মে ২৯, ২০১৭ ২০:৩৬ Asia/Dhaka

কুরআনের আলো অনুষ্ঠানের এই পর্বে সূরা আনকাবুতের ৪১ থেকে ৪৫ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এই সূরার ৪১ ও ৪২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

مَثَلُ الَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ أَوْلِيَاءَ كَمَثَلِ الْعَنْكَبُوتِ اتَّخَذَتْ بَيْتًا وَإِنَّ أَوْهَنَ الْبُيُوتِ لَبَيْتُ الْعَنْكَبُوتِ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ (41) إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ مِنْ شَيْءٍ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ (42)

"যারা আল্লাহর পরিবর্তে অপরকে (নিজেদের) অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে, তাদের দৃষ্টান্ত মাকড়সা। যে নিজের জন্য ঘর বানায় এবং ঘরের মধ্যে মাকড়সার ঘরই তো দুর্বলতম, যদি ওরা জানত। (২৯:৪১)

"ওরা আল্লাহর পরিবর্তে যা কিছুকে আহ্বান করে আল্লাহ তা জানেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, বিজ্ঞানময়।" (২৯:৪২)

গত কয়েকটি আসরে অতীতের অনেকগুলো জাতির কথা আলোচিত হয়েছে যারা নবী-রাসূলদের বিরোধিতা করার করার কারণে আল্লাহর ইচ্ছায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আর আজকের দুই আয়াতের প্রথম আয়াতে কাফেরদেরকে মাকড়সার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। মাকড়সাকে আরবি ভাষায় আনকাবুত বলা হয় এবং এই আয়াতে উল্লেখিত 'আনকাবুত' শব্দ থেকে সূরাটির নামকরণ করা হয়েছে। এখানে মহান আল্লাহ কাফেরদের কথা উল্লেখ করে বলছেন: তারা এক আল্লাহর পরিবর্তে কোনো মানুষ বা বস্তুর উপাসনা করে। অথচ আল্লাহ ছাড়া অন্য যেকোনো শক্তি সে যদি ফেরাউনের মতো দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সম্রাটও হয় তাহলেও আল্লাহর শক্তির সামনে সে অসহায়। এ ধরনের শক্তির দম্ভ মাকড়সার জালের মতো যা অসংখ্য সুতা দিয়ে তৈরি হলেও অত্যন্ত কোমল এবং সামান্য বাতাসেই ধ্বংস হয়ে যায়। যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো শক্তির ওপর নির্ভর করে তারা আসলে মাকড়সার জালের ওপর ভর করে। কঠিন পরিস্থিতিতে এ ধরনের শক্তি ধ্বংস হয়ে যায়।

মুশরিকরা যদি জানত তারা যাদের ওপর ভরসা করছে সেগুলো মাকড়সার বাসার মতো তাহলে তারা এগুলোর পেছনে ছুটত না।

এ দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১. পবিত্র কুরআন মানুষকে সহজে হেদায়েতের বাণী বোঝানোর জন্য নানা উপমা তুলে ধরে। আর সকল যুগের, সকল স্থানের ও সব শ্রেণির মানুষের জন্য বোধগম্য উপমাই হচ্ছে সেরা দৃষ্টান্ত।

২. ঈমানের ভিত্তি অত্যন্ত মজবুত ও শক্তিশালী হয়। অন্যদিকে শিরকের ভিত্তি নিতান্ত দুর্বল।

৩. মাকড়সার বাসার মতো কাঠামোবিহীন দুর্বল জিনিসের প্রতি ভরসা না করে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে যিনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়।

সূরা আনকাবুতের ৪৩ ও ৪৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

  وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ وَمَا يَعْقِلُهَا إِلَّا الْعَالِمُونَ (43) خَلَقَ اللَّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِالْحَقِّ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَةً لِلْمُؤْمِنِينَ (44)  

"মানুষের জন্য আমি এই সকল দৃষ্টান্ত দেই; কিন্তু কেবল জ্ঞানী ব্যক্তিরাই তা উপলব্ধি করে।" (২৯:৪৩)

"আল্লাহ যথাযথভাবে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন; এতে বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য অবশ্যই নিদর্শন আছে।" (২৯:৪৪)

এই দুই আয়াতে কুরআনে বর্ণিত উপমাগুলোর গুরুত্বের কথা তুলে করা হচ্ছে এভাবে: কেউ যেন এটা না ভাবে যে, কুরআনে অনর্থক এসব উপমা টানা হয়েছে। বরং ঈমান ও কুফরের মধ্যকার পার্থক্য বোঝানোর  জন্য মহান আল্লাহ এসব দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। অনেক সময় সাধারণ মানুষ এসব উপমাকে ফালতু বলে মনে করে কিন্তু জ্ঞানী ও বিজ্ঞ ব্যক্তিরা এগুলোর গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। জ্ঞানী ব্যক্তিরা বিচারবুদ্ধি ব্যবহার করে এসব উপমার গুরুত্ব বুঝতে পারেন যা সাধারণ মানুষের পক্ষে উপলব্ধি করা কঠিন।

