ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২৪ ১৫:৪৩ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনায় আমরা বলেছিলাম যে ওমর খৈয়াম শিশু ও কৈশরকালে বিভিন্ন মক্তবখানা বা তৎকালীন যুগের প্রচলিত বিদ্যাশিক্ষা কেন্দ্র থেকে নিশাপুরের বিশিষ্ট শিক্ষকদের কাছ থেকে বিজ্ঞান, সাহিত্য ও দর্শন শিখেছিলেন। তিনি সে সময় ইমাম মোয়াফ্ফাক নিশাপুরী, শেখ মোহাম্মদ মানসুরী প্রমুখ শিক্ষকদের কাছে এসব বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন।

প্রকৃতপক্ষে, খৈয়াম বয়সে যত বড় হয়েছে, তত বেশি অধ্যয়ন করেছেন এবং যত বেশি অনুসন্ধান করেছেন, তত কম তিনি খুঁজে পেয়েছেন। তিনি কোনো একটি বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলে আরো অন্তত দশটি প্রশ্ন উত্থাপন করতেন। কিন্তু নিশাপুরের এই সীমিত পরিসরে তাঁর বহু জটিল প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়তো এবং তার জ্ঞানের তৃষ্ণা মিটতো না। তাই আরো পড়াশোনা ও গবেষণার জন্য তিনি সমরখন্দে যান।

'সমরখন্দ' যাকে প্রাচীন গ্রীকরা "মারাকান্দা" বলত, তা ছিল বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলোর মধ্যে একটি। এই শহরটিকে প্রথমে ইরানিরা খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দীর শেষদিকে জারাফশানের উর্বর সমভূমিতে একটি কৃষি শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। প্রাচীন পারস্যের হাখামানেশিয়দের যুগ এই অঞ্চলের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। ঐতিহাসিক সিল্করোডের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হওয়ায়, এই শহরটিকে প্রাচীনকালে চীন ও ইউরোপের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে বিবেচনা করা হতো যে কারণে ভৌগোলিক দিক দিয়ে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছিল। ওমর খৈয়ামের জীবদ্দশায় সমরখন্দ ছিল ইরান ও সেলজুকিয়ানদের ভূখণ্ডের একটি অংশ এবং এটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ শহর ছিল। বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হতো সমরখন্দ। বর্তমানে এই শহরটি সমরখন্দ প্রদেশের কেন্দ্র এবং উজবেকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হিসাবে পরিচিত।

উচ্চতর পড়ালেখার উদ্দেশ্যে হাকিম ওমর খৈয়াম সমরখন্দে গিয়ে বীজগণিতের উপর তাঁর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তিনি সমরখন্দের বিচারক আবু তাহের আব্দুর রহমান বিন আহমদের সহযোগিতায় সমরখন্দে এই গ্রন্থটি রচনা সম্পন্ন করেন। এই গ্রন্থের বিষয় ছিল বীজগণিতের ক্ষেত্রে দ্বিঘাত সমীকরণ যা সেই সময় বিজ্ঞান ও জ্ঞানের জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলে বিবেচিত হত। আমরা এই গ্রন্থ সম্পর্কে আলাদাভাবে কথা বলব। তবে, এরই মধ্যে সমরখন্দের শাসক 'শামস-উল-মুলক নাসর বিন ইব্রাহিম' ওমর খৈয়ামের জ্ঞান ও প্রতিভার প্রতি আকৃষ্ট হন। হিজরি পঞ্চম শতাব্দী মোতাবেক ১১শ' খ্রিস্টাব্দে ইরানি ঐতিহাসিক আবুল হাসান বায়হাকী এ সম্পর্কে লিখেছেন, 'সমরখন্দের শাসক বড় মাপের ব্যক্তি হিসাবে ওমর খৈয়ামকে খুব সম্মান করতেন। এমনকি দরবারে তিনি তার পাশে খৈয়ামকে বসাতেন।'

কথিত আছে যে যখন ওমর খৈয়ামের বয়স ছিল প্রায় বিশ বছর যখন তিনি সমরখন্দ সফর করেন।জ্ঞানার্জনের জন্য ওমর খৈয়ামের সফর শুধু সমরখন্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি বহু অঞ্চল সফর করেছেন বলে ইতিহাসে জানা যায়। এর মধ্যে একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, একদিন একজন পণ্ডিত ব্যক্তি বালখ থেকে সমরখন্দে আসেন। ওই ব্যক্তি অভিজ্ঞতাসঞ্চয় ও জ্ঞানার্জনের জন্য বিশ্ব ভ্রমণ করতেন। তিনি এক মজলিসে বলেন, বালখ শহরে আরও অনেক শিক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। তিনি আরো বলেন, বিখ্যাত গ্রীক গণিতবিদ 'অ্যাপোলোনিয়াস' এর জ্যামিতি বিষয়ক লেখা 'কোনস বা শঙ্কু' বইয়ের একটি কপিও বালখ শহরের একজন বিখ্যাত ব্যক্তির কাছে সংরক্ষিত আছে।  খৈয়াম ওই পরিব্রাজকের এসব কথাবার্তা শোনার পর তিনি সেই বইটি দেখার জন্য বালখ শহরে যান এবং জানা যায় ওই ব্যক্তি বইটির কপি করার অনুমতি দিয়েছিলেন।

