রংধনু আসর
নিজের কাজ নিজে করার গুরুত্ব
রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছ তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। রংধনুর আজকের আসরে তোমাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমি গাজী আবদুর রশিদ এবং আমি আকতার জাহান।
বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানে যে, পরিশ্রম তথা কাজ ছাড়া জীবনে কেউ সফল হতে পারে না। আর তাইতো ইসলাম ধর্মে কাজের ওপর বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কেবল পড়াশোনা করলেই চলবে না, নিজের অন্য যেসব কাজ আছে সেগুলোও সাধ্যানুযায়ী করতে হবে। প্রাত্যহিক কাজকর্মও সওয়াব ও পুণ্যের। এতে করে আধ্যাত্মিক কল্যাণ লাভের সুযোগ রয়েছে। সব ধরনের কায়িক বা শারীরিক শ্রমের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যাবে বলেও বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর। ’ (সুরা জুমা, আয়াত: ১০)
আমাদের প্রিয় নবী (সা.) এবং নবী বংশের মহান ইমামগণ নিজেদের কাজ নিজেরাই করে গেছেন। রাসূলেখোদা বলেছেন, 'নিজের কাজে কখনো অপরের সাহায্য নেয়া উচিত নয়। আর কারো ভরসা করাও ঠিক নয়।'
ইসলাম ধর্ম সংসারের ভরণপোষণের জন্য হালাল উপায়ে উপার্জনকে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের সঙ্গে তুলনা করেছে এবং শ্রমিককে 'আল্লাহর পথের মুজাহিদ' বলে উল্লেখ করেছে। এ সম্পর্কে ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেছেন : "যে ব্যক্তি পরিবারের ভরণ পোষণের জন্য আল্লাহর কাছে রিযিক কামনা করে, তাকে জিহাদের চেয়েও বড় পুরস্কার দেয়া হয়।" এ ছাড়া, যে ব্যক্তি হালাল রুজি উপার্জনরত অবস্থায় মারা যায়, তার পুরস্কার শহীদের সমান।
বন্ধুরা, রংধনু আসরে আজকের আসরে আমরা সম্পর্কে কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনা শোনাব। আরব সবশেষে থাকবে একটি ইসলামি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান।
একবার এক সফরে বের হয়ে গন্তব্যে পৌঁছার পর রাসূলে (সা.) ও তাঁর সাহাবীরা নিজ নিজ বাহন থেকে নেমে পড়লেন। নিজেদের মালপত্র নামিয়ে রাখলেন নির্ধারিত স্থানে। তারপর সকলে মিলে ঠিক করলেন যে, একটি দুম্বা জবাই করে খাবার তৈরি করা হবে।
একজন সাহাবী বললেন, দুম্বা জবাই করার দায়িত্ব আমার। আরেকজন বললেন, দুম্বার চামড়া ছাড়ানো ও গোশত কাটার দায়িত্ব আমি নিলাম। তৃতীয়জন বললেন, গোশত রান্না করার দায়িত্ব আমার।
এভাবে সাহাবীরা নিজ নিজ দায়িত্ব ভাগ করে নিলেন। এসময় রাসূল (সা.) বললেন, "কাঠ কুড়িয়ে আনার দায়িত্ব আমার।"
রাসূলের কথা শুনে এক সাহাবী বলে উঠলেন, 'হে আল্লাহর রাসূল ! আমরা উপস্থিত থাকতে আপনি কষ্ট করবেন কেন? আপনি বিশ্রাম নিন। আমরা আনন্দের সাথে সমস্ত কাজ ঠিকঠাকমত সেরে নেব।
সাহাবীদের কথা শুনে রাসূলেখোদা বললেন, "আমি জানি এ কাজ তোমরা করে নিতে পারবে। কিন্তু মহান আল্লাহ সে বান্দাকে কখনোই ভালোবাসেন না, যে বন্ধুদের মাঝে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ও উত্তম মনে করে।"
