ডিসেম্বর ০২, ২০২৩ ১৯:০৩ Asia/Dhaka
  • গানের পাখির বিশ্ব ভ্রমণের গল্প-২

প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আজকের আসরে আমরা দুই পাখি বন্ধুর গল্পটির পরিসমাপ্তি টানবো। আশা করি প্রথম পর্ব আপনাদের মনে আছে।

বন্ধুকে রেখে অচেনা জায়গায় একাকি গিয়ে বাজপাখি আর ঈগলের তীক্ষ্ণধার পাঞ্জা দেখে গানের পাখি কাঁপতে কাঁপতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। বাজপাখি ঈগলের আগে পৌঁছে গেল। গাছের চারদিকে বৃত্তাকারে কয়েকবার ঘুরে সোজা হামলা করলো কবুতরের দিকে। একই সময়ে ঈগলও হামলা চালালো। দুই শিকারী পাখির মধ্যে ব্যাপক ঝগড়া হলো এবং পরস্পরের তীক্ষ্ণ নখের আঘাতে উভয়েই আহত হলো।

গানের পাখি ভাবলো পালাবার এটাই উত্তম সময়। আল্লাহ সাহায্য চেয়ে সোজা নীচে উড়ে গিয়ে পাথরের পেছনে একটা গর্তে গিয়ে লুকালো। দুই দিন না খেয়ে খুব ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লো পাখি। বন্ধুর কথা মনে পড়লো তার। পরদিন সকালে ধীরে ধীরে গর্ত থেকে বের হয়ে খাবারের খোঁজে উড়াল দিলো। চোখে পড়লো মাটিতে মোটা একটা কবুতর বসে আছে। সে ভাবলো ওই কবুতরের পাশে নিশ্চয়ই কিছু খাবার ছিটানো আছে। নেমে গিয়ে সেই খাবারে মুখ দিতে গিয়েই বুঝতে পারলো শিকারের জালে আটকা পড়েছে সে। বেচারা গানের পাখি মোটা কবুতরকে বললো: প্রিয় ভাই! আমরা তো একই জাতি! আমি তোমাকে দেখে নেমে এসে তো ফাঁদে পড়ে গেলাম। এই শহরে আমি নতুন। যদি আমাকে আগেভাগে একটু সতর্ক করতে! 

বড় কবুতর জবাবে বললো: চারটি কারণে আমি কোনো কথা বলি নি। প্রথম কারণ হলো: শিকারী আমাকে খানা-পিনা দেয় এজন্য যে তোমার মতো বোকা পাখিদের জালে আটকিয়ে যেন শিকার করতে পারা যায়। দ্বিতীয় কারণটি হলো আল্লাহ তোমাকে দুটি চোখ দিয়েছে যাতে দেখে-শুনে বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ভালো-মন্দ বুঝতে পারো। তুমি যদি বিবেক খাটাতে তাহলে বুঝতে পারতে ফ্রি খাবার রাখার মানে কোনো একটা ফাঁদ আছে। তৃতীয়ত আমিও একা। ভাবলাম তুমি আটকা পড়লে একজন সঙ্গী হবে-মন্দ কী! চতুর্থ কারণ হলো তুমি এতো বেশি ক্ষুধার্ত ছিলে যে খাবার আগে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগও দাও নি, খেতে শুরু করেছো। এখন সে পর্যন্ত এখানে থাকো যতদিন না বোঝো-যে কোনো কাজের আগে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত।

গানের পাখির বলার মতো কোনো কিছুই ছিল না। অস্ফুটস্বরে বললো: উপদেশের জন্য ধন্যবাদ। এখন আমাকে কি এই জাল থেকে পালাবার পথটা বলে দেবে? এরপর থেকে তোমার উপদেশ মেনে চলবো। মোটা পাখি বললো: তুমি তো দেখছি খুব সহজ সরল। আমি যদি পালাবার পথ জানতামই তাহলে কি এখানে থাকতাম? তোমার আগেই পালাতাম। তোমার ভাগ্যে যা ছিল তাই ঘটেছে। গানের পাখি মনে মনে বললো: তবুও হতাশ হবো না! ভাগ্যের কোনো দোষ নেই। আল্লাহ যন্ত্রণা সৃষ্টি করলে তার ওষুধও দিয়েছেন। এই বলে তার ঠোঁট আর নখর দিয়ে জাল কাটতে শুরু করে দিলো। জালটা বেশ পুরোণো ছিল তাই দ্রুতই তা কেটে উড়াল দিয়ে চলে গেল গানের পাখি। 


