অক্টোবর ০৪, ২০১৬ ১২:৩৪ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনায় আমরা তুর্কি সাহিত্যের ওপর ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাব সম্পর্কে কথা বলেছি। আমরা বলেছিলাম তুর্কি ভাষায় সর্বপ্রথম যিনি কবিতা লিখেছেন তিনি হলেন মৌলানা রুমির পুত্র বাহাউদ্দিন।  তিনি  ফার্সি ভাষায় একটি কাব্য লিখেছিলেন যার নাম ছিল 'রুবানামে'।

মসনভী বা দ্বিপদী ছন্দে রচিত এই কাব্যে তিনি ১৫৬টি তুর্কি বয়াতও যুক্ত করেন। আর এভাবেই তুর্কি কাব্য সাহিত্যের গোড়াপত্তন ঘটে। তুর্কি সাহিত্যের ওপর খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতক থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত ইরানি কবি জামি ও আমির আলীশির নাওয়ায়ির গভীর প্রভাব দেখা গেছে। ইরানি কবি ইস্ফাহানি ও শওকতও তুর্কি কবিতার ওপর বেশ প্রভাব রেখেছেন।

তুর্কি ভাষায় প্রথমবারের মত যারা কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন তারা ফার্সিও জানতেন এবং ফার্সি ভাষায়ও কবিতা লিখতেন। এদেরকে কবি ইমাদউদ্দিন নাসিমির সঙ্গে তুলনা করা যায় যিনি আরবি ও ফার্সিতে কবিতা লিখলেও তার মূল কাব্যটি লিখেছেন তুর্কি ভাষায়। 

ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য, বিশেষ করে ফার্সি কবিতা ও ফার্সি ভাষা এশিয়া মাইনর এবং বলকান অঞ্চলেও প্রচলিত ছিল। এ অঞ্চল ছিল অটোম্যান তুর্কি সাম্রাজ্যের শাসনাধীন। হাফিজের কাব্য তথা দিওয়ানে হাফেজের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যাকারী হিসেবে যারা খ্যাতি অর্জন করেছেন বসনিয়ার মুহাম্মাদ সুদি তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। বসনিয়ার এই পণ্ডিত  আরবি ও ফার্সি ভাষায় খুবই দক্ষ ছিলেন। তিনি ওসমানীয় সুলতানদের দরবারে নিয়োজিত কর্মীদের শিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন।

পূর্ব তুর্কিস্তানের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকারী চাগতাই মোঙ্গোল বা মোঘলরাও ফার্সি ভাষা জানত। এমনকি চাগতাই মোঘল শাহজাদা হায়দার মির্জা ‘মধ্যএশিয়ার মোঙ্গলদের ইতিহাস’ নামে ফার্সি ভাষায় একটি বইও লিখেছেন।

মুসলিম স্পেন তথা আন্দালুসিয়ার টলেডো অঞ্চলেও ফার্সি ভাষার ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ছিল। ইবনে সিনা, ফারাবি ও হামজা ইস্ফাহানিসহ আরও অনেক ইরানি পন্ডিত ও বিজ্ঞানীদের বই খুব চড়া দামে এখানে বিক্রি হত।  এইসব বই হাতে লেখা হত। টলেডোর বিশাল লাইব্রেরিতে ফার্সি ভাষায় লেখা কয়েক হাজার বই ছিল।   

নানা তথ্য-প্রমাণে দেখা যায় চীনে প্রথমবারের মত যারা ইসলাম প্রচার করেছিলেন তারা ছিলেন ইরানি। বিশিষ্ট ফরাসি অধ্যাপক শেফার মনে করেন চীনের বেশিরভাগ মুসলমানই ইরানি বংশদ্ভুত। তারা মোঙ্গল শাসনামলেরও আগে ও মোঙ্গল শাসনামলে এ অঞ্চলে বসতি প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখনও চীনা মুসলমানরা ধর্মীয় ফরজ দায়িত্ব পালন বা ইবাদত বন্দেগির ক্ষেত্রে অনেক ফার্সি শব্দ ব্যবহার করেন।

