নভেম্বর ৩০, ২০২৩ ১৫:৫৭ Asia/Dhaka
  • ঘটনার নেপথ্যে (পর্ব-৪)

গত আসরে আমরা ইরানে গত বছরের সহিংসতা ছড়িয়ে দিতে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বা পেন্টাগন ও দেশটির গণমাধ্যমের ভূমিকা সম্পর্কে কথা বলেছি। আজ আমরা ওই দাঙ্গার সময় ইরানে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মানুষকে উস্কে দিয়ে কীভাবে এ দেশটিকে খণ্ড-বিখণ্ড করার চেষ্টা করা হয়েছিল সে সম্পর্কে আলোচনা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান পশ্চিম এশিয়ায় অবস্থিত একটি দেশ। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিশ্বের নানা দেশ ও জাতির অভিবাসীরা ইরানি ভূখণ্ড অতিক্রম করে বিভিন্ন দেশ সফর করেছে। ইরান অতিক্রম করে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশে অভিবাসনের সময় কখনও এই দেশটি শুধুমাত্র অতিক্রমস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে আবার কখনও বা কোনো কোনো জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ ইরানকে বসবাসের জন্য নিরাপদস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে। এ কারণে ইরানে বহু জাতি-গোষ্ঠী ও বর্ণের মানুষ বসবাস করে। ইরানের জনসংখ্যার জাতিগত বৈচিত্র্য, তার বয়স এবং গভীর শেকড়ের কারণে বেশিরভাগ বহু-জাতিগত দেশ যেমন কানাডা, আমেরিকা এবং কিছু ইউরোপীয় দেশ থেকে আলাদা। এই দেশগুলিতে, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সহাবস্থান হলো অভিবাসনের ফসল যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কয়েক শতাব্দী অতিক্রম করেনি। যদিও এই তথাকথিত সহাবস্থানের সংক্ষিপ্ত সময়ে সাংস্কৃতিক পার্থক্য ঘটেছে, যা এসব দেশকে সামাজিক সমস্যার দিকে নিয়ে গেছে।  এই সমস্যা ফ্রান্স এবং আমেরিকার মতো দেশগুলোর সমাজে কখনও কখনও রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্তেজনার আকারে নিজেকে প্রকাশ করে। কিন্তু ইরান সেই সীমিত কয়েকটি দেশের একটি যার নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলি এই ভূখণ্ডের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে একত্রে মিশেছে এবং তারা কোনো না কোনোভাবে এই ভূখণ্ডের আদিবাসী। ইরানের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, এই দেশে কখনো একটি জাতি অন্য জাতিগুলোর ওপর আধিপত্য বিস্তার করেনি এবং ইতিহাসের কোনো যুগেই কোনো অঞ্চলের ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন কোনো বিশেষ জাতি বা গোত্রের একচেটিয়া অধিকারে ছিল না। বরং এই ভূখণ্ডে সব ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তাকে সব সময় সম্মান করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, খ্রিস্টপূর্ব ৫২২ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৬ সাল পর্যন্ত ইরান শাসনকারী হাখামানেশিয়ান শাসক দারিউশের শাসনামলে ইরানী সাম্রাজ্যে প্রায় ৫০টি উপজাতি এবং কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০টি অঞ্চল বা স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য ছিল।  যদি হাখামানেশিয়ান শাসকেরা জাতি-বিরোধিতা এবং জাতিগত পরিচয় মুছে ফেলা এবং এক জাতিকে অন্য জাতির উপর চাপিয়ে দেওয়ার মানদণ্ড অনুসরণ করত তাহলে তারা কখনোই দুই শতাব্দীর বেশি সময় ধরে প্রাচীন বিশ্বের অর্ধেক শাসন করতে পারত না।

একবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন ইতিহাসবিদ বার্নার্ড লুইস তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তৃতায় ইরান সম্পর্কে বলেন, বিগত দুই হাজার বছরে কোনো বিদেশি শক্তি ইরানের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর মৌলিক প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। এটি উন্নত সংস্কৃতির অন্যতম লক্ষণ এবং উৎকৃষ্ট সংস্কৃতি সব সময় নিকৃষ্টের উপর প্রাধান্য পেয়েছে। ব্রিটেনে জন্মগ্রহণকারী এই ইহুদিবাদী ইতিহাসবিদ পরবর্তী জীবনে আরেক বক্তৃতায় বলেন, এ ধরনের সংস্কৃতি মোকাবিলা করার একমাত্র উপায় তাকে ধ্বংস করে ফেলা। তিনি ইসলামি বিপ্লবের শত্রু  বিশ্ব আধিপত্যকামীদের এই পরামর্শ দেন যে, ইরানে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর ভিত্তিতে দেশটিকে টুকরা টুকরা করে ফেলুন এবং নতুন নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দিন।

চলতি শতাব্দির গোড়ার দিকে যে ‘বৃহৎ মধ্যপ্রাচ্য’ পরিকল্পনার কথা জোরেসোরে শোনা যাচ্ছিল তার উদ্ভাবক ছিলেন এই বার্নার্ড লুইস। তিনি বিশ্বাস করতেন, মুসলিম দেশগুলো পাশ্চাত্যের জন্য প্রধান হুমকি। কাজেই এসব দেশকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলতে হবে যাতে একবারে এবং চিরতরে মুসলিম বিশ্বের শক্তি ধুলিস্যাত হয়ে যায়। আর তা করতে না পারলে ইসলাম একদিন পাশ্চাত্যকে ধ্বংস করে ফেলবে। তিনি তার এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আশায় শতাধিক বছর বেঁচে থাকেন এবং ২০১৮ সালে ১০২ বছর বয়সে সেই স্বপ্ন বুকে লালন করে ভবলীলা সাঙ্গ করেন।

তবে মুসলিম দেশগুলোকে বিশেষ করে ইসলামি ইরানকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করার স্বপ্ন লুইস একা দেখেননি। ফরাসি চিন্তাবিদ বার্নার্ড হেনরি লেভিও বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে ভেঙে টুকরো টুকরো করার পরিকল্পনা উত্থাপনের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছেন। ফরাসি-ইহুদিবাদী সাবেক এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা যেকোনো দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা দেখা দিলেই ওই দেশটিকে ভেঙে দেওয়ার পরিকল্পনা উত্থাপন করেন। বাংলাদেশ, সাবেক ইউগোস্লাভিয়া, আফগানিস্তান, সুদান ও লিবিয়া ছিল তার কর্মতৎপরতার স্থান এবং তার বুদ্ধি-পরামর্শে এসব দেশ হয় খণ্ড-বিখণ্ড হয়েছে অথবা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়েছে। ইরাকের কুর্দিস্তানকে স্বায়ত্বশাসন দিয়ে এক সময় ইরাক থেকে ওই অঞ্চলকে আলাদা করে ফেলারও অন্যতম পরিকল্পনাকারী এই হেনরি লেভি। তার অন্যতম বড় কাজ ছিল লিবিয়ার সাবেক শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ফ্রান্স সরকারকে রাজি করানো। লিবিয়া সংকটে ফ্রান্সের হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি করে তিনি মূলত ইহুদিবাদী ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করেন।

৭৪ বছর বয়সি এই ফরাসি চিন্তাবিদকে ইরানের গত বছরের দাঙ্গার সময়ও তৎপর হতে দেখা যায়। তিনি সে সময় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাকরনের সঙ্গে ইরানের ইসলামি সরকার বিরোধী কয়েকজন মহিলা নেতার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন। মজার ব্যাপার হলো, ম্যাকরনের দপ্তর ওই সাক্ষাতে হেনরি লেভির উপস্থিতির খবর ও ছবি প্রকাশ করতে দেয়নি।

