ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৪ ২১:১৯ Asia/Dhaka

নারীর প্রতি যৌন শোষণ সেই প্রাচীন যুগ থেকে মানবজাতির এক বড় সংকট। অতীতকালে অনেকে দাসীদেরকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যভিচারে লিপ্ত হতে বাধ্য করত এবং এভাবে তাদেরকে ব্যবহার করে অর্থ আয় করত।

দুঃখজনক ব্যাপার হল এ সংকট আধুনিক যুগেও অব্যাহত রয়েছে। পবিত্র কুরআনে সুরা নুরের ৩৩ নম্বর আয়াতের একাংশে বলা হয়েছে:তোমাদের দাসীরা নিজেদের পবিত্রতা রক্ষা করতে চাইলে তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদের লালসায় তাদেরকে ব্যভিচারে বাধ্য কারো না। যদি কেহ তাদের উপর জোর-জবরদস্তি করে, তবে তাদের উপর জোর-জবরদস্তির পর আল্লাহ তাদের প্রতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

১৯৯০'র দশকের শুরুর দিকে নারীর প্রতি যৌন শোষণের উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাপী মানব পাচার জোরদার হয়ে ওঠে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে অনেক নতুন দেশ জন্ম নেয়। বর্তমানে ইউরোপের সব দেশে, আমেরিকা মহাদেশে ও জাপানে নারীদের পণ্যের মত তথা পতিতা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। জার্মানিতে দশ হাজার নারী নানা ক্লাবে কাজ করছে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। এই নারীদের আনা হয়েছে চেক প্রজাতন্ত্র, পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়া থেকে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও ১৫ বছরের চেয়েও কম বয়সী অন্তত দশ লাখ শিশু পতিতাবৃত্তির মাধ্যমে জীবন নির্বাহ করছে। ইউরোপীয় কমিশনের তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর ৫ লাখ নারী ও শিশুকে পশ্চিম ইউরোপে পাচার করা হচ্ছে। 

মানব পাচারকারীরা যৌন শোষণের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর নারীদের বেশি টার্গেট করে থাকে তাদের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে। এদের বেশিরভাগেরই বয় ১৪ থেকে ২৫ বছর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর এক লাখেরও বেশি কন্যা শিশুকে যৌন দাসত্বের কারণে কেনা-বেচা করা হয়। এরা প্রাপ্ত বয়স্ক নয় তথা এদের বয়স ১৮ বছরেরও কম এবং অনেক ক্ষেত্রে মাত্র ১৩ বছর। ইউরোপে যৌন দাসীদের বিক্রি করা হয় একটি সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি বা একটি স্মার্ট ফোনের চেয়েও কম দামে! পাচার হয়ে যাওয়া নারীদেরকে মূলত পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে তথা ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের মত দেশগুলোতে পাঠানো হয়। নানা গবেষণা সংস্থা ও সামাজিক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী শিশুদেরকে যৌন শোষণে ব্যবহার করে আয় করা হয় ২০০ কোটি ডলার।

একবিংশ শতকেও বিশ্বে দাস প্রথা টিকে আছে- এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন হলেও বাস্তব সত্য হচ্ছে যে বিশ্বের ইতিহাসের অন্য যে কোনো যুগের তুলনায় বর্তমানে প্রায় চার কোটি মানুষকে দাস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এদের মধ্যে যারা নারী তাদেরকে পতিতা হিসেবে ও শিশুদেরকে কৃষিকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। দেনাগ্রস্ত অনেক পরিবারের সদস্য তাদের পূর্বপুরুষদের দেনা শোধের জন্যও বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। পাচার হয়ে যাওয়া অনেক শিশু বাল্য বিবাহেরও শিকার হচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানবিক সেবা মন্ত্রণালয় মানব কেনা-বেচাকে আধুনিক দাসপ্রথা হিসেবে উল্লেখ করে থাকে। যে কোনো নারী, পুরুষ ও শিশু যৌন শোষণ অথবা বলপূর্বক শ্রম আদায়ের লক্ষ্যে মানব পাচারকারীদের শিকার হতে পারে বলে এই মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার মতই এখানেও রয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য বিপুল মুনাফার প্রলোভন।ইউরোপীয় কমিশনের তৃতীয় সহস্রাব্দের দাস-দাসী শীর্ষক রিপোর্ট অনুযায়ী ইউরোপে নারীদের যৌন শোষণের ব্যবসায় কাজে লাগিয়ে প্রতি বছর আয় করা হয় এক হাজার তিনশ কোটি ডলার। হেরোইন নামক মাদক পাচারের আয় থেকেও এই আয়ের পরিমাণ বেশি। অবশ্য বিভিন্ন ধরনের মাদক ব্যবসা থেকে যা আয় করা হয় তার মোট পরিমাণ নারীদের দিয়ে দেহ ব্যবসা করানোর আয়ের চেয়েও অনেক বেশি। দেহ-ব্যবসা অবৈধ লাভের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যবসা। পশ্চিমা সভ্যতার লোকেরা অর্থের জন্য এমন কোনো অন্যায় কাজ নেই যা করতে পারে না এবং এ জন্য তাদের বিবেকে বিন্দুমাত্রও বেদনার অনুভূতি জাগে না।