এ কথা বলে তিনি বনের দিকে চলে গেলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে জ্বালানি কাঠ ও খড়-কুটো নিয়ে ফিরে এলেন।
আরেকদিনের ঘটনা। রাসূল (সা.) এর কাফেলাটি অনেকক্ষণ যাবত পথ চলার কারণে সবার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ দেখা যাচ্ছিল। বহনকারী পশুগুলোও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। এসময় কাফেলাটি এমন একটি স্থানে পৌঁছল যেখানে কিছু পানি ছিল। কাফেলা থেমে গেলে রাসূলেখোদা উটের পিঠ থেকে নিচে নেমে এলেন। এরপর সবাইকে নিয়ে তিনি পানির দিকে পা বাড়ালেন ওজু করার জন্য। কিন্তু কয়েক ধাপ চলার পর কাউকে কিছু না বলে আবার নিজের উটের দিকে ফিরে এলেন।
রাসুলুল্লাহর সাহাবী ও সাথীরা আশ্চর্য হয়ে পরস্পর বলাবলি করতে লাগলেন যে, মনে হয় যাত্রাবিরতির জন্য এ স্থানটি নবীজীর পছন্দ হয়নি। এখনই হয়তো তিনি রওনা হবার নির্দেশ দেবেন।
কাফেলার সবাই যখন রাসূলের নতুন নির্দেশ শোনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন তখন দেখা গেল, মহানবী উটের কোমর বাঁধার রশি হাতে নিলেন এবং উটের কোমর বাধতে শুরু করলেন। তাড়াতাড়ি বাঁধার কাজ শেষ করে তিনি আবার পানির দিকে গেলেন ওজু করতে।
এ সময় চারদিক থেকে সাহাবীরা এসে বললেন, “হে আল্লাহ রাসূল! আপনি এ কাজের জন্য আমাদেরকে কেন হুকুম দিলেন না? আপনি কেন কাজটি করতে গেলেন? আমরা তো গর্বের সাথে এ কাজটি করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম।”
নবীজী তাদের প্রশ্নের জবাবে বললেন, "নিজের কাজে কখনো অপরের সাহায্য নেয়া উচিত নয়। কার কারো ভরসা করাও ঠিক নয়। সে কাজ যত ছোট কিংবা যত বড়ই হোক না কেন।"
রাসূলের এমন জবাব শুনে সাহাবীরা বিস্মিত হয়ে গেলেন।
বন্ধুরা, এবার আমরা রাসূলেখোদার বংশধর বা আহলে বাইতের ইমামদের জীবন থেকে নেয়া দুটি ঘটনা শোনাব। আহলে বাইতের ৮ম ব্যক্তিত্ব- ইমাম জাফর সাদেক (আ.) একদিন শ্রমিকের পোশাক পড়ে হাতে বেলচা নিয়ে জমিতে কাজ করছিলেন। অনেকক্ষণ ধরে কাজ করার কারণে তাঁর সারা শরীর ঘামে ভিজে চপচপ করছিল।
এমন সময় আবু আমর শাইবানী নামের এক ব্যক্তি সেখানে এসে উপস্থিত হলো। সে দেখতে পেল, ইমামের দেহ থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে। সে ভাবল, হয়তো শ্রমিক না পাওয়ায় ইমাম নিজেই নিজের ক্ষেতের কাজ করছেন।
লোকটি ইমামের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, “হে ইমাম, আপনি তো ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। আপনার বেলচাটা আমাকে দিন। বাকী কাজটুকু আমিই করব।”
জবাবে ইমাম বললেন, “না না, তা কী করে হয়! আসলে আমার দৃষ্টিভঙ্গী হচ্ছে, মানুষ রোজগারের জন্য নিজে পরিশ্রম করুক এবং রুটি-রুজি অর্জনের জন্য রোদের প্রখরতা সহ্য করুক।”
বন্ধুরা, ইমাম জাফর সাদেকের পর এবার আমার তাঁর পুত্র ইমাম মুসা কাযেম (আ.)-এর একটি ঘটনা শোনাচ্ছি।
ইমাম মুসা কাযেম (আ.) একদিন প্রচণ্ড রোদের মধ্যে নিজের জমিতে কাজ করছিলেন। এমন সময় আলী ইবনে আবী হামযা নামক এক ব্যক্তি ইমামের কাছে এসে বলল, “হে ইমাম! আপনার জন্য আমার জীবন উৎসর্গিত হোক। আপনি এ কাজটি অন্য লোককে দিয়ে করাচ্ছেন না কেন?”
