অমর কিংবদন্তি ওমর খৈয়াম-(পর্ব-১)
মুসলিম বিশ্বের গর্ব, সেরা দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ ওমর খৈয়ামের জীবন ইতিহাস এবং জ্ঞানবিজ্ঞান ও সাহিত্য অঙ্গনে তার নানা কর্মকাণ্ড ও অবদান নিয়ে আমাদের সাপ্তাহিক আলোচনা 'অমর কিংবদন্তি ওমর খৈয়াম' অনুষ্ঠানে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আজ শুরু করবো কাজী নজরুল ইসলামের অনুবাদকৃত ওমর খৈয়ামের কবিতা রুবাইয়াত দিয়ে।
রাতের আঁচল দীর্ণ করে আসল শুভ ওই প্রভাত,
জাগো সাকি! সকাল বেলার খোয়ারি ভাঙো আমার সাথ।
ভোলো ভোলো বিষাদ-স্মৃতি! এমনি প্রভাত আসবে ঢের,
খুঁজতে মোদের এইখানে ফের, করবে করুণ নয়নপাত।
হাকিম ওমর খৈয়াম নিশাপুরি ছিলেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি ইরানি ও ইসলামি জ্ঞান, প্রজ্ঞা, চিন্তা ও সাহিত্যকে তুলে ধরেছিলেন। আজ শুনুন নতুন এ ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব।
"গিয়াস উদ্দিন আবু আল-ফাতহ উমর ইবনে ইব্রাহিম নিশাপুরি" যিনি "হাকিম ওমর খৈয়াম নিশাপুরি" নামে পরিচিতি তিনি ছিলেন জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, গণিত এবং সাহিত্য অঙ্গনে খ্যাতনামা ইরানি মনীষীদের একজন। তিনি বিশ্বের চিন্তাবিদ ও গবেষকদের কাছে খুবই পরিচিত এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার বহু বই অনূদিত হয়েছে। চতুষ্পদী কবিতা বা রুবাইয়াত লেখার কারণে আজ সাহিত্য অঙ্গনে তিনি ইরানসহ সারা বিশ্বে খ্যাতির চূড়ায় রয়েছেন অথচ সে যুগের মানুষ এ সম্পর্কে কিছুই জানতো না। বিশ্বদৃষ্টি ও সাহিত্যে খৈয়ামের খ্যাতি এত বেশি যে খৈয়ামের কবিতাকে কেন্দ্র করে ইউরোপ ও আমেরিকায় অনেক সাহিত্য সমিতি গড়ে উঠেছে। খৈয়াম এমন একজন ব্যক্তি যিনি দর্শন, গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যায় অনেক সাফল্য অর্জন করেন। এই মহান মনীষীর সম্মানে চাঁদের একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি এবং সৌরজগতের একটি গ্রহের নাম রাখা হয়েছে 'খৈয়াম'। আজকের বিজ্ঞানীদের বিপরীতে গিয়ে তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা ছিল। এ কারণে, তাকে "সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী" মনীষী হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
'অমর কিংবদন্তি ওমর খৈয়াম' শীর্ষক এ অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে আজ আমরা ওমর খৈয়ামের জন্মস্থান নিশাপুর শহরের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং এই শহরের নানা উত্থান-পতনের ঘটনার সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেব।
হাকিম ওমর খৈয়াম ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ফিরোজা পাথরের জন্য বিখ্যাত অঞ্চল নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বলা যায়, তার কারণেই ইরানের এই প্রাচীন শহরের নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিনালুদ পর্বতমালার দক্ষিণ পাদদেশে ঐতিহাসিক নিশাপুর শহরটি অবস্থিত। এটি বর্তমানে ইরানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও পর্যটন এলাকা হিসাবে পরিচিত। নিশাপুর শহরটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় নগরী মাশহাদ শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। নিশাপুরের উত্তরে রয়েছে কোচান ও চেনারান শহর, দক্ষিণে কাশমের এবং পশ্চিমে ফিরোজা শহর। প্রাকৃতিকভাবে নিশাপুর দুটি পার্বত্য ও সমতলভূমি এলাকা নিয়ে গঠিত। 'বিনালুদ' পর্বতশ্রেণীটি উত্তর দিকে এবং দক্ষিণ দিকের 'কুহসোরখ' উচ্চভূমির একটি অংশের মধ্যে পড়েছে নিশাপুর। তবে, এই শহরের বেশিরভাগ এলাকা সমতলভূমি।
যেহেতু বিনালুদ পাহাড় থেকে প্রবাহিত পানি এবং পলিমাটি সর্বদা সমতল ভূমির দিকে প্রবাহিত হয়েছে, তাই এ অঞ্চলটি সুদূর অতীত থেকে আজ অবধি মানুষের বসবাসের উপযুক্ত স্থান হিসেবে টিকে আছে। বিনালুদ পর্বতে জমে থাকা তুষার ও বরফ গলা পানি এই অঞ্চলের জন্য একটি সমৃদ্ধ ভূগর্ভস্থ পানির উৎস তৈরি করেছে, যেখান থেকে সারা বছর মানুষের পানির চাহিদা পূরণ হয়। এছাড়াও, বিনালুদ পাহাড় এবং কুহসোরোখ পার্বত্য এলাকা থেকে বয়ে আসা পানির সাথে পলিমাটি সমতল ভূমিতে এসে পড়ায় তা কৃষিকাজের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এসব কারণে নিশাপুর এলাকাটি অতীত থেকেই গুরুত্বপূর্ণ কৃষি ও পশুচারণ ভূমি হিসাবে পরিচিত। এসবের পাশাপাশি, নিশাপুরের মধ্যে ঐতিহাসিক রেশম পথ বা 'সিল্ক রোড'-এর অবস্থানের কারণে তা এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। এ কারণে সমগ্র ইরানের ইতিহাস, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে নিশাপুরের নাম জড়িয়ে আছে।
