ইরানের আলবোর্জ প্রদেশ
আলবোর্জ প্রদেশের আয়তন পাঁচ হাজার আট শ তেত্রিশ বর্গকিলোমিটার। অতি সম্প্রতি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংসদ মজলিশে শুরায় আলবোর্জকে প্রদেশের মর্যাদায় উন্নীত করা হয়েছে।
সংসদে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে আলবোর্জের প্রতিনিধি নিয়োগ করার মধ্য দিয়ে প্রদেশটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কারাজ শহর হচ্ছে আলবোর্জ প্রদেশের কেন্দ্র। মোট ছয়টি উপশহর আছে আলবোর্জ প্রদেশে। এগুলো হচ্ছে কারাজ, ত্বলেগন, সভজাবালগ, এশতেহারদ, ফারদিস এবং নাজারাবাদ। আলবোর্জ প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহর কারাজ তেহরান শহর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। রাজধানী শহর থেকে এতো কম দূরত্বে আর কোনো প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহরের অবস্থান নেই।
আলবোর্জ প্রদেশের উত্তরে রয়েছে মজান্দারন প্রদেশ, দক্ষিণে কেন্দ্রীয় প্রদেশ, পশ্চিমে কাজভিন প্রদেশ আর পূর্বদিকে রয়েছে তেহরান প্রদেশ। কারাজ একটা সমতল ভূমিময় এলাকা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই প্রদেশের উচ্চতা এক হাজার তিন শ বিশ মিটার। উত্তর প্রান্তের আলবোর্জ পর্বতমালার মাধ্যমে প্রদেশটি মজান্দারন থেকে পৃথক হয়ে গেছে। আলবোর্জের কেন্দ্রীয় পর্বতমালার উত্তর প্রান্তে অবস্থানের কারণে এই প্রদেশ ঠাণ্ডা ঋতুতে বেশ শীতার্তই থাকে। তাছাড়া এখানে রয়েছে কারাজ নদী এবং চলুস উপত্যকাও।
আমাদের আলোচনা থেকেই কারাজ প্রদেশের তিন ধরনের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যাবে। প্রথমত কারাজ সমতল ভূমিময় এলাকা। দ্বিতীয়ত সমতল এলাকার বাইরেও এখানে রয়েছে পার্বত্য অঞ্চল এবং তৃতীয়ত এখানে রয়েছে পার্বত্য পাদদেশ। ফলে তিন এলাকার আবহাওয়ায় সামান্য তারতম্য থাকলেও মোটামুটি এ অঞ্চলে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়াই বিরাজ করে। এ এলাকার গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়গুলোর মধ্যে ভেনতর বা অসা’রা’, সিকনু, হাফ্ত খন, কেরচন পাহাড় ইত্যাদির নাম করা যায়। আলবোর্জ প্রদেশে বহমান কয়েকটি নদীও আছে। এগুলো হলো অবে লনিজ, বারাগন, সিদাক, অব ভারযান, মওরুদ, কারাজ, ভরানংগেহ রুদ, বেলায়াত রুদ এবং অবে শাহরেস্তনাক নদী।
আলবোর্জ প্রদেশের অনুকূল আবহাওয়া আর জমির উর্বরতার কারণে এখানে কৃষিকাজের প্রচলন ব্যাপক। চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় পানির সংকুলানেরও ব্যবস্থা আছে এখানে। আরও রয়েছে প্রচুর পরিমাণ নার্সারি। বিচিত্র ফলফুলের চারা পাওয়া যায় এসব নার্সারিতে। এখানকার নার্সারির চারাগাছ সমগ্র ইরানে সরবরাহ করা হয়। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বহু শ্রমিকেরও প্রয়োজন পড়ে। ফলে আলবোর্জ প্রদেশে কর্মক্ষেত্র গড়ে উঠেছে অসংখ্য। এখানে শিল্প কলকারখানা বিশেষ করে প্রসেসিং শিল্প রয়েছে অনেক। খাদ্য সামগ্রী প্রস্তুতকারী কারখানাও গড়ে উঠেছে ব্যাপক। আর যেখানে শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠবে সেখানেই বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হবে এটাই স্বাভাবিক। আলবোর্জে গ্রিন হাউজও গড়ে উঠেছে প্রচুর। এখানে যদি একটি বিমান বন্দর থাকত তাহলে রপ্তানি ক্ষেত্রেও ব্যাপক উন্নতির সম্ভাবনা ছিল।
