ডিসেম্বর ১৩, ২০১৬ ২১:২০ Asia/Dhaka

ইসলাম হচ্ছে একটি ছাতার মতো। আর সেই ইসলামকে কেন্দ্র করেই আমরা আবর্তিত হব। কোনো অবস্থাতেই আমরা বিচ্ছিন্ন হব না। ইসলামে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। ইরানের শুরু হওয়া ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ সম্পর্কে রেডিও তেহরানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. এফ এম এ এইচ ত্বাকি। পুরো সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হলো। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

বর্তমান ইসলামি বিশ্বে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণেই মুসলামনরা একজন থেকে আরেকজন এক দেশ থেকে আরেক দেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তবে এটা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। তবে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসাও খুব একটা কঠিন কাজ বলে আমি মনে করি না।


রেডিও তেহরান: ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মহান নেতা মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) ১২ রবিউল আউয়াল থেকে ১৭ রবিউল আউয়াল পর্যন্ত সময়কে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ ঘোষণা করেছিলেন। সেই অনুযায়ী সারা বিশ্বে ঐক্য সপ্তাহ পালন করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে- সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহর গুরুত্বকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
 
অধ্যাপক ত্বাকি: একটি সুন্দর প্রশ্ন উপস্থাপন করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। ইরানের ইসলামি ব্প্লিবের মহান নেতা মরুহুম ইমাম খোমেনী(র.) ১২ রবিউল আউয়াল থেকে ১৭ রবিউল আউয়াল পর্যন্ত সময়কে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ ঘোষণা করেছিলেন-এটি বর্তমান বিশ্বে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ ইসলাম এমন একটি ধর্ম  যা ঐক্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলামে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহর রশ্মিকে মজবুতভাবে ধারণ কর এবং তোমরা বিচ্ছিন্ন হইও না’। পবিত্র কুরানে বর্ণিত এ বিষয়টিকে আমাদের সব সময় প্রতিপালন করা দরকার। কিন্তু আমরা জাগতিক বিষয়ে খুব বেশিরকম মত্ত থাকার কারণে পবিত্র কুরআনের এই মহান বাণীকে ভুলে যাই। আমরা যাতে এ বিষয়টি ভুলে না যাই সেজন্যে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের মহান নেতা মরুহুম ইমাম খোমেনী (র.) রাসুলে করিম (স.) জন্মমাসের জন্ম তারিখ থেকে ইসলামি ঐক্য সপ্তাহ পালনের ডাক দিয়েছেন। আমরা যেন মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ থাকি সে কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তিনি। বর্তমান বিশ্বে মুসলিম ঐক্যের বা ইসলামি ঐক্যের গুরুত্ব অনেক। আমরা মুসলমানরা যদি ঐক্যবদ্ধ না থাকি তাহলে প্রতি পদে পরাজিত হব।

রেডিও তেহরান: আচ্ছা, মুসলিম বিশ্বে বিশেষ করে রাজনৈতিক যেসব মতপার্থক্য আছে তা থেকে বেরিয়ে এসে শক্তিশালী ঐক্য করা কী খুব কঠিন কোনো কাজ? আপনার কী মনে হয়?
  
অধ্যাপক ত্বাকি: দেখুন, ইসলাম হচ্ছে ঐক্যের ধর্ম। বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোতে রাজনৈতিক কাঠামো একেক ধরনের। রয়েছে নানা মতপার্থক্য আছে। কোথাও আছে একনায়কতন্ত্র। কোথাও বা রাজতন্ত্র। আবার কোথাও গণতন্ত্র। বহুরকমের তন্ত্র এবং মতপার্থক্য রয়েছে, রয়েছে নানা দল উপদল। এরকম থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে তার অর্থ এই নয় আমরা ইসলাম থেকে দূরে সরে যাব বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব।
ইসলাম হচ্ছে একটি ছাতার মতো। এই ছাতাই হচ্ছে আমাদের আশ্রয়। আর সেই  ইসলামকে কেন্দ্র করেই আমরা আবর্তিত হব। কোনো অবস্থাতেই আমরা বিচ্ছিন্ন হব না।

বর্তমান ইসলামি বিশ্বে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণেই মুসলামনরা একজন থেকে আরেকজন এক দেশ থেকে আরেক দেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তবে এটা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। তবে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসাও খুব একটা কঠিন কাজ বলে আমি মনে করি না।

আমাদের মুসলমানদের মধ্যে যত মতপার্থক্য থাকুক না কেন যদি একজন শক্তিশালী নেতৃত্বের আওতায় আসা যায় অথবা যারা মুসলমানদের নেতৃত্বে আছেন  তারা সবাই যদি সম্মিলিতভাবে ঐক্যের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে তাহলে বর্তমান সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। মুসলিম নেতৃত্ব ও সংগঠনের মাধ্যমে ছোটো খাটো যেসব ভিন্নতা রয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসা যায় এবং বলিষ্ট নেতৃত্বের আওতায় আনা যায় তাহলে আমাদের মধ্যে ঐক্য হওয়া মোটেও কঠিন কিছু নয়।

রেডিও তেহরান: আমরা দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন দেশে এক দল মুসলমান আরেক দল মুসলমানকে হত্যা করছে। এ ক্ষেত্রে অনেকেই বলছেন মুসলিম অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরা  এ কাজ করে যাচ্ছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন? 

