নভেম্বর ৩০, ২০২৩ ১৬:২৭ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পাশ্চাত্যের পক্ষ থেকে শুরু করা ইসলামবিদ্বেষ ও ইরানবিদ্বেষ দিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে পশ্চিমা গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমগুলোর দ্বৈত আচরণ নিয়ে খানিকটা কথা বলার চেষ্টা করব। আশা করছি শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গ পাবো।

প্রখ্যাত মার্কিন দার্শনিক ও সমালোচক নোয়াম চমস্কি মানব জীবনের বিভিন্ন ব্যাপারে পাশ্চাত্যের দ্বৈত নীতির সমালোচনা করে বলেছেন: “আমেরিকার দৃষ্টিতে নিহত মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত। মূল্যবান ও মূল্যহীন। যারা আমেরিকার শত্রু  দেশগুলোতে বসবাস করে এবং সেসব দেশে নিহত হয় তারা ওয়াশিংটনের দৃষ্টিতে মূল্যবান মানুষ। আমেরিকার সমস্ত মনযোগ এদের প্রতি নিবদ্ধ।  অন্যদিকে মূল্যহীন নিহত মানুষ হচ্ছে তারা যারা আমেরিকা বা তার মিত্র দেশগুলোতে নিহত হয়। এদের নিয়ে ওয়াশিংটন মাথা ঘামায় না।”

নোয়াম চমস্কির এই বক্তব্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারলে একথা মোটেও বিস্ময়কর মনে হবে না যে, কেন মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে একজন নারী নিহত হলে তা নিয়ে আমেরিকা হৈ চৈ শুরু করে এবং একই সময়ে অন্য একটি দেশে নিহত কোনো আরেকজন নারীর ব্যাপারে তারা মাথা ঘামায় না। কেন ইরানে নিহত নারীর খবর সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দিতে মার্কিন গণমাধ্যমগুলো উঠেপড়ে লেগে যায় এবং পার্শ্ববর্তী দেশে নিহত নারী কেন তার নিজের দেশেই অজানা থেকে যায়।

আরবি নিউজ চ্যানেল আল-মায়াদিন গত শরতে বিভিন্ন খবরের ব্যাপারে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোর কাভারেজ সম্পর্কে এক প্রতিবেদনে লিখেছে: ইরানে পুলিশি হেফাজতে যখন মাহসা আমিনি নামের মেয়েটি মারা যায় ঠিক একই সময়ে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের আবু গোরাইব এলাকায় জয়নাব ইসাম নামক একটি মেয়ে মার্কিন সেনাদের গুলিতে শাহাদাতবরণ করে। ১৫ বছর বয়সি জয়নাব যখন তার বাবার কৃষিজমিতে অবস্থান করছিল তখন মার্কিন সেনারা তাকে গুলি করে হত্যা করে। অথচ মাহসা আমিনিকে নিয়ে আমেরিকা ও তার গণমাধ্যমগুলো এতটা হৈ চৈ শুরু করে যে, বিশ্বের খুব কম দেশ পাওয়া যাবে যেদেশের অধিবাসীরা মাহসার নাম শোনেনি।

কিন্তু ইরাকে মার্কিন সেনাদের গুলিতে নিহত জয়নাম ইসামের নাম সারাবিশ্বের মানুষ দূরে থাক ইরাকেরই বহু মানুষ জানে না। ইরাকের বহু কর্মকর্তা ও মানবাধিকার কর্মী মার্কিন সেনাদের গুলিতে জয়নাবের মর্মান্তিক মৃত্যুর তীব্র নিন্দা জানান এবং এ সংক্রান্ত হাশট্যাগ ‘আমেরিকা-জয়নাব’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।  কিন্তু তা সত্ত্বেও আরব ও পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোতে এ খবর প্রচারিত হয় নি কিংবা জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনে জয়নাম ইসামের নিহত হওয়ার  ঘটনাটি স্থান পায়নি।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংকট সৃষ্টি করে ফায়দা তোলার মার্কিন নীতি গত বছর থেকে ইউক্রেন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনের মাটিতে রাশিয়ার হামলা টক অব দ্যা ওয়ার্ল্ডে পরিণত হয়। ওই হামলার বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। প্রথম যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানায় সেগুলোর মধ্যে ছিল বিশ্ব ফুটবলের আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিফা ও ইউরোপীয় সংস্থা উয়েফা। ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই পর্বের খেলাগুলোতে রুশ টিমকে নিষিদ্ধ করে এবং উয়েফার লীগ খেলাগুলোতেও রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়। এই একই নীতি প্রয়োগ করে ভলিবল, টেনিস, তাইকোয়ান্ডো, জুডো ও রেসলিংসহ স্পোর্টসের সকল শাখায় রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়। এসব সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে অনেক আকর্ষণীয় মনে হলেও এতে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, পাশ্চাত্য খেলাধুলার মতো বিষয়গুলোকে রাজনীতিতে জড়াতে সিদ্ধহস্ত এবং নিজের স্বার্থে সে যা খুশি তাই করতে পারে।

বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষ যেকোনো যুদ্ধের বিরোধিতা করবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ, মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়া যুদ্ধ আর কিছু বয়ে আনে না। কিন্তু এই যুদ্ধ নামক বিষয়ের প্রতি যখন পাশ্চাত্য দ্বৈত প্রতিক্রিয়া জানায় তখনই এর কদার্য রূপটি বেরিয়ে আসে। উদাহরণস্বরূপ দশকের পর দশক ধরে ইহুদিবাদী ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধের শিকার ফিলিস্তিনি জাতির কথা উল্লেখ করা যায়। এখানে কিন্তু ইসরাইলকে আগ্রাসী বা যুদ্ধাপরাধী বলা হয় না। ইয়েমেনের ওপর সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের আট বছরের আগ্রাসনে সামরিক ও বেসামরিক মিলে তিন লাখ ৭৭ হাজার মানুষ নিহত হয়। কিন্তু এই আট বছরে ফিফা কিংবা অলিম্পিক কমিটিকে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এ ব্যাপারে আফগানিস্তান ও সিরিয়ার মতো আরো বহু দেশের নাম উল্লেখ করা যাবে।

একই বিষয়ের ব্যাপারে পাশ্চাত্যের এরকম দ্বৈত নীতির কারণেই কানাডার এক নাগরিক দেশটির ক্রীড়ামন্ত্রী মিসেস ওঙ্গের কাছে প্রশ্ন করেছিলেন: “আমরা ইউক্রেনে হামলা করার দায়ে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছি। কিন্তু ইরাকে আগ্রাসন চালানোর কারণে আমেরিকার ওপর কেন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি? দখলদার শক্তি হওয়ার কারণে ইসরাইল কেন নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়নি? আফগানিস্তান ও লিবিয়ায় বোমাবর্ষণ করার কারণে কানাডার বিরুদ্ধে কেন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি?” কানাডার ক্রীড়ামন্ত্রী এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

শুধু যে পশ্চিমা গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে দ্বৈত নীতি গ্রহণ করে তা নয় বরং সামাজিক মাধ্যমগুলির ক্ষেত্রেও একই নীতি প্রয়োগ করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক মাধ্যমগুলোর ব্যাপারে চীন ও রাশিয়ার গৃহিত পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে আমেরিকা। পাশ্চাত্যে নিয়ন্ত্রিত এসব মাধ্যমের বিষয়বস্তুর কারণে চীন ও রাশিয়ায় কখনও কখনও সামাজিক মাধ্যমগুলোর ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। কিন্তু আমেরিকা এতদিন যে কারণে চীন ও রাশিয়ার সমালোচনা করে আসছিল এখন সে নিজেই সেই একই কাজ করছে। চীন থেকে পরিচালিত টিক টকের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে মার্কিন সরকার।  আমেরিকায় ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে পড়া টিকটককে নিয়ন্ত্রণের জন্য এটির পরিচালককে পর্যন্ত মার্কিন কংগ্রেসে তলব করা হয়। এই ঘটনার সবচেয়ে সহজ যে ব্যাখ্যা আমেরিকা দাঁড় করিয়েছে তা হলো- টিকটক ব্যবহার করে চীন মার্কিন নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করছে।

মার্কিন সরকার চীনা সামাজিক মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিলেও নিজের সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার করে ইরানে নাশকতামূলক তৎপরতা চালিয়েছে। হোয়াটস আপ, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম ও টেলিগ্রামের মতো মাধ্যম ব্যবহার করে মার্কিন সরকার ইরানে দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে দিয়েছে। বলা হয়ে থাকে, এসব মাধ্যমের সাহায্যে মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থাগুলো যে কারো ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে এবং তার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে। কাজেই গত বছর ইরানে যে দাঙ্গা ছড়িয়ে দেওয়া হয় তার জন্য মাহসা আমিনি নামক মেয়েকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয় মাত্র। মাহসা মারা না গেলে অন্য কোনো অজুহাতে ওই দাঙ্গা বাধানো হতো।

তো শ্রোতাবন্ধুরা, এখানেই শেষ করতে হচ্ছে ঘটনার নেপথ্যের আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গ দিলেন তাদের প্রত্যেককে অসংখ্য ধন্যবাদ।

 

পার্সটুডে/এমএমআই/ বাবুল আখতার/ ৩০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