আলবোর্জে খাদ্য সামগ্রী উৎপাদনের কারখানা ছাড়াও তাঁত শিল্প, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প এবং চামড়াজাত পণ্য সামগ্রী তৈরির শিল্প, সেলুলয়েড শিল্প এবং কৃষি শিল্পও গড়ে উঠেছে প্রচুর। এইসব শিল্পের কারণে আলবোর্জ প্রদেশ ইরানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। খনিজ শিল্পের ক্ষেত্রেও বেশ অগ্রসর আলবোর্জ। চুনাপাথর, চক, তামা, কয়লা, পাথর, লবণ, সিলিকা, খনিজ বালু ইত্যাদি খনিজ দ্রব্য এখানে পাওয়া যায়।
কারাজ শহর কেন্দ্রীয় আলবোর্জের দক্ষিণ এবং কাভির মরুভূমির মাঝখানে অবস্থিত। আবহাওয়াগত দিক থেকে বিবেচনা করলে এই এলাকাকে শুষ্ক এবং উষ্ণ অঞ্চলই বলতে হবে। তবে এখানকার আবহাওয়ায় পরিবর্তন বেশি এবং মোটামুটি আর্দ্রতাও রয়েছে। উচ্চতার দিক থেকে বিচার করলে তিন ভাগে ভাগ করা যায় এ এলাকাকে। পার্বত্য এলাকা, উপত্যকা ও মরু এলাকা এবং তুলনামূলকভাবে সমতল এলাকা।
পার্বত্য এলাকার মধ্যে পড়বে হেসার পাহাড়, বেইলাগন পাহাড়, বিজে পাহাড়, সিয়হ কালন পাহাড়, অতাশগহ এবং ভারজন পাহাড়। এই পাহাড়গুলোর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সর্বনিম্ন ১১৪০ মিটার এবং সবোর্চ্চ ২২৩০ মিটার। এগুলোর চূড়া মোটামুটি বরফে ঢাকা থাকে। এখানকার উপত্যকাগুলো এবং কেন্দ্রীয় মরু এলাকার উচ্চতাও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২০০ মিটার কোথাও আবার ১৪০০ মিটার।
কারাজ নদী আলবোর্জ পর্বতের দক্ষিণ প্রান্তে পড়েছে। এই নদীর উৎস হলো খারসাংকুহ। এই নদীটির দৈর্ঘ্য দুই শ বিশ কিলোমিটার। এই নদীর উপরে চলুস মহাসড়কের কাছে বিরাট একটা বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। এই বাঁধের নাম হলো আমির কাবির। এই বাঁধের পানি তেহরানের খাবার পানির চাহিদা মিটিয়ে ৭৫ হাজার হেক্টর জমির পানির চাহিদা মেটায়। কারাজ নদীর এই বাঁধের তীর জুড়ে গড়ে উঠেছে পর্যটন পরিবেশ। চমৎকার এই পরিবেশে বেড়াতে আসেন অসংখ্য মানুষ। এখানে উৎপন্ন হয় বিচিত্র কৃষিপণ্য যেমন গম, যব, বিচিত্র দানাদার শস্য, শাকসবজি, তুলা, বিট, ভেষজ উদ্ভিদ ইত্যাদি। কারাজে ফুলফলের বাগানও গড়ে উঠেছে প্রচুর।
ইতিহাস থেকে জানা যায় ইসলাম-পূর্বকাল থেকেই এই কারাজে আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। আর অনেক প্রমাণ এখানকার প্রাচীন স্থাপনাগুলোতে লক্ষ্য করা যায়। কারাজ শহরের উপকণ্ঠে ‘অগ্’ টিলা, মার্দাবাদে, শাহ দেজ কেল্লা, দোখতার কেল্লা, কালাক কেল্লাসহ বিভিন্ন প্রাচীন প্রাসাদে যেসব পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে তা থেকে এই শহরে মানব বসতির প্রাচীনত্বের বিষয়টি ফুটে ওঠে। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে অগা’ মুহাম্মাদ খান কাজার তেহরানকে রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করার পর কারাজ রাজধানী শহরের পার্শ্ববর্তী শহর হিসেবে ধীরে ধীরে উন্নত হতে থাকে।#