নানা নিদর্শন ও স্পষ্ট দলিল-প্রমাণ থেকে দেখা যায় ফার্সি ভাষা হিজরি ষষ্ঠ শতক থেকে একটি আন্তর্জাতিক ভাষায় পরিণত হয়েছিল। এই ভাষাটির ব্যাপক শব্দ-ভাণ্ডার, অর্থ ও ভাবের ব্যাপক পরিধি এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে সহজবোধ্যতার কারণে তা মুসলিম বিশ্বে যোগাযোগ, সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও প্রশাসনিক ভাষার মাধ্যম হয়ে পড়ে।  আর এই শতক থেকেই দীর্ঘকাল পর্যন্ত সভ্য বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলেই ফার্সি ভাষার বক্তা, শ্রোতা, লেখক ও পাঠক ছিল বিপুল সংখ্যক। ল্যাটিন ভাষা যেমন মধ্যযুগে খ্রিস্টিয় বিশ্বে ও ইউরোপের নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা ও প্রভাব রেখেছিল তেমনি ফার্সি ভাষাও মুসলিম বিশ্বে একই ধরনের ভূমিকা ও প্রভাব রেখেছে।  

ফার্সি ভাষা বিশ্বের বহু অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় ও দরবারি ভাষার মর্যাদা পেয়েছিল। এ ছাড়াও ফার্সি ভাষা হয়ে পড়ে বেশিরভাগ মুসলিম জাতিগুলোর কাছে আরবির পরই দ্বিতীয় প্রধান ধর্মীয় ও পবিত্র ভাষা। ইসলামী সাহিত্য ও সংস্কৃতির দ্বিতীয় প্রধান মাধ্যম বা বাহক হিসেবে ফার্সি ভাষার সেই অবস্থান আজও অম্লান। অবশ্য ইংরেজ ও ফরাসি উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করার পর ফার্সি ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা থেকে ক্রমেই হটিয়ে দিতে থাকে।

ধর্মীয় ও রাষ্ট্র ভাষা হওয়ার সুবাদে স্থানীয় ভাষাগুলোতেও ফার্সি ভাষার ব্যাপক প্রভাব দেখা যায়। বাংলাসহ ভারত উপমহাদেশের স্থানীয় ভাষাগুলোতে ফার্সি শব্দ ব্যাপক পরিমাণে মিশে গিয়েছিল। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও পুঁথি-সাহিত্যই এর বড় প্রমাণ। কিন্তু মধ্যযুগের পর ইংরেজ উপনিবেশবাদী সরকার ও তাদের স্থানীয় দোসরদের চক্রান্তে বাংলা ভাষা থেকে আরবি-ফার্সি শব্দকে জোর করে নির্বাসন দেয়া হতে থাকে। আরবি, ফার্সি ও তুর্কি শব্দের পরিবর্তে বাংলা ভাষায় জোর করে  অপ্রচলিত ও দুর্বোধ্য সংস্কৃত শব্দ  ঢোকানোর চেষ্টা করে এই মহল।কিন্তু তারপরও বাংলা ভাষা থেকে আরবি-ফার্সি শব্দ ও  ফার্সি ভাষার প্রভাব ব্যাপক মাত্রায় কমানো সম্ভব হয়নি।

পাক-ভারত উপমহাদেশেল মানুষের মুখের ভাষায় ফার্সি শব্দের ব্যবহার এখনও ব্যাপক।  বাংলা ভাষা থেকে আরবি-ফার্সি শব্দ জোর করে হটানোর নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আজও বাংলা ভাষার প্রায় ১৫ থেকে বিশ শতাংশ শব্দ ফার্সি। আরবি-ফার্সিবহুল ভাষা ব্যবহার করে জনপ্রিয় হয়েছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও ফররুখ আহমদের মত শক্তিশালী কবি।

অন্যদিকে অফিস-আদালতের ভাষা থেকে ফার্সিকে হটিয়ে দেয়া হলেও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফার্সি ভাষার চর্চা আজও অব্যাহত রয়েছে। ভারত উপমহাদেশের পশতু, সিন্ধি, পাঞ্জাবি, বেলুচ ও উর্দু ভাষার মধ্যে ফার্সির ব্যাপক প্রভাব ও উপস্থিতিও লক্ষ্যনীয়।  উর্দু ভাষাকে ফার্সি ভাষারই  ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলা যায়। ফার্সি শব্দের ব্যবহার উর্দুকে করেছে সমৃদ্ধ। অনুরূপভাবে কুর্দি, তুর্কি, মালয়ী এবং মধ্য এশিয়ার ভাষাগুলোতেও ফার্সি সাহিত্য, ফার্সি শব্দ ও ফার্সি ভাষার ব্যাপক প্রভাব দেখা যায়।#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আশরাফুর রহমান/৪