অতীতের তুলনায় মানব-পাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম বেশ জোরালো হওয়া সত্ত্বেও এখনও এসবে জড়িত মাফিয়া চক্রগুলোর বিপুল বিস্তৃত নেটওয়ার্কগুলোকে ধরাশায়ী করা বেশ কষ্টসাধ্য কাজ বলে মনে করা হয়।  দুঃখজনক ব্যাপার হল কোনো সরকারি সংস্থাই আধুনিক যুগের দাস দাসীদের সুরক্ষা বা সমর্থন যোগাচ্ছে না। ইউরোপে যৌন দাসী হিসেবে পাচার হয়ে আসা নারীরা যদি দালালদের খপ্পর থেকে মুক্ত হতে চায় তাহলে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে তাদেরকে আটক রাখা হবে ভিন্ন ধরনের আরেক   কারাগার বা আটককেন্দ্রগুলোতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যারা পাচারকারী তারা শাস্তি পাচ্ছে না বরং যারা পাচারের শিকার হয়েছেন তারাই নানা ধরনের শাস্তির শিকার হচ্ছে। যেমন, তাদের শাস্তি দেয়া হচ্ছে পতিতাবৃত্তিতে জড়িত হওয়ার দায়ে অথবা অবৈধভাবে প্রবেশ কিংবা আইডি কার্ড না থাকার কারণে। সাধারণত মানব পাচারকারীরা এই দুর্যোগের শিকার ব্যক্তিদের কাছ থেকে আগেই আইডি কার্ড  বা পরিচয়পত্রগুলো জোর করে কেড়ে নিয়ে থাকে।

 ইউরোপে যৌন শোষণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত মানব পাচারের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো প্রতিরোধ বা প্রতিরোধের ইচ্ছা সরকারগুলোর মধ্যে দেখা যায় না। এ জন্য তাদের বাজেট বরাদ্দ খুব কম এবং এ সব কাজের শাস্তিও ইউরোপে তেমন কঠিন কিছু নয়। পূর্ব ইউরোপের অনেক নেতৃবৃন্দও এইসব পাচারের সঙ্গে জড়িত। নারী পাচারকারীরা ইউরোপীয় পুলিশের হাতে কখনও কখনও ধরা পড়লে দেখা যায় যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশ তাদের শাস্তি দেয়নি বরং পুলিশও যৌন শোষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে!  এভাবে পুলিশ রক্ষকের পরিবর্তে ভক্ষক হয়ে ওঠে এবং এমনকি ইউরোপের চিকিৎসক শ্রেণী ও আইনজীবী শ্রেণীও হয়ে পড়েন ভক্ষক!

ইউরোপ ও আমেরিকায় শত শত বছর ধরে দাস প্রথা প্রচলিত ছিল। তাদের পায়ে অতীতের মত ডাণ্ডাবেরি পরানো হয়তো হয় না। রোমানিয়ার নারী আন্না ১৬ বছর বয়সে ব্রিটেনে এসেছিল দারিদ্রের হাত হতে মুক্তি পেতে। কিন্তু তখন থেকেই তাকে ব্রিটেনের হোটেলগুলোয় দেহ-ব্যবসায় লিপ্ত হতে বাধ্য করা হয়েছিল। এ পথে সে যা আয় করত তার প্রায় সবটুকুই আবার নিয়ে যেত তার মালিক পক্ষ। তাদের বক্তব্য তুমি আমাদের দাসী মাত্র। তাই তোমার আয় করা অর্থ আমাদেরই সম্পদ। আমি মার খাওয়ার ভয়ে ও জীবন হারানোর ভয়ে তাদের কথার খেলাপ কিছু করার সাহস পেতাম না।পাশ্চাত্যসহ বিশ্বের দেশগুলোতে বর্তমানে নব্য দাস প্রথার শিকার কম পক্ষে চার কোটি নারী ও শিশু।  ব্রিটেনের সরকারি হিসেব অনুযায়ী দেশটিতে বর্তমান যৌন দাসদাসীসহ মোট দাসের সংখ্যা কম পক্ষে এক লাখ ব্যক্তি। #

পার্সটুডে/এমএএইচ/১০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