'পৃথিবীর চাকচিক্যময় শোভায় প্রতারিত হওয়া উচিত নয়'
সুরা কাহাফের প্রাথমিক পরিচিতি ও কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যা
সুরা কাহাফে রয়েছে ১১০ আয়াত ও ১২ টি রুকু। সুরাটির ২৮ নম্বর আয়াত ছাড়া অন্য সব আয়াত নাজিল হয়েছিল মক্কায়। এ সূরায় বর্ণিত শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হল- কুরআন ঐশী গ্রন্থ, আল্লাহর কোন সন্তান নেই, কাহাফ বা গুহাবাসীদের ঘটনা, প্রত্যেক কাজে ইনশাআল্লাহ তথা ‘আল্লাহ যদি চান’ বলাটা জরুরি, ধৈর্যধারণের উপদেশ, জান্নাত ও জাহান্নামের প্রকৃতি। এ ছাড়াও মুমিন ও কাফিরের তুলনা, পার্থিব জীবনের উপমা, আমলনামা, কাফিরদের পরিতাপ, হযরত আদম (আ.) ও ইবলিসের ঘটনা, যুল-কারনাইন-এর ঘটনা, মুসা ও খিজির (আ.)’র ঘটনা, কিয়ামতের বিবরণ এবং মহান আল্লাহর নিদর্শন বা আয়াতের অন্ত না থাকার কথাও এই সুরার অন্যতম শিক্ষনীয় বিষয়। সুরা আসহাবে কাহাফে বর্ণিত তিনটি রোমহর্ষক ও বিস্ময়কর কাহিনী একত্ববাদ, ঈমান ও প্রতিরোধের চেতনাকে জোরদার করে।
সুরা আসহাবে কাহাফের সুরার সাত নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই ভূপৃষ্ঠে যা কিছু আছে সেগুলোকে আমরা তার (ভূমির) জন্য শোভা করেছি যাতে তাদের পরীক্ষা করি যে, কর্মের ভিত্তিতে তাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ?’
এই পৃথিবীর চাকচিক্যময় শোভায় প্রতারিত হওয়া উচিত নয়। ইহকালীন জগতের সব কিছুই হচ্ছে পরীক্ষার মাধ্যম এবং এর সবই একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। মানুষের উচিত ইহকালের মোহ থেকে নিজের মুক্ত রাখা এবং পরকালের অনন্ত অসীম জীবনের কথা মনে রেখে সৎ কাজ করা।
একদল কাফির কুরাইশ নেতা তাদের দুই সহযোগী বা সঙ্গীকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র আহ্বান সম্পর্কে গবেষণা বা যাচাই-বাছাই করতে মদীনার দুই ইহুদি পন্ডিতের কাছে পাঠায়। অতীতের আসমানী গ্রন্থগুলোতে মুহাম্মাদ (সা.)’র আহ্বান বা ইসলাম সম্পর্কে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় কিনা তা জানা ছিল এই কাফির নেতাদের উদ্দেশ্য। ইহুদি পণ্ডিতরা বললেন, তোমরা মুহাম্মাদের কাছে তিনটি প্রশ্ন কর। যদি এই তিনটি প্রশ্নের যথাযোগ্য জবাব তিনি দিতে পারেন তাহলে বুঝবে যে তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত একজন বড় নবী। আর যদি এই তিন প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারেন তাহলে বুঝবে যে এই ব্যক্তি মিথ্যাবাদী ও তোমরা তার ব্যাপারে তখন যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পার।
প্রথমে তাঁর কাছে প্রশ্ন কর সুদূর অতীতের সেই গুহাবাসী যুবকদের বিস্ময়কর কাহিনী সম্পর্কে যারা তাদের জাতি থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। এরপর প্রশ্ন করবে সেই ব্যক্তি সম্পর্কে যে পুরো পৃথিবীর চার দিকে ঘুরেছিল এবং তাঁর রাজ্য পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিমে বিস্তৃত হয়েছিল। তৃতীয়ত তাঁকে রুহের বাস্তবতা বা স্বরূপ সম্পর্কে প্রশ্ন করবে।
এরপর কুরাইশদের ওই দুই প্রতিনিধি মহানবীর (সা.) কাছে উপস্থিত হয়ে ওই প্রশ্নগুলো তোলে। জবাবে মহানবী (সা.) জানান যে তিনি পরের দিন তাদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন। কিন্তু ১৫ দিন পর ওহি তথা সুরা কাহাফ নাজেল হয়। আর তাতে তাদের ওইসব প্রশ্নের উত্তর ছিল।
সুরা কাহাফে এমন এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে যা মুসলমানদের সেই কঠিন অবস্থার মধ্যে লালন করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। আর এই শিক্ষা হল দুর্নীতিতে অভ্যস্ত ও মিথ্যা বা অন্যায়ের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বিশাল বা দৃশ্যত শক্তিশালী সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিপক্ষের কাছেও সত্যের অনুসারী একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর কখনও আত্মসমর্পণ করা বা নতজানু হওয়া উচিত নয় এবং উচিত নয় দুর্নীতির গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়া। বরং আসহাবে কাহাফের বীর যুবকদের মতই রুখে দাঁড়াতে হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং শক্তি না থাকলে হিজরত করতে হবে। প্রশ্ন হল, আসহাবে কাহাফ কারা ছিলেন?