ইমাম বললেন, “আমি আমার কাজ অন্যকে দিয়ে করাবো কেন? তোমার জানা উচিত, আমার চেয়ে উত্তম লোকেরাও এ ধরনের কাজ নিজেরাই করেছেন।”
লোকটি বলল, আপনি কাদের কথা বলছেন?
ইমাম মুসা কাযেম বললেন, “হযরত রাসূলে আকরাম (সা.), আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (আ.) এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের সবাই এ জাতীয় কাজকর্ম নিজেরাই করে গেছেন। মূলত ক্ষেত-খামারে কাজ করা আল্লাহর নবী-রাসূল, তাঁদের প্রতিনিধি ও উত্তরসূরীদের সুন্নত।”
বন্ধুরা, এবার আমরা যার কথা বব তিনি একসময় অনেক কষ্ট-ক্লেশের মধ্য দিয়ে তার দিনগুলো কাটিয়েছেন। দিনগুলো তার এমন মন্দ কেটেছে যে, সারাদিন চেষ্টা করেও তিনি তার স্ত্রী ও নিষ্পাপ শিশুদের পেট ভরে খাবার যোগাড় করতে পারতেন না। মনে মনে তিনি একটি কথা চিন্তা-ভাবনা করতেন। যে কথাটি তার মনের মধ্যে জাগরণ এনে দিয়েছিল সে একটি মাত্র কথাই তার অন্তরে এক অসাধারণ শক্তি যুগিয়েছিল। সে কথাটিই তার জীবনে এনে দিয়েছিল এক বিপ্লব। বদলে দিয়েছিল তার দুর্দিনকে সুদিনে। কাল যে পরিবারটি সীমাহীন অভাব-অনটন আর সহায়-সম্বলহীন থাকার কারণে লজ্জা ও লাঞ্ছনার জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছিল, সে পরিবারটিই আজ একটি মাত্র কথার বরকতে সুখ স্বাছন্দের জীবন যাপন করতে লাগল।
বন্ধুরা, আমরা যার কথা বলছি, তিনি আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর একজন সাহাবী। অভাব-অনটন আর দুঃখ-কষ্টে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলেন। একদিন তিনি স্ত্রীর পরামর্শে রাসূলের খেদমতে হাজির হলেন। কিন্তু তিনি তার সাহায্য চাওয়ার আগেই রাসূলের মুখ থেকে একটি কথা শুনতে পেলেন।
"যে ব্যক্তি আমার নিকট সাহায্য চাইবে আমি তাকে সাহায্য করব। কিন্তু যদি কোনো লোক আল্লাহর সৃষ্টি কোনো মানুষের কাছে হাত পাতা থেকে বিরত থাকে তাহলে আল্লাহ তার অভাব মোচন করে দেবেন।"
এ কথা শুনে তিনি রাসূলের কাছে আর কিছু চাইতে পারলেন না এবং বাড়িতে ফিরে এলেন। ঘরে এসে দেখলেন যে, আগের মতোই দারিদ্র্য ও অভাবের পরিবেশ ছেয়ে আছে। বাধ্য হয়ে দ্বিতীয় দিন আবার সে সংকল্প নিয়েই রাসূলের খেদমতে উপস্থিত হলেন। এ দিনও তিনি রাসূলের মুখে একই কথা শুনতে পেলেন।
এবারও তিনি তার মনের কথা না বলে বাড়ি ফিরে এলেন। কিন্তু ঘরের মধ্যে অভাব-অভিযোগ ও দারিদ্র্য লেগেই আছে। সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট ও অসহায় অবস্থা তাকে আবারও রাসূলের কাছে যেতে বাধ্য করল। এবারও তিনি রাসূলের কাছ থেকে একই কথা শুনতে পেলেন।