শত্রু ভাবাপন্ন দেশগুলোর বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীকে উস্কে দেওয়া কিংবা এসব দেশকে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অন্যতম রীতি।  ইরানের সাম্প্রতিক দাঙ্গার সময় এই রীতি অনুসরণ করা হয়েছে। সে সময় ইরানের বিভিন্ন প্রদেশকে রাজধানী তেরহানের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার চেষ্টা করা হয়। ইরান সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলে এদেশকে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলার চেষ্টা মূলত শুরু হয় ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে।

ওই বিপ্লবের পর ইরানের যেসব রাজনৈতিক গোষ্ঠী তাদের দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের ওপর চাপিয়ে দিতে ব্যর্থ হয় তারা কুর্দিস্তান, আজারবাইজান, খুজিস্তান, তুর্কামান সাহরা এবং সিস্তান-বালুচিস্তান প্রদেশে দাঙ্গা বাধিয়ে এসব অঞ্চলকে ইরান থেকে আলাদা করে ফেলার চেষ্টা চালায়। কিন্তু উল্লেখিত অঞ্চলগুলোর জনগণই এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করে। ফলে সাময়িক কিছু দাঙ্গা বাধানো হলেও সে সময় তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থনপুষ্ট এসব জনসমর্থনহীন রাজনৈতিক গোষ্ঠী গত বছরের দাঙ্গার সময় আবার সক্রিয় হয়। তারা পশ্চিমা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে জনগণকে ব্যাপকভাবে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি খুজিস্তান, সিস্তান-বালুচিস্তান ও কুর্দিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা উস্কে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। তারা সামাজিক অস্থিরতাকে সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপ দেওয়ার জন্য ইরানের দক্ষিণ-পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের প্রতারিত কিছু যুবকের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। তিন মাসের সহিংসতার সময় পশ্চিমাদের মদদপুষ্ট এসব রাজনৈতিক গোষ্ঠী চোরাচালানের মাধ্যমে সীমান্ত দিয়ে ইরানের ভেতর ব্যাপক হারে অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রবেশ করায়।

ওই দাঙ্গার সময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন বিবিসি ফার্সিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইরানের রাজপথে আন্দোলনকারী বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এখন সশস্ত্র আন্দোলনে নামছে।  ডিভাইড এন্ড রুল বা বিচ্ছিন্ন করো এবং শাসন করো বলে ব্রিটিশদের যে বিখ্যাত উক্তি রয়েছে সে সম্পর্কে ইরানি জনগণও সম্যক অবহিত।  ইরানের ইসলামি সরকার উৎখাত করার জন্য সাম্প্রতিক দাঙ্গার সময় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার আওতায় যেসব অপতৎপরতা চালানো হয় তাতে ব্রিটিশদের ওই নীতি কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হয়। এবার ইরানি জাতিগুলোকে উস্কে দেওয়ার জন্য একজন কুর্দি নারীর কথিত নিহত হওয়ার ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে তুলে ধরা হয়।

কিন্তু ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের শত্রুরা একথা জানে না যে, বিশ্বের অন্যান্য দেশে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী হয়তো তাদের দেশকে খণ্ড-বিখণ্ড করার কাজে অংশ নিতেও পারে কিন্তু ইরানে বসবাসকারী বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর জনগণ উল্টো এদেশকে শক্তিশালী ও সুসংহত করতে তৎপর। এটি কোনো গালগল্প নয় বরং বাস্তবতা। অখণ্ড ইরান ভূখণ্ড আর দশটি দেশের মতো পিন দিয়ে জোড়াতালি লাগানো কোনো দেশ নয়। বরং বিগত কয়েক শতাব্দিতে ইরানের যেসব অংশকে পার্শ্ববতী বিভিন্ন দেশের সঙ্গে জোড়া লাগানো হয়েছে সেসব অংশের মানুষকে এখনও জিজ্ঞাসা করলে হয়তো জানা যাবে যে, তাদের অন্তর এখনও ইরানে পড়ে আছে।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, এখানেই শেষ করতে হচ্ছে ঘটনার নেপথ্যের আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গ দিলেন তাদের প্রত্যেককে অসংখ্য ধন্যবাদ।

 

ট্যাগ