এ প্রসঙ্গে শুনুন সুরা কাহাফের নয় নম্বর আয়াত থেকে ১৭ নম্বর আয়াতের অর্থ:
'(৯) তুমি কি মনে করেছ যে, ‘কাহ্ফ ও রাকীম’ (গুহা ও ফলক)-এর অধিবাসীরা আমাদের বিস্ময়কর নিদর্শনগুলোর অংশ ছিল? (১০) যখন কয়েকজন যুবক গুহাতে আশ্রয় নিল তখন তারা বলল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তোমার পক্ষ হতে আমাদের অনুগ্রহ দান কর এবং আমাদের কর্মে সঠিক পথের ব্যবস্থা কর।’ (১১)এরপর আমরা গুহাতে তাদের কানের ওপর কয়েক বছরের জন্য ঘুমের আবরণ আরোপ করলাম। (১২) এরপর আমরা তাদের পুনরুত্থিত করলাম এটা জানাবার জন্য যে, দু’দলের মধ্যে কোনটি তাদের গুহাবাসের কাল সঠিকভাবে গণনা করেছে। (১৩) আমরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ বৃত্তান্ত তোমার কাছে যথাযথভাবে বিবৃত করছি; নিশ্চয় তারা কয়েকজন যুবক ছিল, যারা তাদের প্রতিপালকের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমরা তাদের সৎপথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। (১৪) এবং তাদের অন্তঃকরণ দৃঢ় করেছিলাম সেসময় যখন তারা এ কথা বলে উত্থান করেছিল যে, ‘আমাদের প্রতিপালক আকাশমণ্ডল ও জমিনের প্রতিপালক, আমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কোন উপাস্যকে আহ্বান করব না, অন্যথায় নিঃসন্দেহে আমরা অসঙ্গত কথা বলেছি।'
'(১৫) এরা আমাদের সম্প্রদায় যারা তাঁকে ছেড়ে অন্যদের উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছে; তারা কেন তাদের উপাস্যদের সত্যতার সপক্ষে স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করে না? তার চেয়ে বেশি জালিম কে হবে যে আল্লাহর ওপর মিথ্যারোপ করে।’ (১৬) (যুবকরা একে অপরকে বলল) যখন তোমরা তাদের থেকে এবং আল্লাহ ছাড়া তারা যাদের আহ্বান করে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হবে তখন গুহাতে আশ্রয় গ্রহণ কর। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য তাঁর অনুগ্রহ থেকে প্রসারতা দান করবেন এবং তোমাদের কর্মে তোমাদের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যের উপকরণ সরবরাহ করবেন। (১৭) তুমি লক্ষ্য করবে যে, যখন সূর্য উদয় হয় তখন তাদের গুহা থেকে ডান দিকে ঢলে অতিক্রম করে যায় এবং যখন সূর্যাস্ত হয় তখন তা তাদের বাম দিক দিয়ে অতিক্রান্ত হয়; এবং তারা তার ভেতরে তথা গুহায় এক প্রশস্ত স্থানে অবস্থান করছে; এটা আল্লাহর নিদর্শনাবলির মধ্যে একটি নিদর্শন। আল্লাহ যাকে পথনির্দেশ দান করেন সে পথপ্রাপ্ত; এবং যাকে পথভ্রষ্টতায় ছেড়ে রাখেন তার জন্য তুমি কোন অভিভাবক ও পথনির্দেশক পাবে না।' #
আসহাবে কাহাফের ঘটনা নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব আগামী পর্বে।