কিন্তু এবার রাসূল (সা.)-এর মুখ থেকে আগের কথাটি শোনার পর সাহাবী তার অন্তরে পরম প্রশান্তিবোধ করলেন। তিনি উপলব্ধি করতে লাগলেন যেন এই একটি মাত্র কথাই তার জীবনের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট দূর করার চাবিকাঠি। এবারে তিনি যখন রাসূলের (সা.) দরবার থেকে উঠে যেতে লাগলেন তখন তার মনের মধ্যে অসীম প্রশান্তি অনুভব করছিলেন। তার অন্তরে অত্যন্ত শান্তিও স্বস্তি নিয়ে তিনি নিজের বাড়ির দিকে এগিয়ে চললেন।
সাহাবী মনে মনে ভাবতে লাগলেন, আমার দ্বারা কোনো কাজ করা কি সম্ভব? তার মনে হলো, আপাততঃ তিনি জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে এনে বাজারে বিক্রি করতে পারবেন।
এ কথা ভেবে-চিন্তে তিনি তার প্রতিবেশীর কাছ থেকে একটা কুঠার ধার নিলেন এবং জঙ্গলে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরিশ্রম করে তিনি অনেক লাকড়ি জমা করলেন আর তা এনে বাজারে বিক্রি করলেন।
এভাবে তিনি দেখতে পেলেন তার পরিশ্রমের ফল খুবই ভালো। তাই তিনি তার এ কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। ধীরে ধীরে তিনি তার আয় দ্বারা একটি কুঠার কিনলেন। এরপর আরো কিছু দিনের আয় জমা করে কয়েকটি পশু ও ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনলেন। কিন্তু তিনি বনে গিয়ে কাঠ কেটে আনা ও বিক্রি করা চালিয়ে যেতে থাকলেন। এভাবে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি একজন ধনী ব্যবসায়ী হয়ে গেলেন।
এরপর একদিন রাসূলে আকরাম (সা.) তাঁর কাছে গেলেন তিনি। রাসূলেখোদা তাকে দেখে মুচকি হাসলেন। বললেন, ‘কি- আমি বলিনি?- "যে ব্যক্তি আমার নিকট সাহায্য চাইবে আমি তাকে সাহায্য করব। কিন্তু যদি কোন লোক অপরের সামনে হাত পাতা থেকে বেঁচে থাকে তাহলে মহান আল্লাহ তাকে অপরের মুখাপেক্ষী হওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখেন।"
বন্ধুরা, নিজের কাজ নিজে করা এবং পরিশ্রমের গুরুত্ব সম্পর্কে কয়েকটি সত্য ঘটনা শুনলে। আশা করি তোমরা সবাই নিজের কাজ নিজে করবে- কেমন?
বন্ধুরা, অনুষ্ঠানের এ পর্যায়ে রয়েছে শিশুদের প্রতি নবীজির ভালোবাসা সম্পর্কে একটি গান। গানের কথা লিখেছেন গাজী আব্দুল হামিদ, সূর করেছে শফিউল ইসলাম ফারুক আর গেয়েছে শিশুশিল্পী হুমায়রা আফরিন ইরা, হুজায়ফা, নুসাইবা, রাইসা ও লুবাবা।
তো বন্ধুরা, তোমরা গানটি শুনতে থাকো আর আমরা বিদায় নিই রংধনুর আজকের আসর থেকে। #
পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২৪