জানুয়ারি ২১, ২০২৪ ১৫:৪৬ Asia/Dhaka
  • সূরা তালাক: ৮-১২ (পর্ব-২)

আপনাদের হয়তো মনে আছে গত আসরে আমরা সূরা তালাকের ৭ নম্বর পর্যন্ত আয়াত নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই সূরার বাকি অংশ অর্থাৎ ৮ থেকে ১২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির উপস্থাপন করব। প্রথমেই এই সূরার ৮ থেকে ১০ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

وَكَأَيِّنْ مِنْ قَرْيَةٍ عَتَتْ عَنْ أَمْرِ رَبِّهَا وَرُسُلِهِ فَحَاسَبْنَاهَا حِسَابًا شَدِيدًا وَعَذَّبْنَاهَا عَذَابًا نُكْرًا (8) فَذَاقَتْ وَبَالَ أَمْرِهَا وَكَانَ عَاقِبَةُ أَمْرِهَا خُسْرًا (9) أَعَدَّ اللَّهُ لَهُمْ عَذَابًا شَدِيدًا فَاتَّقُوا اللَّهَ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ الَّذِينَ آَمَنُوا قَدْ أَنْزَلَ اللَّهُ إِلَيْكُمْ ذِكْرًا (10)

“এবং কত জনপদ [ও তার অধিবাসীরা] দম্ভভরে তাদের প্রতিপালকের ও তাঁর রাসূলদের নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল, ফলে আমি তাদের থেকে কঠিনভাবে প্রতিশোধ নিয়েছি এবং অজানা আজাব দিয়ে তাদেরকে দিয়েছি শাস্তি।” (৬৫:৮)

“ফলে তারা তাদের কৃতকর্মের খারাপ প্রতিফল আস্বাদন করল; আর ক্ষতিই ছিল তাদের কাজের পরিণাম।” (৬৫:৯)

“আল্লাহ তাদের জন্য কঠোর শাস্তি প্ৰস্তুত রেখেছেন। অতএব হে বোধসম্পন্ন মুমিন ব্যক্তিগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চলো, অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের প্রতি নাযিল করেছেন এক উপদেশ।” (৬৫:১০)

এই সূরার প্রথম সাত আয়াতে তালাক সম্পর্কিত পারিবারিক কিছু হুকুম আহকাম বর্ণিত হয়েছে। এরপর এই তিন আয়াতে মহান আল্লাহ মুসলমানদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলছেন, যদি তোমরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে আল্লাহর নির্দেশ মেনে না চলো তাহলে পূর্ববর্তী জাতিগুলোর মতো কঠিন পরিণতির শিকার হবে।

আল্লাহ তায়ালার নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করলে দুনিয়া ও আখিরাতে মানুষকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হয়। এই শাস্তি আসে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ন্যায়বিচার ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশের ওপর ভিত্তি করে। এর ফলে একদিকে কারো প্রতি জুলুম বা অবিচার করা হয় না এবং অন্যদিকে সৎকর্মশীল ও গুনাহগার ব্যক্তিদের পার্থক্য উপলব্ধি করা যায়।

পরের আয়াতে বলা হচ্ছে: তোমরা পূর্ববর্তী জাতিগুলোর কর্মফল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো এবং জেনে রেখো, যারা আল্লাহর অবাধ্যতা করেছে দুনিয়া ও আখিরাতে তারা ক্ষতি ছাড়া অন্য কিছু পায়নি। তোমরা কখনও এটা ভাববে না যে, তারা চালাক-চতুর ও বুদ্ধিমান ছিল, ফলে পার্থিব জীবনে কোনো ক্ষতির শিকার হয়নি। কিন্তু যখন তোমরা মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে বিবেচনায় নেবে তখন বুঝবে মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষের জীবন শেষ হয়ে যায় না বরং মৃত্যু পরবর্তী সেই চিরস্থায়ী জীবনে মানুষের ভাগ্যে কী পরিণতি অপেক্ষা করছে সেটিই আসল বিষয়।

কেউ কেউ মনে করেন, পার্থিব জীবনে কারো শাস্তি হয়ে গেলে সে পরকালীন শাস্তি থেকে মুক্তি লাভ করে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আল্লাহর অবাধ্যতার ধরন অনুযায়ী মানুষ পার্থিব জীবন কিংবা পারলৌকিক জীবনে শাস্তি পেয়ে থাকে। যেসব ঈমানদার ব্যক্তি জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান তারা ভালোভাবে জানেন যে, দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে আল্লাহর শাস্তি থেকে বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় আল্লাহকে ভয় করে চলা এবং তার অবাধ্যতা থেকে দূরে থাকা।

এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত পুরুষদের বিরুদ্ধাচরণ ও অবাধ্যতা পার্থিব জীবনে ধ্বংস এবং পরকালীন জীবনে কঠিন শাস্তি বয়ে আনে।

২- আল্লাহর অবাধ্যতা ও খোদাদ্রোহিতার মাধ্যমে সাময়িক সাফল্য ও ইন্দ্রিয়সুখ উপভোগ করতে পারলে আমরা যেন গর্ব করে না বেড়াই। আমাদের শেষ পরিণতি কী হয় সেটিই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

৩- ঈমান ও বুদ্ধিমত্তা পরস্পর থেকে আলাদা কোনো বিষয় নয়।  বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগালে মানুষ ঈমানে পৌঁছাতে পারে এবং তার মধ্যে খোদাভীতি ও তাকওয়া সৃষ্টি হয়।

৪- মানুষের মুক্তির দুটি মূল উপায় বুদ্ধিমত্তা এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী-রাসূলদের কাছে আসা ওহী। এই দু’টি একত্রে মিলে মানুষকে পাপকাজ থেকে বিরত রাখে এবং তাকে সতর্ক করে দেয়। আর সেই সতর্কতা অবলম্বন করলে মানুষ চিরকালীন সৌভাগ্য লাভ করতে পারে।  (তাওয়াশিহ)

এবারে সূরা তালাকের ১১ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

رَسُولًا يَتْلُو عَلَيْكُمْ آَيَاتِ اللَّهِ مُبَيِّنَاتٍ لِيُخْرِجَ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللَّهِ وَيَعْمَلْ صَالِحًا يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا قَدْ أَحْسَنَ اللَّهُ لَهُ رِزْقًا (11)

“যে রাসূল তোমাদের কাছে আল্লাহ্‌র সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করে [সেটা] এজন্য যে, যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করে তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে আনতে পারে।  আর যে কেউ আল্লাহর উপর ঈমান আনবে এবং সৎকাজ করবে তিনি তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার [গাছের] পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে; আল্লাহ তার জন্য অতি উত্তম রিজিকের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।”  (৬৫:১১)

পবিত্র কুরআন নাজিলের পাশাপাশি মহান আল্লাহ এমন একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন যিনি সুস্পষ্ট আয়াতের ভিত্তিতে মানুষকে পাপের পথ থেকে সৎকর্মের দিকে আহ্বান করেন। যারা এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঈমানের সঙ্গে সৎকাজ করবে তারা দুনিয়া ও আখিরাতে সৌভাগ্যশালী হবে। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে, বিশ্বাসে যেকোনো ধরনের শিরক, কুফর ও নিফাক এবং কর্মে যেকোনো ধরনের গোনাহ, অসৎকর্ম ও অশ্ললতা মানুষের জন্য জুলুমাত বা অন্ধকার হিসেবে বিবেচিত হয়। কাজেই যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ এসেছেন মানুষকে বিশ্বাস ও কর্মে তৌহিদ বা একত্ববাদে পৌঁছে দিতে এবং সৎকর্মশীল বান্দায় পরিণত করতে। নবী-রাসূলগণের আহ্বানে সাড়া দিলে মানুষ অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে আলোর দিশা পাবে এবং সফলকাম হবে।  

যদিও পাপকাজ, অনৈতিকতা ও অশ্লীলকর্মে তাৎক্ষণিক আনন্দ ও ইন্দ্রীয়সুখ রয়েছে কিন্তু নিঃসন্দেহে এই আনন্দ ক্ষণস্থায়ী। পক্ষান্তরে যেসব ঈমানদার মানুষ সৎকর্মশীল তারা চিরস্থায়ী সুখ ও আনন্দ উপভোগ করতে পারবে। তারা এমন আনন্দময় জীবনে প্রবেশ করবে যার কথা এই ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনে কল্পনা করাও দুরুহ। শুধুমাত্র পারলৌকিক জান্নাতেই সেসব সুখ ভোগ করা সম্ভব। সেই জান্নাতে মহান আল্লাহ সৎকর্মশীলদের জন্য শ্রেষ্ঠতম নিয়ামত ও জীবনোপকরণ প্রস্তুত করে রেখেছেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- মানুষকে সঠিক পথের দিশা দেওয়ার জন্য শুধুমাত্র আসমানি কিতাব যথেষ্ট নয় বরং একজন নবীরও প্রয়োজন যিনি মানুষকে ওই কিতাবের শিক্ষা হাতে কলমে দেখিয়ে দিতে পারেন এবং কিতাবের শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য একজন অনুকরণীয় আদর্শ হতে পারেন।