পরের আয়াতে বলা হচ্ছে: যে আল্লাহ সবকিছু জানেন এবং বিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময় তিনি কোনো কিছু অনর্থক ও বিনা কারণে সৃষ্টি করেননি; বরং যথাযথ প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছেন। ঈমানদার ব্যক্তি মাত্রই এ বিষয়টি উপলব্ধি করলেও কাফির ও মুশরিকরা তা বুঝতে রাজি নয়।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১. পবিত্র কুরআনে ব্যবহৃত উপমাগুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও গভীর অর্থবোধক এবং বিজ্ঞ ও সচেতন ব্যক্তিরাই কেবল এর গভীরতা উপলব্ধি করতে পারে।

২. সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও লক্ষ্য নিয়ে এই বিশ্বজগত সৃষ্টি করা হয়েছে। কোনো দুর্ঘটনার মাধ্যমে এটি সৃষ্টি হয়নি।

৩. কাফের ও মুশরিকদের পক্ষে সৃষ্টির রহস্য উপলব্ধি করা সহজ নয়। কিন্তু ঈমানদার ব্যক্তি যেকোনো সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহকে খোঁজে; ফলে তার পক্ষে আল্লাহকে উপলব্ধি করা সহজ হয়ে যায়।

সূরা আনকাবুতের ৪৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন:

  اتْلُ مَا أُوحِيَ إِلَيْكَ مِنَ الْكِتَابِ وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ (45)

"(হে রাসূল) তুমি তোমার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট কিতাব তেলাওয়াতা করো এবং নামাজ কায়েম করো। নিশ্চয় নামাজ (মানুষকে) অশ্লীলতা ও কদর্যতা হতে দূরে রাখে। আল্লাহর স্মরণই সর্বশ্রেষ্ঠ। তোমরা যা করো আল্লাহ তা জানেন।" (২৯:৪৫)

এই আয়াতের বক্তব্য বিশ্বনবী (সা.)কে উদ্দেশ করে বলা হলেও এতে সব মুমিন বান্দার জন্য দিক-নির্দেশনা রয়েছে। ঈমানদার ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মহান আল্লাহ সরাসরি বিশ্বনবী (সা.)কে লক্ষ্য করে কথাগুলো বর্ণনা করেছেন।

এই আয়াতে মুমিন ব্যক্তিকে দুটি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর একটি হচ্ছে কুরআন তেলাওয়াত ও দ্বিতীয়টি হচ্ছে নামাজ কায়েম করা। নিঃসন্দেহে কোনো ব্যক্তি নিরবচ্ছিন্নভাবে এই দুটি ইবাদত করতে পারলে তার শরীর ও আত্মার ওপর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে এই দুই ইবাদতে গাফিলতি দেখালে মানুষের ঈমান দুর্বল হয়ে যায়। তবে পবিত্র কুরআন যদি অর্থ বুঝে তেলাওয়াত করা যায় তাহলে এর প্রভাব অনেক বেশি হয় এবং তা ব্যক্তির ঈমান শক্তিশালী করতে সহায়তা করে।

প্রতিদিন একজন ঈমানদার ব্যক্তিকে ১৭ রাকাত ফরজ নামাজ আদায় করতে হয়। কেউ যদি অত্যন্ত খুশু-খুজুর সঙ্গে এবং একাগ্রতা সহকারে পবিত্রতা অর্জনের উদ্দেশ্যে এই নামাজ আদায় করতে পারে তাহলে সব ধরনের পাপকাজ ও অপত্রিতা থেকে তার মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। নামাজের অন্যতম উপকার হলো তা মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। অবশ্য গোনাহ থেকে দূরে থাকা হচ্ছে নামাজের সবচেয়ে ছোট উপকার। নামাজের সবচেয়ে বড় উপকার হচ্ছে আল্লাহ ও তার নেয়ামতগুলোর স্মরণ যা সৃষ্টিকর্তার দরবারে সবচেয়ে বড় ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:

. নামাজ আদায় ও কুরআন তেলাওয়াত ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ইবাদত। নবী-রাসূলগণ এই দুই ইবাদতের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।

. পবিত্র কুরআনে আল্লাহর কোনো কোনো বিধানের দর্শন বর্ণনা করা হয়েছে। নামাজের দর্শন বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হচ্ছে- এটি মানুষকে পাপকাজ থেকে দূরে রাখে।

. নামাজ ব্যক্তির পাশাপাশি সমাজ সংশোধনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।#