নিশাপুর শহরের ইতিহাস অনেক প্রাচীন এবং প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুসন্ধানে পাওয়া নিদর্শন থেকে বোঝা যায় প্রাচীন এই শহরের সভ্যতা ও ইতিহাস খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এই এলাকার অন্তত সাত হাজার বছরের পুরানো সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। এই শহর সম্পর্কে জানার জন্য প্রাচীনতম উত্সগুলোর মধ্যে একটি হল 'আবেস্তা' বই। 'আবেস্তা' হল প্রাচীনতম ইরানি জরথুষ্ট্রীয় সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ। এই গ্রন্থে, নিশাপুরকে 'রাবন্ত' হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে যার অর্থ গৌরবের ধারক। সাসানীয় সাম্রাজ্যের রাজাদের রেখে যাওয়া মুদ্রায় নিশাপুরকে 'আবারশহর' বা 'ম্যাগাসিটি' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা থেকে ওই যুগে এই অঞ্চলের সমৃদ্ধির বিষয়টি ফুটে ওঠে। 'আবারশহর' হচ্ছে, নিশাপুরের পুরানো নাম যা বৃহত্তর খোরাসানের একটি অঙ্গরাজ্য হিসাবে কিংবা কখনও কখনও নিশাপুর অঞ্চল বা শহর হিসাবে পরিচিত ছিল। কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, অন্য এলাকা বা শহরের তুলনায় নিশাপুর শহরের মর্যাদা ও অবস্থান এতো উপরে ছিল যে, একে নিশাপুরের 'ম্যাগাসিটি' নামে অভিহিত করা হতো।
'অমর কিংবদন্তি ওমর খৈয়াম' শীর্ষক ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে আমরা নিশাপুর অঞ্চলের উত্থান-পতনের ইতিহাসের দিকে নজর দেব এবং অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এই শহরের গুরুত্বের বিষয়টি তুলে ধরবো।
এ উদ্দেশ্যে, প্রথমে আমরা ২২৪ থেকে ৬৫১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সাসানি শাসনের যুগে ফিরে যাই। সাসানিয়ান শাসক শাপুর প্রাচীন নিশাপুরের বিস্তৃতি ঘটিয়েছিলেন এবং তিনি ছিলেন বর্তমান নিশাপুর শহরের প্রতিষ্ঠাতা। যদিও এই শহরের ইতিহাস সাসানিয়ানদেরও বহু শতাব্দী আগের। সাসানিয় সাম্রাজ্যের শাসকরা ধারাবাহিকভাবে প্রথম শাপুর, দ্বিতীয় শাপুর নামে পরিচিত। তারাই নিশাপুরকে সব দিক দিয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধ একটি শহরে পরিণত করেছিলেন। সাসানিয় রাজারা এই শহরটিকে এমনভাবে শক্তিশালী করে গড়ে তুলেছিলেন যাতে বাইরের শত্রুদের আক্রমণ ঠেকাতে দুর্গ হিসাবে কাজ করে। শাপুরের শাসন পরবর্তী সময়েও মঙ্গোলসহ বিদেশি শত্রুর আক্রমণের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল নিশাপুর শহর। অতীত থেকেই আত্মরক্ষার দুর্গ হিসাবে নিশাপুরের বিরাট ভূমিকা থাকলেও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক দিক থেকেও এই এলাকার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই শহর ছিল সাসানিয় সাম্রাজ্যের পূর্ব-পশ্চিম প্রান্তে যোগাযোগের মাধ্যম।
ইসলামি যুগে বৃহত্তর খোরাসানের চারটি প্রধান অংশ অর্থাৎ মার্ভ, হেরাত ও বলখের পাশাপাশি নিশাপুর ছিল অন্যতম। এমনকি তাহেরিয়ান রাজবংশের সময়কালে, যারা ৮২১ থেকে ৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেছিল, তখন এই শহরটি খোরাসানের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। তাহেরিয়ানরা ইরান ও ভারতের অনেক অংশ শাসন করতো। ইসলাম আগমনের পর তাহেরিয়ানরাই ছিলেন প্রথম ইরানি রাজবংশ যারা খোরাসানে ক্ষমতা লাভ করে। পরবর্তীতে, ইয়াকুব ইবনে আল-লাইস আল-সাফারি ২৫৯ হিজরি অর্থাৎ ৮৭২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ ইবনে তাহিরকে পরাজিত করে নিশাপুর দখল করেন। তারপর, তার ভাই আমরু বিন লাইস নিশাপুর শাসন করেন। তিনি, এই শহরের ঐতিহ্যে মুগ্ধ হয়ে শহরটিকে আরো সমৃদ্ধ করার পদক্ষেপ নেন। #
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।