আজকের বালখ শহর

ওমর খৈয়াম একাই বালখের উদ্দেশ্যে তার যাত্রা শুরু করেন, তাকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তাকে সমরখন্দ থেকে বালখ পর্যন্ত যেতে বহু মাইল পাড়ি দিতে হয়েছিল, যা আজ উত্তর আফগানিস্তানে অবস্থিত। তিনি তার যাত্রাপথে বিচিত্র ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন যা তার বালখ ভ্রমণ বাহিনীতে বর্ণিত হয়েছে। ‌এসব গল্পের একটিতে বলা হয়েছে যে, খৈয়াম পথিমধ্যে একটি গ্রামে এক কাফেলার  সাক্ষাত পান। তাদের সাথেই রাত কাটিয়ে ক্লান্তি দূর করেন এবং সঙ্গে কিছু খাবার দাবার রাখারও ব্যবস্থা করেন। এই গ্রামটি তার কাছে খুব অদ্ভুত মনে হয়েছিল এবং প্রচুর সংখ্যক পাখি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। দেয়ালের ওপরে, গাছে, মাঠে সর্বত্র সব ধরনের পাখি দেখা যেত এবং এই পাখিদের মলমূত্রে সব জায়গা সাদা হয়ে গিয়েছিল। খৈয়াম যখন কাফেলার মধ্যে প্রবেশ করলেন, তখন একজন লোক তাঁর কাছে এসে সালাম দিয়ে বললেন, জনাব আপনার চেহারা থেকে জ্ঞান ও ঈমানের আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে, ‌আপনি আমাদেরকে বলবেন কি এতো বিপুল সংখ্যক পাখির হয়রানি থেকে আমরা কিভাবে রেহাই পেতে পারি? দয়া করে আপনি যদি কোনো সমাধান খুঁজে পান তাহলে বলুন।

খৈয়াম বললেন, কেন তোমরা পাখিদেরকে শিকার করো না যাতে তারা ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়? লোকটি বলল, আমরাও এই চেষ্টা করেছি, তারা অল্প সময়ের জন্য উড়াল দিয়ে চলে যায় কিন্তু আবার ফিরে আসে। খৈয়াম লোকটির অসহায়ত্ব দেখে কিছুক্ষণ ভাবলেন এবং তারপর বললেন, আমি এই সমস্যা সমাধানের একটি সমাধান খুঁজে পেয়েছি, আমি আশা করি তা আপনাদের কাজে লাগবে। আপনি আমাকে সাহায্য করার জন্য কাউকে পাঠান এবং এর জন্য আমার কিছু সরঞ্জাম দরকার। লোকটি বললো, আমি এবং এই কাফেলার সবাই আপনার কথা মতো কাজ করতে প্রস্তুত রয়েছি। খৈয়াম কিছু সাদা মাটি, অন্য মুরগির কিছু বড়-ছোট পালক এবং লম্বা চার টুকরো শুকনো কাঠ নিয়ে আসতে বললেন। খৈয়ামের নির্দেশ মতো এই সরঞ্জামগুলো দিয়ে তারা দুটি বড় পাখির ভাস্কর্য তৈরি করেছিল এবং প্রস্তুত করা মুরগির পালক দিয়ে মাটির তৈরি পাখির দেহ ঢেকে দেয়। এরপর কাঠের টুকরায় পাখির ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। একটি পাখির মূর্তি গ্রামের প্রবেশদ্বারে প্রাচীরের উঁচুতে স্থাপন করা হয় এবং অন্যটি প্রাচীরের অন্য প্রান্তে স্থাপন করা হয়।

পরের দিন থেকে দেখা গেল পাখিরা দল বেঁধে চলে যায় এবং পাখিদের যন্ত্রণা থেকে সেই এলাকার মানুষ মুক্তি পায়। বাসিন্দারা ধন্যবাদ জানাতে খৈয়ামের কাছে আসেন এবং সবাই তার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করেন। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