উড়তে উড়তে ভাবছিল নিজের জন্মস্থানে ফিরে যাবে। ফেরার পথে কৃষিক্ষেতের পাশে একটা ভাঙা দেয়ালের ওপর অল্প সময়ের জন্য বসলো। প্রশান্তির হাই তুলে বললো: যাক, এখানে শিকারী পাখিদের যন্ত্রণা থেকে নিরাপদ আছি। ঘটনাক্রমে ওই দেয়ালের পাশ দিয়ে গ্রামের একটা ছেলে যাচ্ছিলো এবং সে তাকে দেখে ফেললো। সাথে সাথে ছেলেটা তার গুলতিতে একটা পাথর লাগিয়ে ছুঁড়ে মারলো পাখিকে লক্ষ্য করে। পালকে আঘাত করতেই পাখিটি দেয়ালের পাশের কূপে পড়ে গেল। গ্রামের ছেলেটি যেহেতু ওই কূপ থেকে পাখিটিকে তুলতে পারবে না বলে ভাবলো তার পথে সে চলে গেল। পাখির তো গর্তে বাস করার অভ্যাস ছিল। ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে সেই কূপে চব্বিশ ঘণ্টা পড়ে থাকলো আর বলতে লাগলো: এই শাস্তি আমার প্রাপ্য। কেননা আমি আমার বন্ধুর কথায় কান দেই নি।

পাখি আরও বললো: অচেনা জায়গার কোনোরকম খোঁজখবর না নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণে বের হয়েছি। যে-ই কোনো নতুন জায়গায় ভ্রমণ করতে যাবে তারই উচিত সেখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে ভালোভাবে খোজখবর নেওয়া। আমি সৌভাগ্যবান যে এতোসব জঞ্জাল পেরিয়ে জান নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছি। পরদিন গানের পাখি তার শারীরিক অবস্থা একটু ভালো বোধ করলো। কূপ থেকে বেরিয়ে জন্মস্থানের দিকে উড়াল দিলো। দুপুরের মধ্যেই সে পৌঁছে গেল তার ফেলে আসা নীড়ে। বন্ধু যন্ত্রশিল্পী তার বন্ধুর কণ্ঠ শুনে দ্রুত বেরিয়ে এলো বাসা থেকে। পরস্পরে কোলাকুলি করলো। তাদের আনন্দের সুর শুনে অন্যান্য পাখিরাও বেরিয়ে এসে সমবেত হলো এবং আনন্দের কোরাস তুললো সুরে সুরে। 

আপন গৃহে প্রত্যাবর্তনের আনন্দ উৎসব শেষ হবার পর যন্ত্রশিল্পী তার বন্ধুর কাছ থেকে বিশ্ব ভ্রমণের ব্যাপারে শুনতে চাইলো। অপর একটি পাখিও জানতে চাইলো: আচ্ছা, শুনেছি ভ্রমণ করা নাকি খুবই ভালো এবং উপকারী! সফরে গেলে অনেক অভিজ্ঞতা হয়, তাই না? বিশ্ব ভ্রামণিক গানের পাখি এবার জবাব দিলো: আমি ভেবেছিলাম অন্যদের জীবন মনে হয় আমাদের চেয়ে অনেক ভালো। কিন্তু আমি অনেক মূল্যবান কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। এখন আমি জানি এই পৃথিবীতে বাড়িঘরের কোনো অভাব নেই, গুণেও শেষ করা যাবে না এতো বেশি বাসাবাড়ি আছে।

গানের পাখি আরও বলতে লাগলো: সেইসব বাসাবাড়ি দেখার মতো সুন্দর এ কথা নি:সন্দেহে সত্য। কিন্তু তারচেয়ে বেশি মূল্যবান হলো চেনাজানা আপন পরিজন, স্বজাতি কিংবা বন্ধুবান্ধবদের দেখতে যাওয়া। আত্মীয় স্বজনদের দেখতে যাওয়ার গুরুত্ব অনেক বেশি মূল্যবান। গানের পাখি কবুতরটি ওই দুর্ঘটনাময় ভ্রমণের পর থেকে নিজের পূর্বপুরুষদের জন্মস্থানের মূল্য অনেক বেশি উপলব্ধি করলো। 
পার্সটুডে/এনএম/২/১১৭

মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ

ট্যাগ