২- ভ্রান্ত বিশ্বাসের সংখ্যা অনেক। তাই এখানে জুলুমাত বা অন্ধকার শব্দটি বহুবচনে এসেছে। অন্যদিকে সঠিক পথের সংখ্যা একটির বেশি নয়। সে কারণে এখানে নূর বা আলো শব্দটি একবচনে ব্যবহার করেছেন আল্লাহ তায়ালা।

৩- পৃথিবীতে নবী-রাসূল পাঠানোর উদ্দেশ্য মানুষকে তার নিজের সৃষ্ট অন্ধকার থেকে মুক্তি দিয়ে আল্লাহপ্রদত্ত সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে পরিচালিত করা।

এবারে এই সূরার ১২ নম্বর আয়াতের তেলাওয়াত ও তর্জমা শোনা যাক:

اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَمِنَ الْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ يَتَنَزَّلُ الْأَمْرُ بَيْنَهُنَّ لِتَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ وَأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَاطَ بِكُلِّ شَيْءٍ عِلْمًا (12)

 

“আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন সপ্ত আকাশ এবং পৃথিবীও অনুরূপ, সর্বদা ওগুলোর মধ্যে নেমে আসে তাঁর নির্দেশ, যাতে তোমরা বুঝতে পার যে, অবশ্যই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান এবং আল্লাহর জ্ঞান সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে।”  (৬৫:১২)

সূরা তালাকের এই শেষ আয়াতে বিশ্বজগতের বিশালতা এবং তা সৃষ্টি ও পরিচালনায় আল্লাহ তায়ালার অসীম ক্ষমতার প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে: মহান আল্লাহ সাত আসমান ও সাত জমিন বা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এখানে সাত বলতে হয়তো আকাশের অসংখ্য তারকারাজি কিংবা পৃথিবীর মতো মহাকাশে ভেসে থাকা অসংখ্য গ্রহের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।  অথবা হতে পারে বিশ্বজগতের এমন কোনো অজানা বিষয়ের প্রতি এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে যা আজও মানবজাতির অজানা রয়ে গেছে। হয়তো প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে ভবিষ্যতে কোনোদিন মানুষ সেকথা জানতে পারবে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, শুধুমাত্র সৃষ্টি করে ছেড়ে দিলেই তো হবে না বরং এই বিশাল জগত পরিচালনাও করতে হবে। সর্বাধুনিক টেলিস্কোপ আবিস্কৃত হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত মহাকাশের শুরু ও শেষ কোথায় তা আজও মানুষ জানতে পারেনি। আর এ থেকে মহান আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতার মাহাত্ম উপলব্ধি করা যায়।

এই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:

১- আমরা যে আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি তিনি একইসঙ্গে সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। তিনিই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং পরিচালনার দায়িত্বও তিনি নিজ হাতে রেখে দিয়েছেন। ঠিক এ কারণে পবিত্র কুরআনে আল্লাহর যত নাম এসেছে তার মধ্যে খালিক ও রব বা সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা শব্দ দুটি বেশি এসেছে।

২- মহান আল্লাহ ও তার ক্ষমতার বিশালতা উপলব্ধি করার জন্য বিশ্বজগত হচ্ছে শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। তবে দুঃখজনকভাবে যারা মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করেন তারা সৃষ্ট বস্তু নিয়েই ব্যস্ত আছেন এগুলোর সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

৩- বিশ্বজগতের সকল সৃষ্ট বস্তুর ওপর মহান আল্লাহর পরিপূর্ণ, সূক্ষ্ম ও ত্রুটিহীন জ্ঞান ও ক্ষমতা রয়েছে।

তো শ্রোতাবন্ধুরা! এরইসঙ্গে শেষ করছি কুরআনের আলোর আজকের আয়োজন। যারা সঙ্গে দিলেন তাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।#

পার্সটুডে/এমএমআই/এমবিএ/২১

ট্যাগ