অধ্যাপক তাক্বি: দেখুন, একজন মুসলমান অপর একজন মুসলমানকে হত্যা করবে এটি কোনোভাবে কাম্য নয়। মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে এ ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করেছন। আল্লাহ বলেছেন, তোমরা অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করো না। বিচারের মাধ্যমে দণ্ডপ্রাপ্ত ছাড়া কোনো মানুষকে হত্যা করার বিধান ইসলামে নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের কোনো কোনো মুসলিম রাষ্ট্র সামান্য স্বার্থের মোহে অন্য দেশের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালাচ্ছে। এটি মোটেই কাম্য নয়। অথচ এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়টি মুসলিম বিশ্বে প্রতিনিয়ত ঘটছে। আর এসবের পেছনে সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত আছে বলেই অনেকের মত। 

সাম্রাজ্যবাদী শক্তি একটি বড় শক্তি বর্তমান বিশ্বে। ক্রুসেডের যুদ্ধে মুসলমানদের কাছে পরাজিত হবার পর থেকে তার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা সব সময় চক্রান্ত এবং ষড়যন্ত্র করছে। তারা সুযোগের সন্ধানে আছে। আর সেই সুযোগ পেলে তাকে কাজে লাগাতে বিন্দুমাত্র দেরি করছে না সাম্রাজ্যবাদীরা। কিন্তু মুসলমানরা যদি নিজেদের অস্তিত্বের কথা চিন্তা না করে অনৈক্য এবং পরস্পরের মধ্যে বিরোধে লিপ্ত থাকে, পরস্পরকে হত্যা করে তাহলে সেই সুযোগকে তো সাম্রাজ্যবাদীরা কাজে লাগাবে। আর এতে তারাই লাভবান হবে সেটাই স্বাভাবিক।  যত বেশি মুসলমানদের মধ্যে দল-উপদলে বিভক্ত হওয়ার ঘটনা ঘটবে, যত বেশি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে তত বেশি ইসলামের প্রতিপক্ষ তথা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি লাভবান হবে। এ বিষয়টি মুসলমানদের খুব ভালো করে অনুধাবন করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে সেই অনুধাবনের বিষয়টি খুব কম দেখা যাচ্ছে। ফলে মুসলমানরা দুর্বল হচ্ছে এবং পরাজিত হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাত রয়েছে বা তাদের চক্রান্ত রয়েছে বলে কথা বলা হয় তা অনেকটাই সঠিক বলে আমি মনে করি।

রেডিও তেহরান: ‘ইসলামী দেশসমূহে যেসব নাপাক লোকজন শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে, তারা শিয়াও নয়, সুন্নিও নয়; বরং তারা হলো সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল, যারা ইসলামী দেশসমূহকে আমাদের থেকে ছিনিয়ে নিতে চায়।’ -ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতা মরহুম ইমাম খোমেনীর এ মন্তব্যের সঙ্গে বর্তমান মুসলিম বিশ্বের বাস্তবতায় কোনো মিল দেখতে পাচ্ছেন কি?

অধ্যাপক ত্বাকি: বর্তমানে ইসলামি দেশগুলোতে শিয়া-সুন্নি বিভাজন একটি সত্য ঘটনা। তার চেয়েও বড় সত্য হচ্ছে শিয়ারাও মুসলমান এবং সুন্নিরাও মুসলমান। কাজেই মুসলমানদের মধ্যে কোনো বিরোধ থাকা উচিত নয় বলে আমি মনে করি। এ ব্যাপারে আমাদের সংশোধিত হওয়া দরকার। যেকোনো মূল্যে এই শিয়া- সুন্নি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। শিয়া-সুন্নি উভয়ই মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও  -শিয়া-সুন্নি ধুয়া তুলে যারা উভয়ের মধ্যে বিরোধের আগুন জ্বালাচ্ছে তারা আসলে নিজেদের স্বার্থে করছে। আর এই অশুভ চক্র প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। তবে তাদের এই সুযোগ দেয়া উচিত নয়। শিয়া-সুন্নির এই দ্ব্ন্দ্ব যতদ্রুত সম্ভব নিষ্পত্তি করে নেয়া দরকার। ইসলাম বিদ্বেষীরা শিয়া-সুন্নির বিভেদকে কাজে লাগিয়ে শক্তিশালী হচ্ছে। ইসলাম বিরোধীরা এই সুযোগে মুসলমানদের কাছ থেকে ইসলামি সাম্রাজ্যকে তাদের নিজেদের অধিকারে নিয়ে যাচ্ছে। মুসলমানরা কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। সারাবিশ্বের মুসলমানদের ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে পড়ছে। এ বিষয়টি মরুহুম ইমাম খোমেনী (র.) খুব ভালোভাবে অনুধাবন করেছিলেন। আর সে কারণেই তিনি তাঁর মন্তব্যে বলেছিলেন, ‘ইসলামী দেশসমূহে যেসব নাপাক লোকজন শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে, তারা শিয়াও নয়, সুন্নিও নয়; বরং তারা হলো সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল, যারা ইসলামী দেশসমূহকে আমাদের থেকে ছিনিয়ে নিতে চায়।’
মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আমাদের উচিত হবে যত দ্রুত সম্ভব আমাদের মধ্যকার বিরোধ মিটিয়ে ফেলা এবং ঐক্যের মধ্যে আসা।#


পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৩
 

ট্যাগ