেশিরভাগ মনোযোগ ইবনে রুশদের কাজের উপর নিবদ্ধ ছিল এবং যতদূর জানা যায়, ফারাবির রচনাগুলোতে তাদের তেমন মনোযোগ ছিল না। অর্থাৎ যতটুকু গুরুত্ব পাওয়া দরকার ছিল ততটুকু পায়নি। এছাড়াও, এটা উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই অঞ্চলগুলোর অনুবাদের কিছু অংশ ইতালিয় ইহুদিদের দ্বারা করা হয়েছিল যা মূল আরবি পাঠ্য থেকে নয় বরং হিব্রু ভাষা থেকে অনুবাদ করা হয়েছিল। তাছাড়া, ফারাবির রচনাগুলোর অনুবাদ ইতালিতে তখনও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। সে কারণে ফারাবীর রচনাগুলোর প্রতি যে পরিমাণ মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল তা ইবনে রুশদ ও ইবনে সিনার তুলনায় কম ছিল। যদি আমরা ইবনে সিনার উপর ফারাবির গভীর প্রভাবের বিষয়টি লক্ষ্য করি, তাহলে আমরা বুঝতে পারবো যে সিসিলিতে ইবনে সিনার রচনাগুলোর অনুবাদের ফলে ওই অঞ্চলে ফারাবির মতামত বা চিন্তাদর্শনেরও পরোক্ষ প্রভাব পড়েছিল। ফারাবির এই পরোক্ষ প্রভাবের বিষয়টি এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা জানি ১৩ ও ১৪ শতকে ইউরোপে বিশেষ করে ইতালি, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যেখানে ধর্মতত্ত্ব, শিল্প ও আইনের তিনটি অনুষদের মধ্যে দুটিতে মুসলিম দার্শনিকদের গ্রন্থগুলো পড়ানো হতো। বিশেষ করে ইউরোপের ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফারাবি, ইবনে সিনা এবং ইবনে রুশদের দর্শন ও যুক্তিবিদ্যার ওপর গ্রন্থগুলো ছাত্রদেরকে পড়ানো হতো।
বিজ্ঞান বিষয়ে ফারাবির গ্রন্থের খ্যাতনামা দুইজন ল্যাটিন অনুবাদকের একজন ছিলেন ডমিনিকাস গোন্ডিসালভি। এই খ্রিস্টান পণ্ডিত ও অনুবাদক 'দর্শনের শ্রেণীভাগ' নামে একটি গ্রন্থও লিখেছেন, যেখানে তিনি ফারাবির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে ফারাবির বইয়ের অনেক বিষয়বস্তু তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া তিনি ফারাবীর লেখাগুলোতে ছোটখাটো পরিবর্তন এনে তা নিজের নামে প্রকাশ করেছেন। যদিও জেরার্ড সার্মোনার 'ইহসা আল-উলূম' গ্রন্থের ল্যাটিন অনুবাদ অনেক বেশি সাহিত্যিক ও নির্ভুল কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব এই বইটির সাথে পরিচিত হয়েছিল গোন্ডিসালভির প্রথম অনুবাদের মাধ্যমে এবং তারপরে একই বিষয়ে তার পৃথক লেখার মাধ্যমে যেখানে ফারাবির মতামতের ব্যাপক প্রভাব ছিল। গোন্ডিসালভি সম্পর্কে একটি মজার বিষয় হচ্ছে যে তিনি ফারাবির লেখা ব্যবহার করে নিজের নাম, যশ, খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এমনকি তাঁর ছাত্র এবং অনেক খ্রিস্টান পণ্ডিতদের মধ্যে তিনি 'আল-ফারাবিউস' নামে পরিচিত হয়ে ওঠেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে, ইউরোপের পণ্ডিত ও অনুবাদক গোন্ডিসালভিকে পশ্চিমে ফারাবির মতামত ও বিভিন্ন বিষয়ে তার চিন্তাদর্শন ছড়িয়ে দেওয়ার পরোক্ষ মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করা উচিত। কেননা বিজ্ঞানের শ্রেণীভাগ বিষয়ে ফারাবির লেখাগুলো ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ ও পাশ্চাত্যে তা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে গোন্ডিসালভির গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।
এ প্রসঙ্গে আমরা আরেকজন বিখ্যাত অনুবাদক মাইকেল স্কটের কথা উল্লেখ করতে পারি, যিনি অনুবাদকর্ম ও জ্ঞান স্থানান্তরে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। বলা যায় জ্ঞান স্থানান্তরে আল ফারাবী মাইকেল স্কটের কাছেও ঋণী ছিলেন। বিজ্ঞানকে শ্রেণীবিন্যাস করার ক্ষেত্রে আল-ফারাবির পদ্ধতিটি ছিল পাশ্চাত্যের পণ্ডিতদের প্রধান আকর্ষণের বিষয়। রজার বেকন প্রকৃতি বিজ্ঞানের শ্রেণীবিন্যাসে ফারাবির পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। এ ছাড়া, ফারাবির যুক্তিবিদ্যার অষ্টভুজাকার বিভাগগুলোও প্রায় সম্পূর্ণরূপে পশ্চিমা বিশ্বে স্থানান্তরিত হয়েছে। #
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।